পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
ইনকিলাব রিপোর্ট : মানচিত্র দেখলেই বোঝা যায় বাংলাদেশ নদীমার্তৃক। ভারতের ফারাক্কা ও গজল ডোবার বাঁধ ছাড়াও উজানে তৈরি করা ৪০টি ড্যাম ও ব্যারাজ পানির গতি পরিবর্তন করায় পানির অভাবে ছায়ার মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নদী হারিয়ে যাচ্ছে। নদী ‘হারানোয়’ প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। বদলে যাচ্ছে দেশের ভূ-প্রকৃতির চিত্র। জটাধারী শিল্পী পথিক নবীর ‘ওইখানে এক নদী ছিল/ জানলো না তো কেউ’ গানের বাস্তব চিত্র যেন দেশের গ্রামবাংলার মানুষের জীবনে দীপ্যমান। দেশের ক্ষমতালোভেী নেতানেত্রীদের দিল্লি তোষণনীতির প্রতিদান বন্ধুপ্রতিম ভারত দিচ্ছে ১৬ কোটি মানুষকে ‘পানিতে মেরে’। এই চৈত্রের দাবদাহে ‘যে নদী মরুপথে’ উপন্যাসের মতোই টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়ার গ্রামবাংলার নদী এখন ধু-ধু বালুচর।
ঔপনিবেশিক আমলে বাংলাদেশে নদীর (উপনদী-শাখা নদীসহ) সংখ্যা ছিল এক হাজারের ওপরে। বিশেষজ্ঞদের মতে ষাটের দশকে সাড়ে সাতশ’ নদী ছিল বাংলাদেশে। বর্তমানে এ সংখ্যা কমে মাত্র ২৩০টিতে দাঁড়িয়েছে। ৫০ বছরে হারিয়ে গেছে ৫২০টি নদী। বর্তমানের ২৩০ নদীর মধ্যে ৫৯টি আন্তর্জাতিক। এগুলোর মধ্যে ৫৪টি ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আদি যুগে সহজ যোগাযোগের কারণেই নদীতীরে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। বাংলাদেশে সত্তরের দশকেও নদীপথে পণ্য পরিবহন হতো বেশি। আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে ভারতের বাঁধের মাধ্যমে পানিপ্রবাহ অন্যদিকে নেয়ায় এই চার দশকে ১৬ হাজার কিলোমিটার নদীপথ কমে গেছে। সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা ইনকিলাবের প্রতিনিধিরা পানির অভাবে হারিয়ে যাওয়া নদীর চিত্র তুলে ধরেছেন।
রেজাউল করিম রাজু রাজশাহীর নদীর চিত্র তুলে ধরে লিখেছেন, বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে প্রতিবেশী দেশ ভারতের পানি জল্লাদদের রোষানলে বিভিন্ন ড্যাম-ব্যারাজের খড়গের নিচে পড়ে এদেশের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের স্বপ্নময় নদীগুলো আজ দুঃস্বপ্নের হাহাকারে বিদীর্ণ। কৃষি, মৎস্য, যোগাযোগ, জীববৈচিত্র্য আর সবুজতা হারিয়ে গেছে বিশাল বালিচরে। স্বাধীনতার আগে নৌপথ ছিল ২৮ হাজার কিলোমিটার। আর এখন এসে ঠেকেছে সাড়ে তিন হাজারে। নদনদী মরে যাওয়ার সাথে সাথে নৌপথ বন্ধ হওয়ায় মাঝিমাল্লারা কাজ হারিয়েছে। অর্ধশত প্রজাতির মাছ হারিয়েছে তার অস্তিত্ব। আর জেলেরা বদল করেছে তাদের পেশা। নদীর সরকারি হিসেবে সাতশ হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসেবে নদনদীর সংখ্যা চারশ পাঁচটি। যদিও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ আবু হানিফ শেখ ও বিশিষ্ট নদী গবেষক মাহবুব্ সিদ্দিকীর মতে এর সংখ্যা হাজারেরও বেশি। দেশের নদীগুলোর মধ্যে সারা বছর কম-বেশি পানি থাকে একশোর মতো নদীতে। উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে এমন নদনদী পাওয়া গেছে যা বইপত্র বা মানচিত্রেও নেই। ভারতীয় আঁটোসাঁটো পানি আগ্রাসী নীতি দেশটাকে ঠেলে দিয়েছে মরুময়তা ও বিপর্যয়ের দিকে। বাংলাদেশ ভারত আন্তঃসীমান্ত অভিন্ন নদনদীর সংখ্যা ৫৪টি বলে উল্লেখ করা হয়। তবে বিশিষ্ট নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকীর মতে প্রকৃত সংখ্যা ৯৭টি। সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করলে এ সংখ্যা আরো বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও অনেক নদীর ¯্রােতধারা আগের মতো নেই। তবে বর্ষাকালে প্রবাহ লক্ষ করা যায়। আরো ৪৩টি নদীর নাম ও পরিচয় পাওয়া গেছে, যা যৌথ নদী কমিশনের তালিকায় নেই। উত্তরাঞ্চলের এমন সতেরটি নদী হলো, ঠাকুরগাঁওয়ের নোনা, পঞ্চগড়ের যমুনা, বেরং, ডেরসা, চাওয়াই, কুরুম, পাংগা, দিনাজপুরের রাক্ষুসিনী, তেঁতুলিয়া, লালমনিরহাটের সিমলাজান, সিংগামারি, গিদারী, মালাতাহা, কুড়িগ্রামের শিয়ালদহ, গঙ্গাধর, ফুলকুমার, দিনাজপুরের চিরি, নওগার