Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

‘দেশের অবস্থা ভালো লয়’

প্রকাশের সময় : ২০ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার : গভীর মনোযোগে পত্রিকা পড়ছেন ভদ্রলোক। বাস কন্ডাক্টরের চিৎকার, যাত্রীদের ওঠানামা কোনো কিছুতেই তার ভ্রুক্ষেপ নেই। ভাই, একটু সাইড দেন, বলেই এক মহিলা যাত্রী পাশ কাটিয়ে গেল পাশের সিটে বসতে। যাত্রীরা উঠে বসতে না পেরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, সেদিকে তার খেয়াল নেই।
গেট থেকে কন্ডাক্টর উঠে এসে গায়ে ধাক্কা দিয়ে ‘স্যার, বসতে দেন’ বলায় সম্বিত ফিলে পেয়ে ভদ্রলোক পত্রিকা থেকে চোখ নামালেন। সরে গিয়ে ভেতরের সিটে বসার জায়গা দিলেন। ‘ভাই, কী এত মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন?’ পহেলা বৈশাখের মেলা। পত্রিকায় লিখেছে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে এবার পহেলা বৈশাখে অধিকাংশ মেলা হয়নি। পুলিশ বলেছে, মেলা করতে পারেন, কিন্তু বিকেল ৫টার পর সব বন্ধ করে দিতে হবে। প্রচ- রোদ, গ্রামগঞ্জে মেলার কেনাবেচা জমে বিকেল আর সন্ধ্যায়। গভীর রাত পর্যন্ত মেলা হয়ে আসছে শত শত বছর ধরে। অথচ এবার বিকেলের মধ্যেই মেলা গুটিয়ে ফেলার কঠোর নির্দেশনা দেয়ায় আর্থিক ক্ষতি বিবেচনা করে অধিকাংশ এলাকায় মেলার আয়োজন হয়নি।
তার মানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে পুলিশ দেশের মানুষকে স্বাভাবিক মেলা-পার্বণও করতে দিচ্ছে না? এসব কথা হচ্ছিল গতকাল দুপুরে চিটাগাং রোড টু মোহাম্মদপুর রুটের বাসে। কাজলায় সিটে বসা নিয়ে শুরু হলে দুই যাত্রীর মধ্যে ঝগড়া। প্রায় হাতাহাতি অবস্থা। দৌড়ে এসে তরুণ কন্ডাক্টর মিনতি করে বললেন, ঝগড়া করবেন না। দেশের অবস্থা ভালো লয়। দেখেন না ফুটফাট বোমাবাজির কারণে মেলা পর্যন্ত বন্ধ! প্রচ- গরমে যাত্রীদের শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। তারপরও কন্ডাক্টর ‘ফার্মগেট, মোহাম্মদপুর’ চিৎকার করছে। যাত্রাবাড়ীতে ঠায় দাঁড়িয়ে পড়ল বাস। প্রচ- গরমে হৈচৈ-চেঁচামেচি করে উঠছে যাত্রীরা। পেছনের সিট থেকে ড্রাইভারকে গালি দিয়ে বাস ছাড়তে তাড়া দিলেন এক যাত্রী। বিনয়ী ড্রাইভার বলেন, স্যার, জমার অর্ধেক টাকাই উঠেনি। এসব বাস ব্যাংক লোনে কেনা। মালিককে ৪ হাজার টাকা গুনতে হয়। এক টাকাও কম দেয়া যায় না। ড্রাইভারের মুখে এ কথা শুনেই খেঁকিয়ে উঠলেন পিছনের সারির সিটে বসা এক বৃদ্ধ। বললেন, ‘ব্যাংক ঋণ! বাংলাদেশ ব্যাংকের কথা জান? ৮ হাজার কোটি টাকা চুরি হয়েছে; অথচ এ টাকা আদায় নিয়ে সরকারের মাথাব্যথাই নেই। দিল্লির গোলাম এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মতলুব আহমদ বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা ছিঁচকে চুরি।’ এর আগে হলমার্কের ৪ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনায় অর্থমন্ত্রী দম্ভোক্তি করে বলেছিলেন, ‘৪ হাজার কোটি টাকা কোনো টাকাই নয়।’ বোঝেন! তুমি ড্রাইভার দিনে ৪ হাজার টাকার জন্য এতগুলো মানুষকে কষ্ট দিচ্ছ? এতক্ষণ নীরবে অন্যের কথা শুনছিলেন এক তরুণ। সে মুখ খুললেন, ভাই শোনেন। প্রবাদে আছে ‘যার বিয়ে তার খবর নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই।’ আমাদের অবস্থা তেমন। চুরি হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা। এ টাকা উদ্ধারে আমাদের সরকারের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। বিপুল পরিমাণ রিজার্ভ যে চুরি হয়েছে, অথচ সরকারের হাবভাব যেন কিছুই হয়নি। গলা ফাটিয়ে প্রচার করে ২৮ মিলিয়ন ডলার রিজার্ভ, অথচ সেখান থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা চুরি নিয়ে কোনো কথা নেই। টাকা চুরি গেছে বাংলাদেশের জনগণের, অথচ মার্কোসের ফিলিপাইনে এ নিয়ে চলছে তোলপাড়। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট মার্কোস ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ। তার পতনের সময় স্ত্রী ইমেলডার ঘরে কয়েক হাজার জুতা পাওয়া যায়। দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য সেই ফিলিপাইনে ব্যাংকিংয়ে অনিয়ম করায় কয়েকজনের বিরুদ্ধে বেসামরিক বিচার বিভাগ ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস (ডিওজে) শুরু হয়েছে। এর আগে দেশটির রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দাগুইতোর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়। আরসিবিসির জুপিটার স্ট্রিটের মাকাতি শাখায় চারটি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমেই বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি যাওয়া অর্থ ফিলিপাইনে প্রবেশ করেছিল। তদন্ত করে তারা সেটা বের করেছে। সরকার এবং আইন কঠোর হওয়ায় অভিযুক্ত চীনা নাগরিক কিছু টাকা ফেরত দিচ্ছে দফায় দফায়। বাংলাদেশের চুরি যাওয়া টাকা নিয়ে ফিলিপাইনের সংসদে তোলপাড়। সিনেট কমিটিতে শুনানি হয়েছে। দেশটির মুদ্রা পাচারবিরোধী আইনের ৪নং ধারা ভঙ্গের অভিযোগে সেখানকার অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কাউন্সিলের (এএমএলসি) দায়ের করা অভিযোগের শুনানিতে হাজিরা দিয়েছেন মায়া দাগুইতো। মায়া দাগুইতো ছাড়াও মাইকেল ফ্রান্সিসকো ক্রুজ, জেসি ক্রিস্টোফার ল্যাগরোসাস, আলফ্রেড সান্তোস ভেরগারা ও এনরিকো টিওডোরো ভাসকুয়েজ নামের অভিযুক্তরা দৌড়ের ওপর আছেন। টাকা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগারের। টাকার মালিক বাংলাদেশের জনগণ। অথচ এদেশে এ নিয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। টাকা চুরির ঘটনা ৪০ দিন গোপন রেখে দিল্লি ঘুরে এসে গভর্নর আতিউর রহমান পদত্যাগ করলেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি তাকে সৎ মানুষের সার্টিফিকেট দিলেন। ড. ফরাস উদ্দিনের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সে কমিটি কী করবে আল্লাহ মালুম। কারণ শেয়ারবাজরের তদন্ত রিপোর্ট মানুষ জানতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের কারা এ টাকা চুরির সঙ্গে জড়িত তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে না। সিআইডি তদন্ত করছে। তারা সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির ঘটনায় জড়িত ৩ দেশের ২০ জন বিদেশি নাগরিক শনাক্ত। এদের মধ্যে শ্রীলঙ্কার নাগরিক ৭ জন, জাপানের নাগরিক ১ জন এবং ফিলিপাইনের ১২ জন নাগরিক জড়িত রয়েছে। দেশের মানুষ জানতে চায় কেন্দ্রীয় কোষাগারের টাকা চুরির সঙ্গে এ দেশের কারা জড়িত। কারণ গভর্নরের পদত্যাগের পর দু’জন ডেপুটি গভর্নরকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। সফটওয়্যার ব্যবসায়ী ভারতীয় নাগরিক রাকেশ আস্তানার কাছে আইটির সরঞ্জাম ক্রয় করা হয়; তাকেই আবার ওই আইটি সেক্টরের দেখভালের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কার সিদ্ধান্তে? আতিউর চুরির ঘটনা ৪০ দিন গোপন রাখলেন কেন? বাস এগোচ্ছে আলোচনাও চলছে।
