Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রোগীদের দুর্ভোগের ৫ দিন পর চট্টগ্রামে ডাক্তার ধর্মঘট স্থগিত ব্যাপক সমালোচনায় বিএমএ’র পিছুটান

প্রকাশের সময় : ২৫ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

চট্টগ্রাম ব্যুরো : রোগীদের চরম কষ্ট-দুর্ভোগের ৫ দিন পর গতকাল (রোববার) বিকেলে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ডাক্তারদের লাগাতার ধর্মঘট ‘সাময়িকভাবে স্থগিত’ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন বিএমএ চট্টগ্রামের নেতারা। কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই গত বুধবার থেকে চলে আসা ধর্মঘট শেষ হলে বিকেল থেকে ক্রমশ খুলতে শুরু করে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডাক্তারদের ব্যক্তিগত চেম্বারগুলো। এর পূর্ব পর্যন্ত অগণিত রোগী ও স্বজনদের ভোগান্তি অবর্ণনীয় পোহাতে হয়। চমেক হাসপাতালে নেই তিল ধারণের ঠাঁই। আগামী ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরকে সামনে রেখে বিএমএর ব্যানারে ডাক্তারদের এহেন অনির্দিষ্টকালের ‘অমানবিক’ আন্দোলন থেকে সরে আসার লক্ষ্যে তীব্র সমালোচনা এবং চাপ আসছিল মেয়র, নেতৃবৃন্দ, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন মহল থেকে। ডাক্তারদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে এ ধর্মঘট ডাকা হয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম চট্টগ্রাম সিটি মেয়রকে বিএমএ ধর্মঘট প্রত্যাহার বা নিষ্পত্তির দায়িত্ব দেন। এ প্রেক্ষাপটে গত শনিবার মধ্য রাত থেকে চলে আসা সমঝোতা প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গতকাল দুপুর থেকে চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন ও প্রেসক্লাব সভাপতি কলিম সরোয়ারসহ নেতৃবৃন্দ ধর্মঘট প্রত্যাহারের বিষয়ে মধ্যস্থতা বৈঠক করেন। এতে মামলার বিষয়ে ‘সম্মানজনক’ সুরাহার আশ্বাস দেওয়া হয়। তখন বিএমএ নেতারা ধর্মঘট ‘সাময়িক স্থগিত’ রাখার ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছেন।
বিকেলে বৈঠক শেষে চমেক হাসপাতালের শাহ আলম বীরোত্তম মিলনায়তনে সমাবেশে বিএমএ সভাপতি ডা. মুজিবুল হক খান বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীতে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ব্যক্তিগত চেম্বারে বন্ধ রাখার আন্দোলন তারা সাময়িকভাবে স্থগিত করেছেন। তিন জন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বিষয়ে ‘সম্মানজনক’ সমাধানের আশ্বাস পাওয়ার পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সমাবেশে সিটি মেয়র রোগীদের চরম দুর্ভোগের কথা মানবিকভাবে বিবেচনা করে আন্দোলন বন্ধের জন্য চিকিৎসকদের প্রতি অনুরোধ জানান। তিন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে তিনি বাদী পক্ষের সঙ্গে কথা বলবেন ও সমাধানের পথ বের করবেন বলেও আশ্বাস দেন। এতে আরও বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি কলিম সরওয়ার ও সাধারণ সম্পাদক মহসিন চৌধুরী।
এর আগে গতকাল বিকেল পর্যন্ত বন্দরনগরী চট্টগ্রামে সকল বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও চেম্বার বন্ধ থাকায় অগণিত রোগী ও তাদের স্বজনদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় টানা ৫ দিন ধরে। চমেক হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল চালু থাকলেও সেখানে রোগীর ভিড় ছিল তীব্র। হঠাৎ ডাকা ধর্মঘটে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে চিকিৎসা সেবায় ধস নামে অনেকাংশেই। জরুরি চিকিৎসায় বিরাজ করে অচলদশা। গত বুধবার থেকে বিএমএ’র ডাকে চিকিৎসকেরা ধর্মঘট শুরু করলে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, এমনকি চেম্বারে ডাক্তারদের রোগী দেখাও সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ডাক্তারদের আকস্মিক আন্দোলনে জিম্মি দশায় ও বিপাকে পড়েন জরুরি চিকিৎসার অপেক্ষায় থাকা অগণিত রোগী এবং তাদের আত্মীয়স্বজনরা। প্রতিদিনই তাদের কষ্ট আর দুর্ভোগ ছিল অবর্ণনীয়। অথচ সংশ্লিষ্ট সরকারী প্রশাসন নির্লিপ্ত থাকে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত নগরীর সবক’টি প্রাইভেট হাসপাতাল ক্লিনিকের মূল গেইটে তালা ঝুলিয়ে রেখে বিএমএ ধর্মঘটের ব্যানার টানানো থাকে। বন্দর নগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে চিকিৎসার উদ্দেশে আসা অসংখ্য রোগী ও স্বজনকে এখানে-সেখানে ঘুরে বিমুখ হয়ে ফিরে যেতে দেখা গেছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা চালু থাকলেও সেখানে রোগীদের উপচেপড়া ভিড়ে এখনো বেসামাল অবস্থা বিরাজ করছে। জরুরি বিভাগে ও আউটডোরে অসংখ্য রোগী ভিড় করতে এবং দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। ওয়ার্ডে বেডে জায়গা না থাকায় মেঝে ও বারান্দায় ঠাঁই নিয়ে কাতরাচ্ছে অনেক রোগী। ইতোমধ্যে ছুটি বাতিল করেও ডাক্তার নার্সরা রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। কেননা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ রোগী চমেক হাসপাতালে ছুটে আসেন।
ব্যাপক সমালোচিত ধর্মঘট
সম্প্রতি হাসপাতালে একজন প্রসূতির মৃত্যু ও অপর এক রোগীর অঙ্গহানির ঘটনায় ৩ জন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার অভিযোগে রোগীর স্বজনদের পক্ষ থেকে আদালতে পৃথক মামলা করা হয়। চট্টগ্রামের বিএমএ নেতৃবৃন্দ বলে আসছেন, এহেন মামলা হয়রানিমূলক ও মানহানিকর। মামলা প্রত্যাহার করে চিকিৎসকদের সামাজিক সম্মান ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তার সাথে ‘সম্মানজনক’ সমাধান দাবি করেন। প্রথমে গত বুধবার ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে ধর্মঘট শুরু করা হয়। তবে চট্টগ্রামবাসী সাধারণ লোকজন ডাক্তারদের এ ধর্মঘটের সমালোচনায় ছিলেন মুখর। তারা বলেছেন, রোগীদের জিম্মি করে এ ধরনের অন্যায়, নির্মম ও অমানবিক আন্দোলন মেনে নেওয়া যায় না। তাছাড়া ডাক্তার কিংবা যেকোনো পেশার লোকই হোক কেউ কী আইনের ঊর্ধ্বে! এ ধর্মঘট কার বিরুদ্ধে? তা কার্যত সাধারণ রোগীদের বিরুদ্ধেই হচ্ছে। এখানে সরকার তো কোনো পক্ষ নয়। আদালতে মামলা করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত রোগীর স্বজন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে আলাপকালে তারা বলেছেন, লাগাতার ধর্মঘটে রোগীদের কষ্ট ও দুর্ভোগের দিকটি প্রথমে মানবিক বিবেচনায় আনা উচিৎ ছিল; কিন্তু তা করা হয়নি। এ প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামে গত বুধবার বিকেল থেকে গতকাল বিকেল অবধি চলে আসা ডাক্তারদের ধর্মঘটের প্রতি চট্টগ্রামের কোনো পেশাজীবী সংগঠন তথা সাধারণ নগরবাসীর এতটুকু সমর্থন মিলেনি বরং এর বিপরীত দেখা গেছে। এরপর বিএমএ পিছুটান দিতে অনেকটা বাধ্য হয়।
যেখান থেকে শুরু
গত ১০ জানুয়ারি নগরীর বেসরকারি হাসপাতাল সার্জিস্কোপে মেহেরুন্নেছা রিমার (২৫) নামে এক প্রসূতির মুত্যুকে কেন্দ্র করে ক্লিনিকে ভাঙচুর এবং গত কয়েকদিন ধরে চট্টগ্রামে চলে আসছিল ক্ষোভ-বিক্ষোভ, মানববন্ধন। মেহেরুন্নেছা চট্টগ্রামের মন্ত্রী (প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী) নুরুল ইসলাম বিএসসি’র ভাতিজি। এ ব্যাপারে চিকিৎসায় অবহেলা/ভুল চিকিৎসার অভিযোগে ডা. শামীমা সিদ্দিকী রোজী ও তার স্বামী ডা. মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে গত ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম মোহাম্মদ ফরিদ আলমের আদালতে অভিযোগ করা হলে আদালত পাঁচলাইশ থানা পুলিশকে তা এজাহার হিসেবে নেওয়ার নির্দেশ দেন। এছাড়া একইদিন নুরুল আবছার নামে এক কিশোরের পেটে ব্যান্ডেজ রাখার অভিযোগে চমেক হাসপাতালের ডা. রানা চৌধুরীর বিরুদ্ধে একই আদালতে ছেলের অঙ্গহানির অভিযোগ এনে মামলা করেন কিশোরের বাবা জেবল হোসেন।
এই তিনজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার প্রতিবাদে গত বুধবার নগরীর সকল বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসা সেবা বন্ধ রাখে চিকিৎসকরা। ধর্মঘট শুরু করে বিএমএ। প্রথমে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়া হলেও পরে বিএমএ নেতারা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলে চট্টগ্রামে চিকিৎসা সেবা ভেঙে পড়ে। এর আগে অপারেশনের পর এক যুবকের শরীরে নিডল রেখে দেওয়ার ঘটনায় ডা. সুরমান আলীর বিরুদ্ধে মামলা করা হলে বিএমএ’র ব্যানারে চিৎিসকরা তাৎক্ষণিক ধর্মঘট করেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোগীদের দুর্ভোগের ৫ দিন পর চট্টগ্রামে ডাক্তার ধর্মঘট স্থগিত ব্যাপক সমালোচনায় বিএমএ’র পিছুটান
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