পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
মাত্র আট বছর বয়স ছোট্ট মাহির। কথা ছিল সমবয়েসী বন্ধুদের সঙ্গে হেসে-খেলে স্কুলে যাবে। কিন্তু অসহায় ও দারিদ্রতাই শিশুটিকে ঠেলে দিয়েছে অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজে। যদিও এতে দরিদ্র পরিবারের ভাগ্য বদল তো দূরে থাক উল্টো মৃত্যুর পথে যেতে বসেছে শিশুটি। গত ২০ জুলাই নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় মাহি নামের এই শিশুটিকে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা ও শরীরে গরম পানি ঢেলে নির্যাতন চালায় গৃহকর্তা ও তার স্ত্রী। রাত ১২টার দিকে শিশুটির চিৎকার শুনে পূর্ব ইসদাইর এলাকার বাসা থেকে দরজা ভেঙে তাকে উদ্ধার করেন এলাকাবাসী। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধরা গৃহকর্তা আতাউল্লাহ ও তার স্ত্রী উর্মি আক্তারকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে। ফতুল্লা মডেল থানার ওসি মঞ্জুর কাদের জানান, এলাকাবাসী যথাসময়ে শিশুটিকে উদ্ধার না করলে তাকে জীবিত পাওয়া যেত না।
গত ২৭ জুন সকালে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার এলাকায় স্কুলে যাওয়ার পথে ৬ বছরের একটি শিশুকে টেনে ধানক্ষেতে নিয়ে বর্বোরেচিত নির্যাতন চালায় স্থানীয় লম্পট সুভাষ মন্ডল (৪৫)। শিশুটির চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে এলে সুভাষ পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় শিশুর ভ্যানচালক বাবা থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। কিন্তু সুভাষ পলাতক থাকলেও তার স্ত্রী ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে স্বামীর শাস্তি দাবি করেছেন।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় শিশু নির্যাতনের এমন লোমহর্ষক ঘটনা কোন সাধারণ খন্ডচিত্র নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে শিশু নির্যাতন ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিওঅপরাধের তুলনায় শাস্তি পাওয়ার নজির খুবই কম। বিচারহীনতার পাশাপাশিমানুষের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের শিথিলতা ও নৈতিক অবক্ষয় এসব অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে হত্যা, ধর্ষণসহ দেশে বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২ হাজার ৩৩টি শিশু। যা ২০১৭ সালের প্রথম ৬ মাসে ছিল ১ হাজার ৪৯৬টি। ১২ মাসে নির্যাতনের সংখ্যা হচ্ছে ৩ হাজার ৮৪৫টি।
এই হিসেবে গত বছরের তুলনায় এ বছরের প্রথম ৬ মাসে শিশু নির্যাতনের হার বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬ শতাংশ। এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ১ হাজার ৩৬ শিশুর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। এর মধ্যে হত্যার শিকার হয় ২১৬ শিশু, অত্মহত্যা ১৭০, সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৫৮, পানিতে ডুবে ২৩৩ ও অন্যান্য কারণে ৫৯ শিশু মারা গেছে। হত্যার শিকার ২১৬ শিশুর মধ্যে অপহরণের পর হত্যা করা হয় ১৬, হত্যার উদ্যোগ ৫৪, পিতা-মাতার হাতে খুন ৩২, ধর্ষণের পরে খুন হয় ৩৯ ও শারীরিক নির্যাতন করে ২ শিশুকে হত্যা করা হয়।
এদিকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে ৪৭৭টি। এর মধ্যে ৩৫১ শিশুকে ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা ৪৩, যৌন হয়রানি ও ইভটিজিং ৭৭ ও পর্নোগ্রাফির শিকার হয়েছে ৭ শিশু। ধর্ষণের শিকার ৩৫১ শিশুর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয় ৫৩, প্রতিবন্ধী ধর্ষণের ঘটনা ১৪টি ও ধর্ষণের পর ৪০ শিশুকে হত্যা করা হয়। ধর্ষণের চেষ্টা ৪৩ এবং ৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে।
অপহরণের শিকার হয় ৮১ শিশু, নিখোঁজ ১৩৩ ও নিখোঁজ হওয়ার পর উদ্ধার হয় ১০৫ শিশু। অপহরণের পর হত্যা ১৭টি এবং ৬৩ শিশুকে নিখোঁজের পর মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। পরিচয়হীন মৃত নবজাতক উদ্ধার ৩১টি, শারীরিক নির্যাতনের শিকার ৮৩ জন শিশুর মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্যাতনের শিকার হয় ৬৯ জন শিশু। পাচারের শিকার ১৮, এসিড নির্যাতনের শিকার ৪, বাবা-মায়ের নির্যাতনে মৃত্যু ৩২।
