Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাজধানীজুড়ে পানি সঙ্কট

প্রকাশের সময় : ১৩ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সায়ীদ আবদুল মালিক : রাজধানীজুড়ে চলছে ওয়াসার তীব্র পানি সঙ্কট। চৈত্রের শেষে কাঠফাটা তাপদাহে প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত, তখন রাজধানীর অধিকাংশ এলাকাতেই সুপেয় পানির জন্য চলছে হাহাকার। পানির অভাবে নগরবাসীর দৈনন্দিন রান্না, গোসলসহ আনুষঙ্গিক সকল কাজ অনেকটাই থেমে গেছে। সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার পানির জন্য পাম্পে দীর্ঘ লাইন দেয়া হয়। কোন কোন এলাকায় পানি সঙ্কট চলছে গত ১৫ দিন ধরে। আবার অনেক এলাকাতে ওয়াসার যেটুকু পানি পাওয়া যায় তাও দুর্গন্ধযুক্ত এবং ময়লা। এসব পানি পান করে শিশু থেকে বয়স্ক সকলেই পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগির সংখ্যা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াসার এক কর্মকর্তা জানান, সহসা বৃষ্টির দেখা না মিললে এবং খরার তীব্রতা আরও বাড়লে রাজধানীতে ওয়াসার পানি সঙ্কট চরম বিপর্যয় ডেকে আনবে। ইতোমধ্যেই ওয়াসার পানি না পেয়ে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা ও পাম্প অবরোধসহ বিক্ষোভ মিছিল হচ্ছে। কিন্তু এই সঙ্কটের কোন সুরাহা হচ্ছে না। ভুক্তভোগীদের অভিমত, ওয়াসার পানি সঙ্কট নিরসনে অবিলম্বে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। নইলে পানি সঙ্কটকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় নেমে আসবে।
ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান ইনকিলাবকে বলেন, সার্বিকভাবে আমাদের পানির তেমন কোন সমস্যা নেই। গরমের মৌসুমে ঢাকা শহরের মানুষের পানির চাহিদা অন্যসময়ের তুলনায় একটু বেড়ে যায়। যে কারণে বিশাল এ শহরের কোথাও কোথাও সাময়ীক সমস্যা হতে পারে। এটা স্থায়ী সমস্যা নয়। তিনি বলেন, ঢাকা শহরের যেখানেই পানির সমস্যা দেখা দিবে খবর পাওয়ার সাথে সাথে আমরা তার সমাধান করতে প্রস্তুত আছি। তিনি বর্তমান এ সাময়িক সমস্যার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে নগরবাসীর সহযোগিতা কামনা করেন।
রাজধানীবাসীর সুপেয় পানির সঙ্কটসহ বেশকিছু সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ঢাকা ওয়াসা বেশকিছু প্রকল্পের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার ঘোষণা দেয়। এ কর্মসূচির আওতায় নগরীতে দীর্ঘদিনের পুরনো পানির লাইন পুনরায় স্থাপন, নতুন পানির লাইন সংযোজন, বক্স কালভার্ট-ড্রেনেজ লাইনের সংস্কার ও উন্নয়ন এবং খাল পুনরায় খনন করে নগরীর সব জলাধার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। জানা গেছে, ওয়াসার এ কর্মপরিকল্পনাগুলোর বেশিরভাগই এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। তাই এবছরও ওয়াসার পানি সঙ্কট সমাধানের কোন সম্ভাবনা দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।
গত কয়েকদিন ধরে গরমের দাবদাহ যতই বাড়ছে পানির চাহিদাও ততই বাড়ছে। এ অবস্থায় রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকায় সুপেয় পানির সঙ্কট তীব্র আকারে দেখা দিয়েছে। এতে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে জনজীবন।
রাজধানীর মগবাজার বেপারি গলির বাসিন্দা আনিসুজ্জামান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, গত দেড় মাস ধরে বেপারি গলিতে পানির সঙ্কট চলছে। পানির অভাবে খুব কষ্টেই আমাদের দৈনন্দিন জীবন-যাপন করতে হচ্ছে। বেপানি গলির মতো পানির জন্য কলসি, বালতি, গ্যালন ও বোতল নিয়ে বিক্ষোভ করেন মোহাম্মদপুরের নানা এলাকার বাসিন্দারাও। যাত্রাবাড়ী নবীনগর এলাকার বাসিন্দা আহমদ আলী জানান, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী ও নবীনগর এলাকায় ওয়াসার পানিতে ভীষণ দুর্গন্ধ। ওই পানি খাওয়া তো দূরের কথা গোসলও করা যায় না।
গত বেশ কয়েকদিন ধরে পানির জন্য হাহাকার চলছে রাজধানীর মিরপুর, কলাবাগান, লালবাগ, মোহাম্মদপুর এবং পাশ্চিম শেওড়াপাড়া, বাসাবো, মুগদাপাড়া, মান্ডা, মাদারটেক, খিলগাঁও, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, মালিবাগ ও রামপুরা এলাকাবাসী। তাদের এখন একটাই দাবি-গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের এ দুর্ভোগ থেকে পরিত্রাণ। যাতে তারা তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। এসব এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিদ্যুৎ, গ্যাস আর পানির কারণে বেশির ভাগ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নারী, শিশু ও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীদের। বিশেষ করে দুর্ভোগে পড়েছে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত পরিবারের বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষদের।