খুকসি। বাকিগুলো দেশের অন্য অঞ্চলে রয়েছে। ভারত সকল নীতিরীতি উপেক্ষা করে অভিন্ন নদীগুলোর ওপর একতরফাভাবে অসংখ্য ড্যাম-ব্যারাজ নির্মাণ করে নদনদীগুলোর দফা রফা করে ফেলেছে। নদীগুলোয় বর্ষার সময় কিছু পানি থাকলেও প্রায় সারা বছর থাকে শুকনো। অনেক খর¯্রােতা নদী নর্দমার নাম নিয়ে বেঁচে আছে। কিন্তু আছে বইয়ের পাতায় আর মানচিত্রে। নদীর বুকে নৌকা নয় চলে চাষাবাদ। বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার সাথে সাথে শুরু হয় চাষাবাদের। উত্তরের দেড় হাজারের বেশি বিলের মধ্যে হাজারখানেক বিলই অস্তিত্ব সংকটে। নদী ও বিলের কিছু অংশজুড়ে আবাদ হয় ধানসহ বিভিন্ন ফসলের। এতে আবাদি জমি বাড়ার সাময়িক প্রাপ্ত আর ফসল পেলেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব মারাত্মক হয়ে উঠেছে। ভারত ফারাক্কা ব্যারাজ ছাড়াও আরো বেশকটি নদীতে বাঁধ দিয়েছে Ñ তিস্তা, করতোয়া, মহানন্দা, আত্রাই ও ধরলা। ফারাক্কা দিয়ে যেমন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আর গজলডোবা ব্যারাজ দিয়ে উত্তরাঞ্চলের নদনদী-খালবিলগুলোর অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দিয়েছে। বরাক নদীর টিপাই মুখে বাঁধ দিয়ে সুরমা খুসিয়ারা নদীসহ মেঘনা নদের অববাহিকা ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে যাচ্ছে। দৈনিক ইনকিলাবের আঞ্চলিক প্রধান ও প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন পানি আগ্রাসনের বিরূপ প্রভাবের যে খ- চিত্র উঠে এসেছে তাতে শিউরে উঠতে হয়। আমাদের জীবনে নেমে আসছে অজানা এক বীভৎস ভবিষ্যৎ।
বাংলাদেশ কিংবা ভারতে নদনদীবিষয়ক সবচেয়ে বেশি আলোচিত নামটি নিঃসন্দেহে ভারতে গঙ্গা আর বাংলাদেশে পদ্মা। হিমালয় পর্বতমালার গাঙ্গোত্রী নামক হিমবাহ থেকে যাত্রা শুরু করে ভারত অংশে গঙ্গা আর বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের মনোহরপুর গ্রামের পাশ দিয়ে রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ি জেলা পেরিয়ে উত্তর দিক থেকে আসা যমুনাকে গোয়ালন্দ নামক স্থানে ধারণ করে চাঁদপুরের মোহনায় মিলিত হয়েছে পদ্মা নাম নিয়ে। চাঁপাই থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত যার দৈর্ঘ্য প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার। এ দীর্ঘ পথচলা পদ্মার রয়েছে একটি উপনদী মহানন্দা আর অসংখ্য শাখা-প্রশাখা নদনদী। নদী বিশেষজ্ঞদের মতে যার সংখ্যা ষাটটিরও বেশি। অবশ্য অধিকাংশ এখন বিলুপ্ত। ভারতের আগ্রাসী পানিনীতি আর এ অঞ্চলের মানুষের কাছে মরণবাঁধ হিসাবে খ্যাত ‘ফারাক্কা ব্যারাজ’ বিগত সাড়ে চার দশকে পদ্মা ও তার শাখা-প্রশাখাগুলোর দফা রফা করে ছেড়েছে। একসময়ের অন্যতম নদী হিসাবে পরিচিত পদ্মা এখন বিশাল বালিচরের নিচে চাপা পড়ে হাহাকার করছে। দেখলে মনে হয় নদী নয় যেন নদীর জীবাশ্ম ফসিল। একসময়ের চঞ্চলা যৌবনা আর দুরন্ত হয়ে ছুটে চলা পদ্মা এখন মরা নদীর নাম। শাখা-প্রশাখা নদী বড়াল, মরা বড়াল, নারদ, মুছাখান, ইছামতি, ধলাই, হুড়াসাগর, চিকনাই, গড়াই, মাথাভাঙ্গা, ভৈরব, নবগঙ্গা, চিত্রা, বেতা কালিকুমার, হরিহর, কালিগঙ্গা, কাজল, হিসনা, সাগরখালি, চন্দনা, কপোতাক্ষ, বেলাবত এদের অস্বীত্ব প্রায় বিলীন। বর্ষার সময় কিছু পানি থাকলেও সারা বছর থাকে শুকনো। নৌকা নয় চলে চাষাবাদ। এসব নদীর নাম মানচিত্র আর কিছু বইয়ের পাতায় অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। এক সময়ের খর¯্রােতা নদীটি এখন নর্দমার নাম নিয়ে বেঁচে আছে। ফারাক্কা ছাড়াও আরো বেশকটি নদীতে ভারত বাঁধ দিয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে তিস্তা, মহানন্দা,করতোয়া, আত্রাই ও ধরলা। এসব নদীতে বাঁধ দেবার ফলে এসব নদী ছাড়াও এর শাখা উপশাখা নদীগুলো অস্তিত্ব হারানোর পথে। যেমন পুনর্ভবা, টাঙ্গন, চাওয়াই, নাগর, চিলফা, টেপা, ডাহুক, ভেরসা, পাথরাজ, তিরনাই, সিনুয়া, হাতুড়ির অস্তিত্ব বিলুপ্তির পথে। ভারতের পানি আগ্রাসী নীতি শুধু এ অঞ্চলের নদনদীগুলোকে শুকিয়ে মারেনি। যার প্রভাব পড়েছে এসব নদীর সাথে সংযুক্ত খাল বিলে। এসব শুকিয়ে