Inqilab Logo

শুক্রবার, ৩১ মে ২০২৪, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

রিজার্ভ চুরির দোষ বাংলাদেশ ব্যাংকেরই : আরসিবিসি

অর্থ আটকাতে দেয়া বার্তাগুলো স্পষ্ট ও অগ্রাধিকারমূলক ছিল না

প্রকাশের সময় : ১৪ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

অর্থনৈতিক রিপোর্টার : যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই দোষ দিচ্ছে ফিলিপিন্সের রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনে (আরসিবিসি)। গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ৮১ মিলিয়ন ইউএস ডলার চলে যাওয়ার পর ওই অর্থ আটকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক যে বার্তাগুলো পাঠিয়েছিল, তা অস্পষ্ট ছিল দাবি করে রিজল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, এজন্য তারা লেনদেন বন্ধে সময়মতো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। তাদের মতে, বার্তাটি ‘অতি অগ্রাধিকারমূলক ছিল না। বরং কিছু ক্ষেত্রে তা ছিল অস্পষ্ট। অথচ এ চুরির জন্য রিজল ব্যাংককেই দায়ী করে তাদের জরিমানার মাধ্যমে রিজার্ভ চুরির অর্থ উদ্ধারের দাবি জানানো হচ্ছে। একই সঙ্গে তাদেরকে চাপ দেয়ার জন্য বলা হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে আলোচিত রিজার্ভ চুরির এই ঘটনায় গতকাল ফিলিপিন্সের সিনেট ব্লু-রিবন কমিটিতে রিজল ব্যাংকের হেড অব লিগ্যাল অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স মাসেল এস্তাভিল্লো এ দাবি করেন বলে দেশটির সংবাদপত্র সূত্রে জানা গেছে।
এস্তাভিল্লো বলেন, যেহেতু সেখানে সাতশ’রও বেশি বার্তা ছিল এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঠানো  কোনো বার্তাই অতি অগ্রাধিকারের ছিল না, সেগুলো পর্যায়ক্রমে পড়া হচ্ছিলো। শুনানিতে এস্তাভিল্লো বলেছেন, তারা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে ই-মেইলগুলো পেয়েছিলেন, তাতে বিষয়টি যে জরুরি, সে বার্তা ছিল না। এছাড়া ই-মেইলগুলো যে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এসেছিল, সেটাও তারা বুঝতে পারেননি। ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক থেকে সুইফট মেসেজিং সিস্টেম ব্যবহার করে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার লোপাটের বিষয়টি এক দিন পর জানতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সাপ্তাহিক ছুটির দুই দিন পর বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি ওই অর্থ ছাড় না করতে রিজল ব্যাংককে (আরসবিসি) জানানো হয়েছিল বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মামলায় বলা হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে অর্থ রিজল ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যায় বলে ফিলিপিন্সের ব্যাংকটির দাবি। পরে ওই অর্থের অধিকাংশ ক্যাসিনোয় সাদা করে পাচার হয়ে যায় অন্য দেশে।