এদিকে চলতি মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত হত্যা ধর্ষণসহ সারা দেশে ৩৭৯টি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে মোট ধর্ষণের শিকার হয় ৪৫ শিশু, গণধর্ষণ ৫, প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণ ৩, ধর্ষণের চেষ্টা ৯, এছাড়া মোট হত্যার শিকার ২০টি, আত্মহত্যায় বাধ্য করা হয় ২০, অপহরণ ৬, অপহরণের পর হত্যা ৬, নিখোঁজ ১৬, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৫৭, পানিতে ডুবে ১১০, চিকিৎসা অবহেলায় মৃত্যু ৫, এছাড়া বিভিন্ন ধরণের দুর্ঘটনায় আরও ১৫টি শিশুর মৃত্যু হয়।
একইভাবে ২০১৬ সালে সারাদেশে হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরণের নির্যাতনের শিকার হয় ৩ হাজার ৫৮৯ শিশু। ২০১৫ সালেছিল ৫ হাজার ২১২টি। এছাড়া ২০১৪ সালে ২ হাজার ৪৫১টি শিশু হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরণের নির্যাতনের শিকার হয়। নির্যাতনের শিকার হওয়া এসব শিশুদের মধ্যে কন্যাশিশুর সংখ্যা বেশি হলেও ছেলে শিশুরাও রক্ষা পাচ্ছে না নির্যাতনকারীদের হাত থেকে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ওয়ার্ল্ড ভিশন নামের একটি সংগঠন জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বলেছিল, বিশ্বে দিনে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৬ শিশু শারীরিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে। এ ছাড়া বিশ্বের প্রায় অর্ধেক শিশু বিদ্যালয়ে শারীরিক শাস্তির সম্মুখীন হয়। বাংলাদেশে প্রায় ৮২ শতাংশ শিশু ১৪ বছরের পূর্বেই বিভিন্নভাবে সহিংসতার শিকার হয় এবং ৭৭.০১ শতাংশ শিশু বিদ্যালয়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এছাড়া ৫৭ শতাংশ শিশু কর্মক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুস সহিদ মাহমুদ শিশুদের ওপর নির্যাতনের জন্য সামাজিক অস্থিরতা ও মানুষের মধ্যকার অসুস্থ প্রতিযোগিতাকে দায়ী করেছেন। তিনি দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, শিশু নির্যাতন পুরোপুরি বন্ধ সম্ভব নয়। সারা বিশ্বে শিশু নির্যাতন ঘটছে। তবে আইনের প্রয়োগ, বাবা-মা ও পরিবার এবং সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো গেলে শিশু নির্যাতন হ্রাস পাবে। নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত সমন্বয়ের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ে বিচারকার্য সম্পন্ন ও অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ সম্ভব হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্উলিএইচও) শিশু নির্যাতন এবং শিশুর প্রতি নির্দয় আচরণের ব্যাখ্যায় বলেছে, সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, অবহেলা, বাণিজ্যিক বা অন্য কোনভাবে শোষণ যা শিশুর শারীরিক ও জীবনের হুমকি অথবা এমন আচরণ যা শিশুর বেড়ে উঠা, মর্যাদা, দায়িত্ববোধ, বিশ্বাস তৈরিতে বাধা প্রদান করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এবং প্রিভেনশন (সিডিসি) শিশু নির্যাতন প্রসঙ্গে বলেছে, শব্দ, কথা বা প্রত্যক্ষ কোন কর্ম যা শিশুর প্রতি হুমকি বা ক্ষতির কারণ হয়। এছাড়া বাবা-মা বা অভিবাবকের অবহেলায় কোন শিশুর মৃত্যু, শারীরিক-মানসিক ক্ষতি, যৌন নির্যাতন বা শোষণের শিকার হওয়া শিশু নির্যাতন হিসেবে চিহ্নিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আ. স. ম আমানুল্লাহ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, অনেকে শিশু গৃহকর্মীদের মানুষ মনে করতে চায় না। তাদের সঙ্গে দাসের মতো আচরণ করে। শিশুদের মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন, সামাজিক মূল্যবোধের উন্নয়ন ও নির্যাতনকারীদের আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে অবস্থার উত্তরণ সম্ভব।
এ বিষয়ে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, শিশু নির্যাতনের ঘটনায় কমিশন নিরব নয়। জেলা শহরসহ পুরো দেশে কাজ চলছে। শিশু নির্যাতনের অভিযোগ জানাতে হটলাইন নম্বর (১৬১০৮) চালুর কাজও শেষ পর্যায়ে। আগামী মাসে হটালাইন সেবা উদ্বোধন করা হবে। তখন কোথাও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে এই নম্বরে কল করে জানানো যাবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।