গেছে। এ অঞ্চলের বিখ্যাত বিল যার বিস্তীর্ণ জলরাশি দেখে বোঝার উপায় ছিলনা এটা বিল না নদী। নদী গবেষকদের মতে চলন বিল নদী। চলনবিলের আয়তন এক হাজার অষ্টআশি বর্গকিলোমিটার হলেও বেঁচে আছে তিনশত আষট্ট্ িবর্গকিলোমিটার। বিল হালতি, বিল হিলনা, মহানগর, বিলভাতিয়া, উথরাইল, খিবির বিল, চাতরা, মান্দার বিল, বিলকুমলী, পাতি খোলা, অঙ্গরা, চাঙ্গা, দিকমী, পারুল, সতী, মালসী, ছোনী, বাঘনদী, পিয়ারুল, মিরাট, রক্তদহ, কুমারীদহ, খুকসী, জবায়ের, বাঁধ বাড়িয়া গ্রামের বিল আর দহ হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি থেকে। নদনদী-খালবিলগুলোয় এখন বর্ষা মৌসুমে পানি জানান দেয় তাদের অস্তিত্বের কথা। ভারত তার পানি আগ্রাসী নীতিতে গঙ্গায় ফারাক্কা ব্যারাজ দিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিবেশের মহাবিপর্যয় ডেকে এনে ক্ষান্ত হয়নি। ভারত সীমান্তের ওপারে তিস্তা নদীর ওপারে গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণ করে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে পুরো উত্তারঞ্চলে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। এক সময়ের খর¯্রােতা তিস্তা নদীও পদ্মার পরিণতি লাভ করেছে। ফারাক্কা ব্যারাজের কারণে কুষ্টিয়া যেমন গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। তেমনি গজলডোবা ব্যারাজের কারণে তিস্তার ১২৫ কিলোমিটারজুড়ে এখন পানির বদলে বালির উত্তাপ। তিস্তাসহ এ অঞ্চলের ধরলা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, আলিয়া দুধকুমার, বুড়ি, তিস্তাসহ ৩৫টি ছোট বড় নদ নদী অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। উত্তরের নীলফামারী রংপুর গাইবান্দা বগুড়া জয়পুরহাট জেলার ৩৫ উপজেলায় সাড়ে তের লাখ একর জমিতে চাষাবাদের জন্য সেচ ব্যাবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে নির্মিত দৃষ্টি নন্দন তিস্তা ব্যারাজ পানির অভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
পদ্মা তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টন ব্যবস্থা নিয়ে ভারতের দাদাগিরির নিচে চাপা পড়ে আর্তনাদ করছে নদনদীগুলো।
বগুড়া থেকে মহসিন রাজু জানান, ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশমুখে পানি প্রত্যাহার, সেই সাথে দখল ও দূষণের কবলে পড়ে বগুড়ার সবকটি নদনদী এখন মৃত্যুযন্ত্রণায় ধুঁকছে, এখনও কেবল নামেই কিছু নদনদী তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখলেও যে কোনো সময় এগুলো অস্তিত্বহীন হয়ে কেবলই ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেবে বলে প্রকৃতিপ্রেমিকদের অভিমত।
বৈশাখের এই আগেভাগে এবং চৈত্রের শেষ প্রান্তিকে বগুড়ার উল্লেখযোগ্য নদনদীগুলোর মধ্যে নাগর নদ, করতোয়া ও গাংনৈ নদী পুরোপুরি পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। করতোয়া ও গাংনৈ নদী এবং নাগর নদীর বুকজুড়ে যেদিকেই চোখ যাবে দেখা সবুজ বোরো ধানের ক্ষেতে আন্দোলিত হচ্ছে বাতাসের ঢেউ। বগুড়া শহরের বুক চিরে প্রবাহিত ঐতিহাসিক করতোয়া নদীটির প্রবেশ মুখেই পঞ্চগড়ের কাছে ভারতীয় অংশে পানি প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর পরে ঠাকুরগাঁও ভায়া গাইবান্ধা হয়ে গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালি পয়েন্টে দেশের ভেতরেই পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ একটি মিনি ফারাক্কা ব্যারাজ তৈরি করে পানি প্রত্যাহার করে সেই পানি বাঙ্গালী নদীতে প্রত্যাহার করায় একটি মরাখাল হিসেবে নদীটি বগুড়া শহরে প্রবেশ করেছে। উত্তরে মোকামতলা হয়ে বগুড়ায় প্রবেশ করে দক্ষিণে চান্দাই কোনা দিয়ে বগুড়া থেকে বের হয়ে যাওয়ার এই দীর্ঘ অঞ্চলে জমির দাম উত্তরাঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হওয়ায় প্রভাবশালীরা এই নদীটিকে দখলদার হিসেবে গ্রাস করেছে বেশি। বর্ষাকালে এই করতোয়া নদীতে এখনও উপচেপড়া পানি প্রবাহ থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে করতোয়া যেন কেবলই একটি ফসলি ধানি জমির উর্বর ক্ষেত মাত্র!