রিজল ব্যাংকের কর্মকর্তা এস্তাভিল্লো বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়ী করলেও আত্মপক্ষ সমর্থনে তার এ যুক্তি ধোপে টেকে না বলে মনে করেন ফিলিপিন্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (বিএসপি) সুইফট  মেসেজিংয়ের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা নেনিতা কাদাপান। শুনানিতে তিনি বলেন, অধিক গুরুত্বপূর্ণ ফরমেটে না থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের মেইলগুলো গুরুত্ব দিয়েই খোলা উচিত ছিল আরসিবিসির। তিনি বলেন, ফ্রি ফরমেটের বার্তা পাঠানোই ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য ওই সময়ে সবচেয়ে ভালো উপায়, যা তারা করেছে। তার মানে এই নয় যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্তাগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ। (আরসিবিসির) চেক করা উচিত ছিল। ওই কর্মকর্তা বলেন, আরসিবিসির সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের আন্তঃলেনদেন না থাকায় বার্তা সুইফটের জরুরি ক্যাটাগরির এমটি ফরমেটের বার্তা পাঠানো বাংলাদেশ থেকে সম্ভব ছিল না।
এ ঘটনার তদন্তে থাকা ফিলিপিন্স সিনেট কমিটির চেয়ারম্যান এর আগে বলেছিলেন, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কও অর্থ স্থানান্তর না করতে রিজল ব্যাংককে ৮ ফেব্রুয়ারি বার্তা পাঠিয়েছিল। কিন্তু ফিলিপিন্সের বেসরকারি ব্যাংকটি তাতে কর্ণপাত করেনি।
বিশ্বজুড়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অর্থ লেনদেনে সুইফট বা সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
সিনেটে শুনানিতে রিজল ব্যাংকের এস্তাভিল্লো বলেন, ওই অ্যাকাউন্টগুলোর অর্থ লেনদেন বন্ধে ৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রথমে তিনটি বার্তা আসে। তবে তা অস্পষ্ট ও অর্থপূর্ণ ছিল না।
তিনি বলেন, এ তিনটি বার্তা ছিল সুইফট মেসেজিং সিস্টেমে ফ্রি ফরমেট বা এমটি ৯৯৯ কোডের সাধারণ বার্তা। তবে মাইকেল ফ্রান্সিসকো ক্রুজের অ্যাকাউন্টের লেনদেন বন্ধে পাঠানো চতুর্থ বার্তার নির্দেশনা অনেক সরাসরি ছিল। রিজল ব্যাংকের এ নারী কর্মকর্তার দাবি, বার্তাগুলো লেনদেন বন্ধ বা নাকচের জন্য ব্যবহার হওয়া জরুরি ক্যাটাগরির এমটি ১৯২ কোডে পাঠানো হলে আরসিবিসি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারত। এস্তাভিল্লো জানান, তিন দিন ব্যাংক ছুটির পর ৯ ফেব্রুয়ারি আরসিবিসি সুইফট মেসেজিং সিস্টেমে মোট ৭৯০টি বার্তা জমেছিল, তার মধ্যে একটিও এমটি ১৯২ ক্যাটাগরির বা জরুরি ছিল না। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই বার্তাগুলো তাদের কাছে অগ্রাধিকার পায়নি। ওই অ্যকাউন্টের লেনদেন বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঠানো এমটি ৯৯৯  কোডের একটি বার্তা রিজল ব্যাংকের সেটলমেন্ট বিভাগ ৯ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সময় ১১টা ২২ মিনিটে খুলে পড়ে বলে শুনানিতে জানানো হয়।
ওই বার্তায় বলা হয়, দয়া করে জেনে রাখুন এটা একটা সন্দেহপূর্ণ ট্রানজেকশন। আপনাদের অর্থ ছাড় (অ্যাকাউন্ট থেকে) বন্ধের অনুরোধ করা হচ্ছে এবং এর মধ্যেই যদি তা হয়ে থাকে, তাহলে যথাযথ তদন্তের জন্য এ অ্যাকাউন্টের সুবিধাভোগকারীর হিসাব স্থগিত রাখুন। আমরা মনে করি ট্রানজ্যাকশনটি মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ আইনের লঙ্ঘন।
তবে এ বার্তার তিন মিনিট আগে বেলা ১১টা ১৯ মিনিটে অ্যাকাউন্টের পুরো অর্থই একই শাখায় থাকা উইলিয়াম সো গো’র অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর হয়ে যায় বলে শুনানিতে জানান এস্তাভিল্লো।