যাত্রাবাড়ির শনির আখড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ রোহান বলেন, গত পাঁচ দিন ধরে তাদের লাইনে পানি নাই। রোহানের মতো শ্যামপুরের জোরাইন এলাকার পরিবহন শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ দেলোওয়ার হোসেনও জানান, গত সাতদিনধরে পানির সঙ্কটে দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হচ্ছে তার পরিবারকে। লাইনে পানি না থাকার কারণে দোকান থেকে বেশি দামে পানি কিনে দৈনন্দিন কাজ সাতে হচ্ছে। একই অবস্থা রাজধানীর পশ্চিম শেওড়াপাড়া, বাড্ডা, লালবাগ, উত্তরখান, কাওরানবাজার, বাসাবো-সবুজবাগ, খিলগাঁও, মানিকনগর, যাত্রাবাড়ি, ডেমরা, শ্যামপুরসহ বেশ কিছু এলাকায় নাগরিকজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
এদিকে অনেক এলাকায় ওয়াসার পানিতে ময়লা-দুর্গন্ধ থাকায় নিরাপদ পানির জন্য হাহাকার পড়ে গেছে। পানি নিয়ে নগরবাসীর ক্ষোভ ও অভিযোগের শেষ নেই। পানির অভাবে অনেক এলাকায় রান্না থেকে শুরু করে গোসল, বাথরুম কোনোটাই সময়মতো করা যাচ্ছে না। অনেকে অন্য এলাকায় গিয়ে পানি সংগ্রহ করছেন। অনেক এলাকায় পানি থাকলেও তাতে দুর্গন্ধ ও ময়লা থাকায় তা পান করা যাচ্ছে না। এ পানি খেয়ে অনেকে ডায়রিয়াসহ নানাবিধ পেটের পীড়ায় ভুগছেন।
মাদারটেকের বাসিন্দা রহিমা বেগম বলেন, বাসার পানিতে লাল রং আর ছোট ছোট ময়লা আসে। পানির এ দুর্গন্ধের কারণে এরপর তাই টাকার বিনিময়ে গৃহকর্মীকে দিয়ে পানি টেনে আনতে হচ্ছে কলসি বা কন্টেইনারে ভরে বাসাবো বৌদ্ধ মন্দির থেকে।
বাসাবো বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে দেখা যায়, দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষের পাশে লাইন ধরে সারি করে রাখা হয়েছে পানি বহনের সরঞ্জামাদি যেমন, ড্রাম, কলসি, বোতল, জার প্রভৃতি। এখানে পানি নিতে আসা অনেকেই মন্তব্য করেন, সায়েদাবাদ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের কারণে পানির এ দুর্গন্ধময় অবস্থা। যাত্রাবাড়ী থেকে পানি নিতে আসা রাইসা বেগম জানান, পানি তো কলে থাকেই না। যেটুকুই বা থাকে তাতে ছোট ছোট নুড়ি, বালুর সঙ্গে দুর্গন্ধ। তা দিয়ে কোনোরকমে গোসল সারতে হয়। কিন্তু খাওয়া আর রান্নার জন্যই মূলত এখান থেকে পানি নেওয়া। আবার স্থানীয় মসজিদ থেকেও ঢাকা ওয়াসার পাইপ থেকে পানি সংগ্রহ করেন বলে জানান মুগদার লোকজন।
খিলগাঁওয়ের অধিবাসী সায়েমা বেগম জানান, তিনি একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। সকাল আটটার মধ্যে তাঁকে বাসা থেকে বের হতে হয়। তাই সকালের মধ্যে তাকে রান্না করতে হয়। কিন্তু পানির দুর্গন্ধের কারণে সেই পানি দিয়ে রান্না করা যায় না। অনেক কষ্টে একটা কাজের বুয়াকে টাকার বিনিময়ে বৌদ্ধ মন্দির থেকে পানি আনিয়ে রাখেন কন্টেইনার কিংবা কলসিতে। আর গোসলের জন্য পানি ছাকনি দিয়ে ছেঁকে নেন।
ঢাকা ওয়াসা’র পানি সরবরাহ বিষয়ে জানা গেছে, প্রতি বছর মার্চ থেকে মে মাস শুষ্ক মৌসুমে ওয়াসার পানি নিয়ে সঙ্কট দেখা দেয়। বর্তমানে ঢাকা ওয়াসা ৫৯৯টি গভীর নলকূপ ও ৪টি পানি শোধনাগারের মাধ্যমে দৈনিক ২১৫ থেকে ২৩৫ কোটি লিটার চাহিদার বিপরীতে গড়ে ২১৪ থেকে থেকে ২২৪ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করছে। ওয়াসা ৯৯টি গভীর নলকূপ স্থাপন এবং ১৩২টি নলকূপ প্রতিস্থাপন করেছে। এর ফলে গত ৪ বছরে পানির উৎপাদন দৈনিক ৩৪ কোটি লিটার বেড়েছে। গত ৪ বছরে ঢাকা ওয়াসার সিস্টেম লস ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৯ দশমিক ৫ শতাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
লোডশেডিংয়ের কথা বিবেচনায় রেখে সে সময় পাম্প চালু রাখতে গত বছর থেকেই ২২০টি জেনারেটর সংগ্রহ করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে ২০০ টি ফিক্সড এবং ২০টি মোবাইল জেনারেটর। বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার মোট জেনারেটরের সংখ্যা ৪৯৩টি। লোডশেডিং এর সময় বিদ্যুৎ দ্বারা পাম্প চালানোর জন্য ২০৪টি পাম্পে ২টি ফিডার হতে বিদ্যুৎ সংযোগ অর্থাৎ দ্বৈত সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। ১০টি পানির গাড়ি ও ৫টি ট্রাক্টর কেনা হয়েছে। ১৭৮ দশমিক ৫০ কিলোমিটার পানির লাইন স্থাপন করা হয়েছে ও ১৫৪ কিলোমিটার লাইন পুনর্বাসন করা হয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাজধানীজুড়ে পানি সঙ্কট
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