বগুড়ার পূর্বাঞ্চলের যমুনা, বাঙ্গালী, মানাষ কিংবা হুড়া সাগর কিংবা ফুলজোড় নদীগুলো বালুচর বালিয়াড়িতে পরিণত হয়েছে। অথচ একসময় এই নদীপথেই মংলা ও খুলনা অঞ্চল থেকে নিয়মিতভাবে শুকনো মৌসুমেও বড় বড় জাহাজ নারিকেল, শুঁটকি, সামুদ্রিক মাছ ও বিদেশী পণ্য নিয়ে বগুড়ায় আসতো ছোট-বড় অসংখ্য সওদাগরি নৌকা। ফেরতের সময় এরা নিয়ে যেত বগুড়ার সুগন্ধী আতপ ও পাইজাম চালের বস্তা। অথচ এই প্রজন্মের কাছে এসব এখন কেবলই রূপকথার রূপকল্প বলে মনে হয় বলে মন্তব্য প্রবীণ নাগরিকদের।
দিনাজপুর থেকে মাহফুজুল হক আনার জানান, প্রচ- তাপদাহে রংপুর বিভাগের ৮টি জেলা জ্বলছে। পুকুর খাল বিল সবকিছু শুকিয়ে গেছে। ভারত কর্তৃক নদীর পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের কারণে এ অঞ্চলের তিস্তা, মহানন্দা, আত্রাই, পুনর্ভবা, করতোয়াসহ সব বড় নদী পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। খরস্রোতা এসব নদী এখন খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। ছোট ছোট শাখা নদীগুলির অস্তিত্বই চোখে পড়ছে না। এদিকে চৈত্রের শেষপ্রান্তে প্রচ- তাপদাহে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়েছে। আবহাওয়া এতটাই বৈরী হয়ে পড়েছে যে, দিনের বেলা সূর্যের প্রখর তাপে মাটি থেকে যেন বাষ্প উঠছে। অনাবৃষ্টি আর প্রচ- খরার কারণে এ অঞ্চলের অন্যতম অর্থনৈতিক ফসল ইরি-বোরো আবাদ রক্ষায় সেচ খরচসহ সামগ্রিক খরচ বহুলাংশে বেড়ে গেছে। নদনদী-খালবিল পানিশূন্য হয়ে পড়ায় মাছের আকাল দেখা দিয়েছে।
দিনাজপুরের পুনর্ভবা, আত্রাই, নীলফামারী’র তিস্তা, পঞ্চগড়ের মহানন্দা, বগুড়া’র করতোয়া, ঢেপা, গর্ভেশ্বরী, তুলাই, কাঁকড়া, ইছামতি, ছোট যমুনা, তুলসীঙ্গা, টাঙ্গনসহ অসংখ্য নদী রয়েছে। এসকল নদীগুলোর অধিকাংশরই উৎসস্থল হিমালয় পর্বত থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশ। বর্ষাকালে এসকল নদী ফুলে ফেঁপে এ অঞ্চলের মানুষের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দিনাজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, দিনাজপুরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৯ট নদীর দৈর্ঘ্য ৭২৮ কিলোমিটার। যার একটিতেও পানি প্রবাহ নেই। পানিপ্রবাহ না থাকার অন্যতম কারণ হচ্ছে উজানে ভারত সরকার বিভিন্ন উপায়ে নদী শাসন করা। এ ছাড়া নদীগুলোর খননকাজ না করায় দিন দিন ভরাট হয়ে যাওয়া পানি প্রবাহের গতি-প্রকৃতির বদলে যাচ্ছে। নদীগুলোর নাব্যতা হারানোর কারণে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিতে নদী ভরাট হয়ে দুই কূলের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়। এতে প্রায় দেড় লাখ জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায়। মৎস্যজীবী সুরুজ মিয়া জানান, নদীগুলো ঘিরে প্রায় দিনাজপুরের ২৫ হাজার পরিবার জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে। নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় মাছ শিকার কমে গেছে। বেকার হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মৎস্যজীবী। নদ-নদী ও খাল বিলে পানি না থাকায় কৃষকদের সম্পূর্ণরূপে সেচের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। দিনাজপুরের দক্ষিণাংশের মাশিমপুর, খানপুর, পঞ্চগড় ও নীলফামারীর বিভিন্ন এলাকায় পানির স্তর নেমে যাওয়ায় ৮ থেকে ১০ ফুট গর্ত করে শ্যালো মেশিন বসিয়ে পানি তুলে সেচ দিতে হচ্ছে কৃষকদের। স্বাভাবিকভাবেই এতে কষ্ট এবং খরচ দুই বেড়ে যাচ্ছে। একদিকে পানি শুন্যতা অপরদিকে বৈরী আবহাওয়া পরিবেশকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।
