Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নীতির অভাবে অন্ধকারে দেশীয় কয়লার ভবিষ্যৎ

প্রকাশের সময় : ১৭ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : কয়লা নীতি আলোর মুখ দেখার সম্ভাবনা ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে। ফলে নীতির অভাবে দেশীয় কয়লা উত্তোলনের ভবিষ্যৎ অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে। অন্যদিকে, আমদানিনির্ভর কয়লায় গড়ে তোলা হচ্ছে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র। অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোন নীতিমালা ছাড়াই বড়পুকুরিয়া থেকে কয়লা তোলা হচ্ছে। তাহলে অন্য খনিগুলোর ক্ষেত্রে কেন নীতিমালাকেই বড় করে দেখা হচ্ছে তা বোধগম্য নয়।
এদিকে, গ্যাস সঙ্কট মোকাবেলায় কয়লা একমাত্র সহজলভ্য বিকল্প জ্বালানি হলেও এই কয়লা উত্তোলন নিয়ে সরকার কোন সিদ্ধান্তে উপণীত হতে পারছে না। শুধু বর্তমান সরকারই নয়; অব্যাহত জ্বালানি সংকটের মধ্যেও কয়লা উত্তোলনে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি আগের তিনটি সরকার। চারদলীয় জোট, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক এবং মহাজোট সরকারের সময় দেশীয় কয়লা উত্তোলনের উদ্যোগ নিয়ে নানা গড়িমসি করে সময় পার করে দেওয়া হয়েছে। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দেশের কয়লা ব্যবহার করে ২০৩০ সালের মধ্যে ১১ হাজার ২২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। একই সময়ের মধ্যে আমদানিকৃত কয়লা দিয়ে সরকারি-বেসরকারি মিলে ৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। দেশে মোট ৫টি খনির মজুদ কয়লা দিয়ে ৫০ বছর পর্যন্ত প্রতিদিন ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। অথচ সরকারের সিদ্ধান্তহীনতায় মাটির নিচেই পড়ে আছে সম্ভাবনাময় এ খনিজসম্পদ। অন্যদিকে, যেহারে গ্যাসের আধার ফুরয়ে আসছে তাতে করে নতুন কোনো ক্ষেত্র আবিষ্কার না হলে ২০১৫ সালের পর দেশে গ্যাস সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
জানা যায়, গত ১০ বছরেরও চূড়ান্ত হয়নি কয়লানীতি। কয়লানীতি প্রণয়নের কাজ ২০০৪ সালে শুরু হলেও নানা অজুহাতে এটি ঝুলিয়ে রেখেছে একটি সুবিধাভোগী মহল। এছাড়াা উন্মুক্ত পদ্ধতি, নাকি আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিং পদ্ধতিতে কয়লা তোলা হবে তা নিয়ে বিতর্ক এখনো শেষ হয়নি। এ প্রসঙ্গে তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, সরকারের মধ্যে এশিয়ান এনার্জির যে লবিং রয়েছে তার জন্য কয়ানীতি প্রণয়ন হচ্ছে না। মূলত বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থরক্ষার জন্যই এটা করছে না সরকার।
বিশ্বে মোট ব্যবহৃত জ্বালানির ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ মেটানো হয় কয়লার মাধ্যমে এবং বিশ্বে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৪১ দশমিক ৫০ শতাংশ উৎপাদন হয় কয়লা থেকে। কাজেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জ্বালানি সংকট নিরসনে কয়লার ভূমিকা গুরুত্ব¡পূর্ণ। ১৯৫৯-২০১৪ পর্যন্ত দেশে শনাক্তকৃত কয়লাবেসিনের সংখ্যা ১৩টি, যার সবই উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া জেলার ভূগর্ভে অবস্থিত। দিনাজপুর জেলার বড়পুকুরিয়া, ফুলবাড়ী ও দীঘিপাড়া, রংপুর জেলার খালাসপীর এবং জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ মিলে মোট পাঁঁচটি কয়লাবেসিনে এ পর্যন্ত নির্নীত কয়লার পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ৩০০ মিলিয়ন টন, যার তাপ উৎপাদনক্ষমতা ৯১ টিসিএফ গ্যাস ব্যবহারের সমান। অর্থাৎ বাংলাদেশে বর্তমানে মজুদ প্রাকৃতিক গ্যাসের (১৫ টিসিএফ) প্রায় ছয় গুণ চাহিদা কয়লা থেকে মেটানো সম্ভব হবে। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত পাঁচটি কয়লাবেসিনের একটা গড় হিসাব এটি।
এছাড়া শনাক্তকৃত আরো আটটি কয়লাবেসিন যেমন দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ, বুড়িরডোবা, শিমনগর ও ডাঙ্গাপাড়া বেসিন, রংপুর জেলার ওসমানপুর ও বদরগঞ্জ বেসিন, নাটোরের সিংড়া বেসিন এবং বগুড়ার কুচমা বেসিন তো রয়েছেই। সব মিলে এটা পরিষ্কার যে, যদি অত্যাধুনিক প্রযুক্ত ব্যবহার করে দেশীয় কয়লা উত্তোলন করা যায়, তাহলে দেশের জ্বালানি সংকটের উত্তরণ ঘটিয়ে স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব। দেশীয় কয়লা উত্তোলনে সরকারের কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা তপন চৌধুরী বলেন, পদ্ধতি যেটাই হোক-সরকারের উচিত দেশীয় কয়লা উত্তোলনে তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। তার মতে, দেশে যে হারে গ্যাসের আধার ফুরিয়ে আসছে এতে করে আগামী দশ বছরের মধ্যে জ্বালানি সঙ্কট প্রকট হবে।
এদিকে, দেশীয় কয়লা উত্তোলন থেকে সরকার কেন পিছিয়ে আসছে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন-সরকার পরীক্ষামূলকভাবে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উত্তরাংশে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করবে। এজন্য ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট মডেল তৈরি করা হচ্ছে। মডেলটি পেয়ে গেলেই কাজ শুরু হবে। তিনি বলেন, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে উত্তোলিত কয়লা দিয়ে ১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে দেশী কয়লা উত্তোলন ও ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই বলে আমি মনে করি। তিনি বলেন, এখন উদ্যোগ নেওয়া হলেও কয়লা উত্তোলনে কমপক্ষে সাত-আট বছর লাগবে। তাই দ্রুততার সঙ্গে উদ্যোগ নেওয়া উচিত। তাছাড়া জ্বালানি সংকট ঘনীভূত হলে আমাদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে। তখন স্বাভাবিকভাবেই ঠিকাদার হিসেবে বাড়তি সুবিধা নেওয়ার সুযোগ পাবে বিদেশি কোম্পানি।
উল্লেখ্য, দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে বড়পুকুরিয়ায় কয়লা উত্তোলন করছে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএমসিএল)। প্রতিষ্ঠানটি দেশের বাকি কয়লাখনিগুলোর দায়িত্ব নিতে ২০১২ সালে চিঠি দিয়েছিল সরকারকে। যদিও সে ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নীতি না থাকলেও কয়লা উত্তোলনে বাধা নেই। বড়পুকুরিয়া থেকে তো নীতি ছাড়াই কয়লা তোলা হচ্ছে। তাহলে অন্য খনিগুলো কেন ফেলে রাখা হয়েছে, এমন প্রশ্নও তারা সরকারের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নীতির অভাবে অন্ধকারে দেশীয় কয়লার ভবিষ্যৎ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