Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চট্টগ্রাম বন্দরে অটোমেশন ব্যবস্থাপনা পূর্ণতা পায়নি - দক্ষ অভিজ্ঞ জনবল সমস্যা

প্রকাশের সময় : ১৭ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শফিউল আলম : চট্টগ্রাম বন্দরে স্বয়ংক্রিয় অত্যাধুনিক ব্যবস্থায় জাহাজ ও কন্টেইনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রম অর্থাৎ কন্টেইনার টার্মিনাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিটিএমএস) পদ্ধতি এখনও পরিপূর্ণ সক্ষমতা অর্জন করেনি। এই অটোমেশন পদ্ধতি বাস্তবায়নের পর নানাবিধ সমস্যার মধ্যদিয়ে তা এগিয়ে চলেছে। সিটিএমএস অটোমেশন বা ডিজিটাল পদ্ধতি সফল ও কার্যকর করার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) এবং বন্দর ব্যবহারকারী স্টেক হোল্ডারদের পর্যাপ্ত দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবলের অভাব রয়েছে। তদুপরি দেশের প্রধান এই সমুদ্র বন্দরে মোট পণ্যের ৬৫ ভাগ রফতানিকারক তৈরিপোশাক শিল্পখাত এখন পর্যন্ত পুরোপুরি সিটিএমএস’র আওতায় বন্দর কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হয়নি। শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য অপরিহার্য গ্যাস, বিদ্যুতের চলমান সংকট এবং সড়ক, রেল ও নৌ-পরিবহনসহ বহুমাত্রিক সমস্যার কারণে সময়মতো রফতানিমুখী চালান বন্দরের ইয়ার্ডে পৌঁছাতেও যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। এ অবস্থায় চার বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও স্বয়ংক্রিয় সিটিএমএস অটোমেশনের মাধ্যমে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম পরিচালনার কাজ অনেকাংশে ব্যাহত হচ্ছে।
বন্দরে জাহাজবহর বিশেষত কন্টেইনার ফিডার জাহাজের নিয়মিত আসা-যাওয়া, কন্টেইনারের অবস্থান, জাহাজেবাহিত পণ্যসামগ্রীর বিবরণ, বিল দাখিল ও পরিশোধ ইত্যাদি কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয় ডিজিটাল অটোমেশন পদ্ধতিতে পরিচালনার জন্য বিগত নভেম্বর’১১ইং থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে সিটিএমএস-এর বহু প্রতীক্ষিত কার্যক্রম শুরু করা হয়। এ ব্যবস্থা প্রচলনের কারণে বন্দরের বহুল আলোচিত ‘টেবিলে টেবিলে ২০ থেকে ২৪টি স্বাক্ষরের ঝামেলার আপাত অবসান হয়েছে। তবে প্রথমেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির অভাবে রফতানিমুখী তৈরিপোশাক শিল্পখাত সিটিএমএস-এ অন্তর্ভুক্ত হয়নি। বন্দর ব্যবহারকারী অন্যান্য ট্রেড বডি ও প্রতিষ্ঠান, সমিতি-সংগঠন সিটিএমএস’র আওতায় চলে এসেছে। তবে তা এখনও পরিপূর্ণতা অর্জন করেনি।
সিটিএমএস প্রবর্তনের আগে বন্দর ব্যবহারকারীদের মনোনীত প্রতিনিধিদেরকে ধারাবাহিকভাবে হাতেকলমে প্রশিক্ষণও দেয়া হয়। সিটিএমএস’র স্বয়ংক্রিয় অটোমেশন ব্যবস্থাপনায় বন্দর কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, দক্ষতা, গতি ও সেবার মান উন্নত করা এবং সময় ও আর্থিক অপচয় অনেকাংশে হ্রাসের টার্গেট রাখা হয়। এর ফলে বন্দরের ধারণক্ষমতা অন্ততপক্ষে ৫০ ভাগ বৃদ্ধিসহ বন্দর সক্ষমতা বৃদ্ধিরও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয় পোর্ট-শিপিং, কাস্টমস সার্কেলে। এ অটোমেশন ব্যবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দরে খরচ সাশ্রয় হচ্ছে বছরে শত কোটি টাকা। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৩শ’ বন্দরে সিটিএমএস পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে সিটিএমএস পদ্ধতি বাস্তবায়িত হলেও এর আওতায় কাজ চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। জেনারেল কার্গো বার্থে (জিসিবি) সিটিএমএস’র মাধ্যমে কাজকর্ম বিঘিœত হচ্ছে অপারেটরদের ন্যূনতম দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাবে। তৈরিপোশাক শিল্পকে এ ক্ষেত্রে এখনও নানামুখী সমস্যা-সংকট আর সীমাবদ্ধতার মধ্যে এগুতে হচ্ছে। এরমধ্যে গ্যাস, বিদ্যুৎ, সড়ক, রেলপথ অবকাঠামো সুবিধাগুলোর ঘাটতি রয়ে গেছে। পণ্যসামগ্রীর চালান রফতানির জন্য নির্দিষ্ট কোন জাহাজ ছাড়ার ২৪ ঘণ্টা আগেই বন্দরে সেই পণ্যের চালান পৌঁছানোর বাধ্যবাধকতার একটি দিক সিটিএমএস’র আওতায় রয়েছে। পোশাকশিল্পের জন্য তা কিছুটা শিথিল করা হয়। কেননা পোশাক সামগ্রীর রফতানিমুখী চালান বন্দরে সময়মতো পৌঁছানে কঠিন হয়ে পড়েছে।
বন্দর-শিপিং সূত্র জানায়, সিটিএমএস অটোমেশন পদ্ধতির পুরাপুরি কার্যকর বা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে বন্দরে জাহাজ থেকে কন্টেইনার লোডিং, আনলোডিং, ইয়ার্ডে কন্টেইনার স্থানান্তর, ট্র্যাকিং, ডেলিভারি পরিবহন, গেট কন্ট্রোলসহ সকল বন্দর কার্যক্রম অনলাইনে বা অটোমেশনে সম্পন্ন করা যাবে। সকল চার্জ ফি মাশুল ডিউজ পরিশোধ, তথ্য-উপাত্তসহ বন্দর অপারেশনাল কার্যক্রম অনলাইন নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে। তবে সিটিএমএস’র আওতায় এমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাবে না যাতে রফতানি কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। এরফলে আমদানি-রফতানি কাজে সহায়ক হয়ে উঠবে অত্যাধুনিক ও স্বয়ংক্রিয় সিটিএমএস পদ্ধতি। চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে প্রধান রফতানি দ্রব্য গার্মেন্টস খাতকে পুরোপুরি সম্পৃক্ত করার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ চুড়ান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে বন্দর সূত্র জানায়।
দেশি-বিদেশি আইটি ও পোর্ট-অটোমেশন বিশেষজ্ঞরা সিটিএমএস’র কারিগরি বিন্যাস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এর প্রায়োগিক দিক, কার্যকারিতা ও অগ্রগতি আগেই তদারক করেন। এর ফলে কর্ণফুলী ও বঙ্গোপসাগর মোহনায় হাজার বছরে গড়ে ওঠা নিরাপদ পোতাশ্রয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় পরিচালিত দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ডিজিটাল অটোমেশন যুগে প্রবেশ করলো। যদিও সিটিএমএস বা অটোমেশন পুরোদমে বাস্তবায়নের উপরই নির্ভর করছে বন্দরের দক্ষতা ও গতিশীলতা অধিকতর বৃদ্ধি এবং তা টেকসই হওয়ার বিষয়টি। বিশ্বের আধুনিক বন্দরসমূহ অটোমেশন বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে উত্তরোত্তর এগিয়ে চলেছে।
চট্টগ্রাম বন্দর সিটিএমএস স্বয়ংক্রিয় অটোমেশন কার্যক্রমে কারিগরি প্রযুক্তি বিন্যাস করেছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক, উত্তর আমেরিকা এবং দেশীয় খ্যাতনামা আইটি ও বন্দর-অটোমেশন বিশেষজ্ঞদল ও কারিগরি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সমন্বিতভাবে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় ৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে সিটিএমএস