সিলেট থেকে ফয়সাল আমীন ও খলিলুর রহমান জানান, নদীমাতৃক দেশে বাংলাদেশে। আর সুরমা-কুশিয়ার এলাকায় সিলেট। প্রায় শতাধিক নদীই সুরমা-কুশিয়ার মিলিত হয়েছে। কিন্তু ওইসব নদীগুলো আজ অস্থিত সংকটে পড়েছে। নদীগুলো উজানে বাঁধ, নদীর পাশে কল-কারখানা গড়ে উঠা, ময়লা-আবর্জনা, অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন, দখল-দূষণ, পাহাড় টিলা কাটার কারণে নদীগুলো অস্থিত সংকটে পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, সিলেট বিভাগে প্রায় শতাধিক নদনদী ছিল। অনেক নদীই ভারত থেকে এসেছে, যা আন্তঃসীমান্ত নদী নামে পরিচিত। আর সিলেটের সকল নদীই সুরমা ও কুশিয়ারায় মিলিত হয়েছে। তবে অধিকাংশ নদীই বর্তমানে অস্থিত সংকটে রয়েছে। বিশেষ করে সিলেটের সুরমা, কুশিয়ারা, খোয়াই, মনু, দাড়াইন, কালনী, পিয়াইন, সারি, গোয়াইন, সোনাই, ধলাই, জুড়ি, সুতাং নদীর নাব্যতা হারিয়ে অস্থিত সংকটে পড়েছে। এগুলোর মধ্যে হবিগঞ্জের সুতাং, সোনাই নদীর পাশে মিলকারখানা গড়ে উঠেছে। এর ফলে ওই এলাকার নদীগুলো অস্থিত সংকটে রয়েছে। নদী রক্ষার জন্য ওই এলাকায় সাধারণ মানুষ আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও সিলেটের অধিকাংশ নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করা হয়েচ্ছে। এ কারণে কোন কোন জায়গায় নদী ভরাট, আবার কোন কোন জয়াগায় নদীভাঙনের সৃষ্টি হচ্ছে। শুধু বালু উত্তোলনই নয়, সারি, মনু, খোয়াই, ধলাই, ডাউটি, পিয়াইন নদীর উজানে ভারত সরকার বাঁধ দেয়ার ফলে ওইসব নদী অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। সিলেট ও ভারতের মেঘালয় রাজ্যে পাহাড় থেকে গাছ কাটা ও কয়লা উত্তোলনের প্রভাবও নদীগুলোর উপর পড়ছে। পাহাড়-টিলাগুলো থেকে গাছ কাটার কারণে সৃষ্টি হলেও ওইসব টিলা থেকে বালু নেমে ছাড়া হয়ে নদীগুলোতে পড়ছে। এতে নদীগুলো তলদেশ ভরাট হচ্ছে। এতে শুকনা মৌসুমে নদীগুলোতে বড় বড় চর জেগে উঠে। নদী তীরবর্তী এলাকায় বাসিন্দারা জানান, নাব্যতার কারণে সিলেট অঞ্চলের নদীগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে পানি কম থাকায় অনেক এলাকায় নৌচলাচলের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এক দশক আগেও যেসব রুটে নৌকা দিয়ে মানুষ যাতায়াত করত, সেসব রাস্তাও একের পর এক বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া নদীর পানি কমে যাওয়ায় কৃষিক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পানির অভাবে সঠিক প্রজনন ক্ষেত্রের অভাবে হাওর এবং নদীর মাছও ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার কটারকোনা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব বাসিন্দা সমুজ আলী জানান, ১০-১৫ বছর ধরে মনু নদীর পানি শুকাচ্ছে। নদীর কোনো কোনো জায়গায় চর জেগে ওই এলাকা পুরো শুষ্ক মৌসুম পানিশূন্য থাকে। একই ধরনের মতামত ব্যক্ত করেন অন্যান্য নদীতীরবর্তী বাসিন্দারা জানান, নদীগুলোর গভীরতা অর্ধেকের বেশি কমে গেছে। এ জন্য মানুষকে শুষ্ক মৌসুমে পানিসংকটের পাশাপাশি বর্ষা মৌসুমে অতি বন্যার মুখোমুখি হতে হয়। এছাড়াও দখল আর দূষনে বিপর্যস্ত সিলেটের সুরমা নদী। কারণ সিলেট নগরীর পুরো ময়লা আবর্জানাগুলো সুরমা নদীতেই পড়ে। তাই সিলেট মহানগরীর বুক দিয়ে বয়ে যাওয়া ওই নদী এখন ময়লা আবর্জনা পাহাড়ে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার লাফাজ সুরমা সিমেন্ট কারখানার বর্জ্যগুলোও সুরমা নদীতে পড়ে। এতেও সুরমার অস্থিত বিলিন হচ্ছে। সিলেট অঞ্চলের নদীগুলো সম্পর্কে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট শাখার সাধারন সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, সিলেটের নদীগুলোর উজানে ভারত একতরফাভাবে বাঁধ নির্মাণের কারণে দিন দিন নদীগুলো পানি প্রবাহ কমছে। বিশেষ করে শুকনা মৌসুমে নদীগুলোতে একেবারেই পানি কমে যায়। এছাড়াও সিলেটে বিভিন্নভাবে নদী দখল ও দূষণ করার মাধ্যমে নদীগুলোকে বিপর্যস্ত করা হচ্ছে। ফলে সামগ্রিকভাবে সিলেট বিভাগের নদনদীগুলোর অবস্থা ভালো নেই বলে জানান তিনি। সারি বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আবদুল হাই আল হাদী জানান, সারি নদী উজানে ভারত সরকার বাঁধ দেয়ার ফলে ওই নদীতে পানি প্রবাহ কমেছে। স্থানী লোকজন আন্দোলন সংগ্রাম করেও সারি নদীর উজানে বাঁধ ভঙ্গ করতে পারেনি।