অর্থ রিজল ব্যাংকের মাকাতি শাখায় প্রায় এক বছর আগে জালিয়াতির মাধ্যমে খোলা চারটি অ্যাকাউন্টে ঢুকেছিল। তারপর সরানো হয় ব্যবসায়ী গো’র নামে তৈরি খোলা পঞ্চম অ্যাকাউন্টটিতে। তবে এ অ্যাকাউন্টটির সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার কথা ইতোমধ্যে অস্বীকার করেছেন গো।
এস্তাভিল্লো বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঠানো প্রায় একই রকম ভাষায় লেখা এনরিকো ‘থিয়োডোর ভাসকুয়েজ’র অ্যাকাউন্টের লেনদেন বন্ধের বার্তাটি তারা ১১টা ২৫ মিনিটে পড়েছিলেন এবং আগেরটির বার্তার মতো এটিও জুপিটার শাখায় পাঠানো হয়।
তবে তার এক মিনিট আগে বেলা ১১টা ২৪ মিনিটে ভাসকুয়েজের অ্যাকাউন্টে যাওয়া ২৫ মিলিয়ন ডলার থেকে ১৫ দশমিক ২১ মিলিয়ন ডলার অন্য একটি অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার হয়ে যায় বলে জানান এস্তাভিলো। আর বাকি ৯ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশের পাঠানো বার্তা পড়ার ৯ মিনিট পর বেলা ১১টা ৩৪ মিনিটে উইলিয়াম গোর কথিত অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার হয়। আর ক্রিস্টোফর লেগ্রোসাস অ্যাকাউন্টের লেনদেন বন্ধে পাঠানো তৃতীয় বার্তাটি পড়া হয় বেলা ১১টা ৩০ মিনিটে। তবে এ অ্যাকাউন্ট থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩টা ১৬ মিনিটে ২২ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার উইলিয়াম গো’র কথিত ওই অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার হয়। বাকি ৭ দশমিক ২৩ মিলিয়ন ডলার ট্রান্সফার হয় বার্তাটি পড়ার পাঁচ মিনিট পর।
এদিকে ‘মাইকেল ফ্রান্সিসকো ক্রুজ’র অ্যাকাউন্টে লেনদেন বন্ধে ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাধারণ ক্যাটাগরির আরও একটি বার্তা পায় আরসিবিসি প্রধান কার্যালয়, যা ওই দিন বেলা ২টা ৪১ মিনিটে পড়া হয়। চুরির অর্থ থেকে ৬ মিলিয়ন ডলার জমা হওয়া এ অ্যাকাউন্টির লেনদেন বন্ধের বার্তাটিকেই আগের বার্তাগুলো থেকে ‘অনেক সরাসরি’ বলে মন্তব্য করেন আরসিবিসির আইন বিষয়ক কর্মকর্তা এস্তাভিলো।
বার্তাটিতে বলা হয়, টপ আর্জেন্ট। দয়া করে জেনে রাখুন এ ট্রানজেকশনটি জালিয়াতির মাধ্যমে আমাদের সুইফট সিস্টেমে প্রবেশের পর করা হয়েছে। তাই অ্যাকাউন্টটির লেনদেন বন্ধে আপনাদের অনুরোধ করা হচ্ছে এবং এরমধ্যেই যদি আপনারা অর্থ পরিশোধ (অ্যাকাউন্টধারীকে) করে থাকেন, তাহলে অ্যাকাউন্টটি স্থগিত রাখুন।
বার্তাগুলোতে অস্পষ্টতার দাবি তুলে ট্রানজেকশন বন্ধে অপারগতার কথা বললেও চার অ্যাকাউন্ট  থেকে প্রথম ট্রানজেকশন হয়েছে বেশিরভাগ অর্থই। একই ব্যাংকে উইলিয়াম গোর নামে খোলা অ্যাকাউন্টে যায়। সেখান থেকেও লেনদেন স্থগিত রাখেনি আরসিবিসি।
এ বিষয়ে আরসিবিসির আইন কর্মকর্তা বলেন, গোর অ্যাকাউন্টি ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট হওয়ায় তা স্থগিত বা অর্থ উত্তোলন বন্ধ করার কোনো ক্ষমতা আরসিবিসির নেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রিজার্ভ চুরির দোষ বাংলাদেশ ব্যাংকেরই : আরসিবিসি
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