প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তবে সিটিএমএস অপারেশন পরবর্তী আরও ৫ বছর প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণ পরিচালন কাজে প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারিত হয়েছে। সিঙ্গাপুরভিত্তিক এসটি ইলেকট্রনিক্স, নেভিস এবং কানাডীয় ও দেশীয় অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তথ্য-যোগাযোগ প্রযুক্তি সরবরাহকারী নামিদামি আইটি, বন্দর-অটোমেশনে অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানগুলো সমন্বিতভাবে এ প্রকল্পে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ চালিয়ে আসছে। এ ব্যাপারে ২০১১ সালের মার্চে নির্বাচিত সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে বন্দর কর্তৃপক্ষের কার্যাদেশ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তথ্য-প্রযুক্তি ভা-ারের নিরাপত্তা, কারিগরি বিপর্যয় এবং হ্যাকিংরোধের সম্ভাব্য সকল উপায়গুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয় সিটিএমএস প্রযুক্তি বিন্যাসের সময়ে। বন্দর ভবনে সংরক্ষিত রাখা হচ্ছে দু’টি স্বয়ংসম্পূর্ণ সার্ভার স্টেশন।
কন্টেইনার টার্মিনাল ব্যবস্থাপনায় অটোমেশন পদ্ধতি সিটিএমএস-এর আওতায় চট্টগ্রাম বন্দরের ১১টি কন্টেইনার জেটি-বার্থ অনলাইনে পরিচালিত হচ্ছে। এরমধ্যে অত্যাধুনিক নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালে (এনসিটি) তিনটি, এমপিবি-সিসিটি’তে দু’টি এবং জেনারেল কার্গো বার্থের (জিসিবি) ৬টি। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে বার্ষিক ২০ লাখ ১৫ হাজার টিইইউএস কন্টেইনার এবং দৈনিক গড়ে ৪৫ হাজার টিইইউএস-এরও বেশি আমদানি-রফতানিমুখী কন্টেইনার হ্যান্ডলিং ও ডেলিভারি ব্যবস্থা পরিচালিত হয়ে চলেছে সিটিএমএস পদ্ধতিতে। বন্দরের ১৭টি জেটিতে কন্টেইনার ফিডার জাহাজ হ্যান্ডলিং করা হচ্ছে এ পদ্ধতিতে। বেসরকারি কন্টেইনার ইয়ার্ডগুলোকেও (আইসিডি) অটোমেশনের সাথে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত করা হচ্ছে। যদিও তা পুরোদমে সম্পৃক্ত হয়নি। সিটিএমএস ব্যবস্থায় সুনির্দিষ্ট জাহাজের বার্থিং সিডিউল (ভিড়া) মিলছে অনলাইনে। অটোমেশনে বন্দর কার্যক্রম কিভাবে পরিচালিত হবে এর ধারণা সহকারে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে শিপিং সিএন্ডএফ পরিবহন এজেন্ট, মেইন লাইন অপারেটর (এমএলও), ফিডার বার্থ অপারেটর, অফডক, যান্ত্রিক সরঞ্জাম অপারেটর ও মালিক সংগঠন, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার, শিল্পমালিক, কনসাইনি, আমদানি-রফতানিকারক, ইন্ডেন্টার প্রতিনিধিদের। বন্দরভিত্তিক চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসকে সিটিএমএস প্রকল্পের কাজে সমন্বয় করা হয়েছে। তবে বন্দর-শিপিং সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান বা বন্দর ব্যবহারকারীদের সিটিএমএস অটোমেশনের আওতায় পুরোদমে আনা সম্ভব হলেই দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরের গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। সেই সাথে বন্দর ব্যয় আরও হ্রাস পাবে বলে মনে করেন বন্দর বিশেষজ্ঞরা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম বন্দরে অটোমেশন ব্যবস্থাপনা পূর্ণতা পায়নি - দক্ষ অভিজ্ঞ জনবল সমস্যা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