রংপুরের গঙ্গাচড়া থেকে ইনামুল হক মাজেদী জানান, রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তা নদীর চরে এখন শিশুদের খেলার মাঠ। এছাড়াও নদীর মাঝ দিয়ে হেঁটে চলছে মানুষ, চলছে মালবাহী গরু, মহিষ ও ঘোড়ার গাড়ী। পানি না থাকায় জেগে উঠেছে ধু-ধু বালুর চর। দেখে মনে হয় এটা প্রমত্তা তিস্তা নয়, কোন নদীর নালা। জানা যায়, উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তার করাল গ্রাসে এক সময় বিলীন হয়েছিল গ্রামের পর গ্রাম। ভেসে গেছে ঘর-বাড়ি, আবাদী জমি, গরু, ছাগল, পুকুর ভরা মাছ সহ অনেক কিছু। সর্বস্ব খুইয়ে ভিঠে ও বাড়িছাড়া হয়েছে হাজার হাজার পরিবার। কিন্তু বর্তমান চিত্র দেখলে মনে হয় তিস্তা তার যৌবন হারিয়ে ধুঁকে ধুঁকে কাঁদছে। তিস্তাপাড়ে গিয়ে দেখা যায়, এক সময়ের উত্তাল ও ভয়ংকর তিস্তার পেটকে মাঠ বানিয়ে শিশুরা খেলছে ফুটবল ও ক্রিকেট। খেলতে আসা শিশু খেলোয়ার আমিনুর রহমান জানায়, নদীতে পানি না থাকায় আমরা মাঠ বানিয়ে নির্ভয়ে ফুটবল খেলছি। এছাড়াও অবাধে চলছে মালবাহী গরু, মহিষ ও ঘোড়ার গাড়ি। পানি না থাকায় জেগে উঠা বালুময় চরে মৌসুমি ফসল বুনেছে কৃষকেরা। তিস্তার উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী পড়েছে বিপাকে। জীবন-যাপন করছে মানবেতর। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, তিস্তার ন্যায্য হিস্যা না মেলায় এ অবস্থা। ভারতের সঙ্গে বারবার দরকষির পরও কোন ফল হচ্ছে না। এর ফলে তিস্তা হারিয়ে ফেলছে তার নাব্যতা ও ঐতিহ্য। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে হাজার হাজার কৃষক। জীবিকা নির্বাহের একমাত্র পথ হিসেবে তিস্তাকে বেঁছে নেয়া জেলে ও নৌ শ্রমিক পরিবারগুলোর বর্তমান করুণ অবস্থা। কথা হয় উপজেলার সদর ইউনিয়নের ধামুর গ্রামের তিস্তা পাড়ের বাসিন্দা জেলে বেরু দাসের সঙ্গে সে জানায়, একসময় হামরা (আমাদের) জীবনের বাজি নিয়্যা (রেখে) তিস্তাত নামি (নেমে) মাছ ধরি ভালভাবে সংসার চালাছি অ্যালা। এখন নদীত পানি না থাকায় হামার মরণদশা (ব্যাপার) হইছে। মাঝি নাজমুল হক জানায়, নদীতে পানি না থাকায় মানুষ এখন হেঁটেই পারাপার হয়। এখন যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চলে না। এ ব্যাপারে কোলকোন্দ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মমিনুর ইসলাম বলেন, উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন তিস্তা নদীর ছত্রছায়ায়। অধিকাংশ জনগোষ্ঠীই তিস্তার উপর নির্ভরশীল। যদি তিস্তা ন্যায্য হিস্যা না পায় তাহলে এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠির ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হবে না। তবে তিনি তিস্তার পানির ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।
জয়পুরহাট থেকে মুহাম্মদ আবু মুসা জানান, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে নেমে আসা পলি জমে জয়পুরহাট জেলার নদীগুলো এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। একসময় খরশ্রতা যমুনা, তুলসীগঙ্গাসহ অন্যান্য নদীগুলো প্রবীণ ও নতুন প্রজন্মের কাছে শুধুই স্মৃতি। নদীর বুকে পাল তোলা নৌকার বদলে এখন নাঙ্গলে ফলার আঘাতে নদীর বুকে চাষ হচ্ছে নানা রকম ফসল। ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদীর বুকে চাষাবাদ করা হচ্ছে ধান, মিষ্টি আলুসহ নানা ফসল। চরানো হচ্ছে গরু ছাগল। খেলার মাঠ হিসেবে নানা ধরনের খেলায় মেতে উঠছে শিশু-কিশোর। নদীগুলো সংস্কারের কোন উদ্যোগ নেই। খনন করে মরা নদীর পানি প্রবাহ সৃষ্টি করতে না পারলে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে এ এলাকা মরু পরিবেশ সৃষ্টি হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় পানি বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, ভারতীয় সীমানার অভ্যন্তরে সৃষ্ট হয়ে বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে জেলার মধ্যে প্রবেশ করেছে ছোট যমুনা, তুলসীগঙ্গা, চিরি ও হারাবতি নদী। একসময় সারা বছর পানিতে ভরা থাকত নদীগুলো। নৌকা চলত, গান গাইত মাঝি। সড়কপথের চাইতে নদীপথগুলো বেশি ব্যবহার করত এ জেলার মানুষ। পার্শ্ববর্তী জেলার সাথে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল এই নদীগুলো।