দয়াগঞ্জ মোড়ে বাসে উঠলেন কয়েকজন। তাদের কেউ কেউ শ্রোতা হয়ে গেলেন। তাদের একজন বিনয়ের সুরে বললেন, ভাই, সব কিছু বাদ দেন। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকা চুরির ঘটনায় পর সংসদ কী ভূমিকা রাখছে? ফিলিপাইনের পার্লামেন্টে এ নিয়ে শুনানি হয়েছে। অথচ আমাদের সংসদ নীরব! পেছনের সিটে বসা এক আইনজীবী নীরবতা ভাঙলেন। সবার উদ্দেশে বললেন, সংবিধানে রয়েছে দেশে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে বা জনগুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটলে তা নিয়ে সংসদে আলোচনার পাশাপাশি সংসদের মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি গুরুত্ব বিবেচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। এটাই প্রচলিত নিয়ম। জাতীয় সংসদে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি রয়েছে ৪৮টি। এসব কমিটির প্রশাসনে স্বচ্ছতার স্বার্থে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। সংবিধানের ৭৬ অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিগুলো নির্বাহী সরকারের বিভিন্ন কর্মকা- পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার বিধান রাখা হয়েছে। বিশেষ করে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি, বিদেশ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮শ কোটি টাকা চুরির রহস্য উদঘাটনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারত। তারা পদত্যাগী গভর্নরসহ সংশ্লিষ্টদের কমিটিতে ডেকে শুনানি করতে পারত। কিন্তু তেমন কিছুই দৃশ্যমান নয়। উটপাখির মতো বালুতে মুখ লুকিয়ে রাখলেই কি মানুষ সব ভুলে যাবে? এ সময় একজন একটি জাতীয় দৈনিক এগিয়ে দিয়ে বললেন, পড়েন কী লিখেছে? চোখ বুলাতেই চোখে পড়ল প্রখ্যাত কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছেন, ‘যেসব বালকের এখনো গোঁফ গজায়নি বা যেসব বালিকা এখনো ওড়না ধরেনি, তারাও এখন খবরের কাগজ পড়ে, টিভির সংবাদ তো দেখেই। তাদের আক্কেল-বুদ্ধি ও বিচার-বিবেচনা বঙ্গীয় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের চেয়ে কিছুমাত্র কম, তা শুধু বেকুব ছাড়া আর কারও মনে করার কারণ নেই।’ সবকিছুই তারা নিজেদের মতো করে জেনে-বুঝে নেন। গল্প শুনতে শুনতে মতিঝিলে এসে গেছে বাস। কন্ডাক্টর বলল, স্যার ভাড়া দিয়ে নেমে যান। বেশি কথা শুনবেন না, কখন কী হয় বলা মুশকিল। কে গোয়েন্দা আর কে সাধারণ যাত্রী বোঝা যায় না। দেশের অবস্থা ভালো লয়।



 

Show all comments
  • মোমিনুল ২০ এপ্রিল, ২০১৬, ১:৩৫ পিএম says : 0
    লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু রেজাল্ট হবে জিরো।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ‘দেশের অবস্থা ভালো লয়’

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