প্রতিবছর উজানে থেকে বন্যার পানির সাথে বিপুল পরিমাণ পলিও নেমে আসে। পলি জমে নদীগুলোর বুক উঁচু হয়ে উঠেছে। বর্ষা মৌসুমে বন্যার পানি ভাটিতে নামতে পারে না। এতে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে সামান্য বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে অস্বাভাবিক বন্যার সৃষ্টি হয়। সৃষ্টি হয় স্থায়ী জলাবদ্ধতা। এতে ফুল ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়ে থাকে। হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে। জেলা ত্রাণ ও কৃষি বিভাগের তথ্য মতে অকাল বন্যায় প্রতি বছর প্রায় ২০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়। গত ১০ বছরে প্রায় ২ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে।
অপর দিকে শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি ব্যবহার করে সেচ কাযক্রমের পরিকল্পনা থাকলেও বর্তমানে জেলার ৪টি নদী শুকিয়ে গেছে। বোরো মৌসুমে নদীতে পানি না পেয়ে নদীর বুকে গভীর নলকূপ স্থাপন করে সেচ কাজ করছে কৃষকেরা। নদীর বুকে ধান ও মৌসুমী ফসল চাষ করছে স্থানীয় চাষীরা। কোথাও শিশুরা নদীর বুকে খেলা ধুলায় মেতে উঠেছে। এক সময় স্থানীয় জেলে সম্প্রদায়ের লোকজন চৈত্র বৈশাখ মাসে নদীগুলোতে নানা প্রজাতির মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করলেও বর্তমানে ওই নদীগুলোতে বালু খোর ও ভূমি দস্যুরা নদীর বুক থেকে এবং পার্শ্ববর্তী আবাদী জমি কেটে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে মূল নদীর মানচিত্র হারাতে বসেছে। অবস্থা দেখে মনে হয় যেন দেখার কেউ নেই। নদীকূলের স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায় নদীগুলো অত্যন্ত প্রশস্ত ও খর¯্রােতা ছিল। তখন ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আসতো পালতোলা নৌকা সওদাগরদের ও ব্যবসায়ীদের পদচারণায় নদীপথ ছিল মুখরিত। নদীগুলোতে চলে না আর পালতোলা নৌকা। জেলেদের মাছ শিকারে কোলাহল চৈত্রের বাতাসে নদীর মনোমুগ্ধকর ঢেউ আর নেই। এর বদলে নদীর বুক চিরে চাষ হচ্ছে ইরি বোরো ধান ভুট্টা, কচু, পাট, মিষ্টি আলু, সহ নানা রকম ফসল।
জেলার নদীগুলো দিন দিন মরে গেলেও নদী বাঁচাতে সরকারী ও বেসরকারী কোন উদ্যোগ নেই। ১৯৮২ সালে তৎকালীন সরকারের আমলে জেলার তুলসীগঙ্গা নদী খনন কাজ শুরু হলেও অজ্ঞাত কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। বাকী ৪টি নদী জন্মের পর কোন দিনই খনন করা হয়নি বলে জানিয়েছ স্থানীয় পানি উন্নয়ন বিভাগ। পানি উন্নয়ন বিভাগে কর্মরত পানি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, নদী খনন করে পানি প্রবাহ সৃষ্টি করতে না পারলে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে এ অঞ্চলে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। স্থায়ী মরুভূমিতে পরিনত হবে জয়পুরহাটসহ বিস্তীর্ণ এলাকা।
সাইদুর রহমান মাগুরা থেকে জানান, জেলার ৬টি নদী শুকিয়ে যাওয়ায় জীববৈচিত্র্য প্রাকৃতিক ভারসাম্য পরিবেশের মারাত্মক হুমকিসহ সেচ কার্যক্রম চরম ভাবে ব্যহত হচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য নেয়া ট্রাষ্ট ফান্ড প্রকল্প কি অবস্থায় রয়েছে তা কেউ বলতে পারেনা। ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে ভারতের উজান থেকে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করায় মাগুরা জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত ৬টি নদী শুকিয়ে গেছে। ফারাক্কা বাঁধসহ বিভিন্ন বাঁধ নির্মাণের কারণে পলি পড়ে নদীগুলো ভরাট হয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে নদীতে কৃষকরা আবাদ করছে ধান। ফলে আবাদি জমিতে পরিণত হয়েছে নদীগুলো। নাব্যতা হারানোর কারনে নদীবক্ষে বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে জেগে উঠেছে চর। জেলার ৪ উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীগুলো হচ্ছে নবগঙ্গা, কুমার, ফটকি, চিত্রা, গড়াই ও মধুমতি। গুরুত্বপূর্ণ এ নদীগুলোর সাথে জেলার ৪টি উপজেলার ৯ লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। তাছাড়া এসব নদী সংলগ্ন পার্শ্ববর্তী খালের মাধ্যমে ৩০ হাজার হেক্টর জমির সেচ কার্যক্রম নির্ভরশীল। নদীগুলোর পানি প্রবাহ কমে সর্বনি¤œ পর্যায়ে আসায় অনেক এলাকায় সেচ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে নৌচলাচল বন্ধ হয়ে দেখা দিয়েছে পণ্য পরিবহনে প্রতিবন্ধকতা। ফলে নদীগুলো হারিয়ে ফেলছে বাণিজ্যিকসহ সকল গুরুত্ব। গড়াই মধুমতি নদী দুটির বক্ষে বিশাল চর পড়ায় মাগুরা জেলার শ্রীপুর মাগুরা সদর ও মহম্মাদপুর উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী রাজবাড়ী ও ফরিদপুর জেলার মানুষের জীবনযাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এদিকে চিত্রা নদীটি জেলার শালিখা উপজেলা ও যশোর জেলার বাঘারপাড়া উপজেলার মধ্যদিয়ে নড়াইলে গিয়েছে। জেলার সংযোগ রক্ষাকারী এই নদী বর্তমানে পুরোটাই মরে গেছে। জেলার অপর নদী কুমারের বুকজুড়ে মাইলের পর মাইল চর জেগে উঠেছে। একসময়ের খর¯্রােতা এ নদী বর্তমানে পানিশূন্য জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। নদী থেকে প্রাপ্ত সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এলাকাবাসী। তাছাড়া নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে পানি ধরে রাখার ক্ষমতা না থাকায় নদীর পানি উপচে একদিকে বন্যা অপরদিকে নদীভাঙনে জনজীবনে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্যোগ।
রাজাপুর ঝালকাঠি থেকে উপজেলা সংবাদদাতা জানান, ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার রূপসী বাংলার কবি জীবননানন্দ দাশের ঐতিহ্যবাহী ধানসিঁড়ি, পোনা ও জাঙ্গালিয়াসহ একসময়ের খড়¯্রােতা নদীগুলো বেপরোয়া দখল-দূষণে নাব্য সঙ্কটে জৌলুস হারিয়ে দিন দিন মরে যাচ্ছে। এখন নদীগুলো শুকিয়ে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে, অনেকগুলো আবার নালায় পরিণত হয়েছে। ফলে নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। এ উপজেলার প্রধান প্রধান নদী ধানসিঁড়ি, বিষখালি, পোনা, জাঙ্গালিয়াসহ অসংখ্য শাখা নদী শুকিয়ে গেছে। সামান্য অংশজুড়ে অস্তিত্ব নিয়ে কোনোমতে টিকে আছে ঐতিহ্যবাহী ধানসিঁড়িসহ একসময়ের খড়¯্রােতা এসব নদীগুলো। প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে উপজেলার প্রধান নদীগুলোয় নাব্য না থাকায় অর্থনৈতিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ জনপদের মানুষ। উপজেলা বিভিন্ন গ্রামে দেখা দেয় তীব্র পানি সংকট। ধানসিঁড়ি নদী : রূপসী বালার কবি জীবনানন্দ দাশ ধানসিঁড়ি নদী নিয়ে তার কবিতায় লিখেছিলেন, আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরেÑ এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয়Ñ হয়তো বা শংখচিল শালিখের বেশে...। নেই ধানসিঁড়ি আজ অস্তিত্ব সংকটে কবি বেঁচে থাকলে হয়তো ধানসিঁড়ির এ দুর্দশা নিয়েও কবিতা লিখতেন। জাঙ্গালিয়া নদী : উপজেলা সদরের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে ধানসিঁড়ি ও বিষখালি শাখা নদী জাঙ্গালিয়া। জাঙ্গালিয়া নদীটি বাগড়ি, মেডিকেল মোড় ও বাজার এলাকায় ব্যাপক দখল হওয়ায় এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। নদীর উভয় তীরে নদী দখল করে বসতাবাড়ির পাশাপাশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে ভূমিদস্যুরা। তাই নদীর অনেকাংশ ছোট হয়ে মরা খাল হয়ে গেছে। পোনা নদী : রাজাপুর উপজেলার দক্ষিণ রাজাপুরের আংগারিয়া গ্রামের সত্যনগর এলাকার জাঙ্গালিয়া নদী থেকে শুরু করে আংগারিয়া, আলগী, জীবনদাসকাঠি, কৈবর্তখালী, গালুয়া, চাড়াখালি গ্রাম হয়ে ভান্ডারিয়ার কচানদী পর্যন্ত বাঁকে বাঁকে প্রায় ১৫-২০ কিলোমিটার দীর্ঘ পোনা নদী। এক সময় নদী থেকে আসা পলি মাটির কারণে নদীর দু’পাশের কৃষকরা অধিক ফসল ফলাতো। মাছও জন্মাতো প্রচুর। কিন্তু বর্তমানে এ নদীটি মরা খালে পরিনত হওয়ায় তীরবর্তী অনেক গ্রামে পানি সঙ্কট দেখা দেওয়ায় কৃষকরা চাষাবাদ করতে পারছেন না। ১৯৫০ সালের পরবর্তী সময়ে মাত্র ১০ ফুট গভীরতায় এ নদীটি খনন করা হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে নামমাত্র কয়েকবার খনন করা হলেও পূর্বের যৌবন ফিরিয়ে আনতে না পারায় নদীটি বর্তমানে মরা খালে পরিণত হয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।