Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উৎসব উদযাপনে বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুশীলন কাম্য নয়

প্রকাশের সময় : ১৩ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মো. আবদুল লতিফ নেজামী

উৎসবাদি এবং সামাজিক আচার-আচরণের ক্ষেত্রে প্রত্যেক দেশ এবং জনগোষ্ঠীরই নিজস্ব কিছু আচার-আচরণ, প্রথা-পদ্ধতি, নিয়ম-কানুন বা রীতি-রেওয়াজ রয়েছে। রয়েছে তাদের স্বাতন্ত্র্য। এসবের মধ্যে ধর্মের সম্পৃক্ততাও বিদ্যমান। তাই নববর্ষসহ যে কোনো উৎসব উদযাপনে স্ব-স্ব আদর্শ ও মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেখা যায়। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণও এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জাতি। সে কারণে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রথা-পদ্ধতি অন্যদের সংস্কৃতি থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যম-িত, পরিচ্ছন্ন ও স্বতন্ত্র। বোধ-বিশ্বাস, আমল-আখলাক, আচার-ব্যবহার, জীবনধারণ, জীবন-মনন, শাসন পদ্ধতি, উৎসব-আনন্দ, জন্ম-মৃত্যু, রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন-আদালত, ইত্যাদি সবকিছুর ক্ষেত্রেই মুসলিম জনগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব প্রথা-পদ্ধতি ও আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি। নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আমাদের একটি সামাজিক উৎসব। এই উৎসব নিজস্ব গুরুত্বে জাতীয় জীবনে বিশেষ চেতনার দ্যোতক। বাংলা সনের প্রথম মাস ছিল অগ্রহায়ণ, বৈশাখ নয়। কিন্তু পরবর্তীতে বাংলা সনের ষষ্ঠ মাস বৈশাখকে বছরের প্রথম স্থানে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
বাংলা নতুন বছরের গণনার রীতি প্রবর্তিত হয় মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে ১৫৫৬ অব্দ মোতাবেক হিজরি ৯৬৩ চান্দ্র সনকে সৌর সনে রূপান্তরের মাধ্যমে। এ রূপান্তরে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন সম্রাট আকবরের শাহী দরবারের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহ উল্লাহ সিরাজী। কিন্তু মঙ্গলঘট, মঙ্গল প্রদীপ, মাঙ্গলিক প্রতীক অঙ্কন প্রভৃতি আমদানি করে পহেলা বৈশাখের চেতনাকে ভিন্নমুখী করা হচ্ছে। এই আগ্রাসন পরিচালিত হচ্ছে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির স্বাভাবিক বিবর্তনকে বাধাগ্রস্ত করে একটি স্বাধীন জাতির স্বাতন্ত্র্যবোধকে ধ্বংস করার জন্য বিজাতীয় বিভিন্ন প্রথা পদ্ধতি চালু করার মাধ্যমে।
বাঙালি সংস্কৃতির নামে ঋতু ও নববর্ষবরণ বা অন্য যে কোনো উৎসব উদযাপনে বিজাতীয় সংস্কৃতি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে ধারণ, চর্চা ও অনুশীলন করতে দেখা যায়। বিজাতীয় সাংস্কৃতিক কর্মকা- সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে নববর্ষ উৎসবে বিধর্মীয় সংস্কৃতির প্রভাব এমনভাবে প্রবেশ করানো হচ্ছে যে, এতে আমাদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক সত্তাই চরম হুমকির সম্মুখীন হওয়ার উপক্রম হচ্ছে। মুসলিম জনগণকে বৈশিষ্ট্যহীন করার লক্ষ্যে এ অপতৎপরতা চালানো হচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। যেমন, মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে, উলুধ্বনী দিয়ে, শাঁখা বাজিয়ে, মঙ্গল কলস সাজিয়ে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। পহেলা বৈশাখে মিছিলাদিতে ঢোলের ব্যবহার, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাতি, ঘোড়া ও কচ্ছপের প্রতীক এবং বিভিন্ন ধরনের মুখোশ সম্বলিত মঙ্গল শোভাযাত্রায় হাতে-মুখে, গালে আল্পনা এঁকে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি, খোঁপায় হলুদ গাদা ফুলের মালা, হাতে শাঁখা চুরি পরা তরুণীদের উচ্ছলতা এবং বিদ্যাসাগরীয় চটি জুতা, বঙ্কিম চন্দ্রের কোঁচা, শরৎচন্দ্রের চাদর কাঁধে ফেলে তরুণদের প্রাণময় উচ্ছ্বাস, মুসলিম মহিলাদের সিঁথিতেও সিঁদুর, গলায় পুঁতির ও গজোমালা, হাতে শাঁখা ধারণ করতে দেখা যায়। যেসব পশুপাখি নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয়, তাও এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের পরিপন্থী। কেননা সংখ্যালঘু একটি জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ^াস মোতাবেক পেঁচা মঙ্গলের প্রতীক ও লক্ষ্মীর বাহন, ইঁদুর গণেশের বাহন, হনুমান রামের বাহন, হাঁস স্বরস্বতীর বাহন, সিংহ দুর্গার বাহন, গাভী রামের সহযাত্রী, সূর্য দেবতার প্রতীক ও ময়ূর কার্তিকের বাহন।
নানাভাবে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর আচার-আচরণ, নিয়ম, রীতি-রেওয়াজ উৎখাত করে দেশকে বৈশিষ্ট্যহীন করার প্রয়াস পরিদৃশ্যমান। নানা উদ্ভট চিন্তা-চেতনার আবর্তে তাড়িত একশ্রেণীর লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইসলাম বিরোধিতায় ক্রিয়াশীল। বৃহৎ শক্তির তল্পিবাহকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তারা এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় বোধ-বিশ্বাস-মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বানচাল করতে সদা তৎপর। মুসলিম বাঙালিত্ব ও ইসলামী জীবনধারার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বিলোপের দ্বারা বাংলাদেশের জাতীয় জীবন-মনন, আচার-আচরণ, অনুভূতি ও পোশাক-পরিচ্ছদে পরিবর্তন আনার প্রয়াস লক্ষণীয়।
দেশকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও পতিত সমাজতন্ত্রের দিকে ঠেলে দেয়ার লক্ষ্যে তারা দেশে ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করার দাবিতে সোচ্চার। কারণ এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনতা ধর্মীয় শিক্ষার দ্বারা প্রভাবান্বিত। তাই এই প্রভাবকে খর্ব করার জন্য ধর্মীয় শিক্ষা সংকোচনের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচিতে ললিতকলার ওপর বিস্ময়কর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতির প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে ললিতকলা শিক্ষাকে আবশ্যিক বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করে শিশুমনে ধর্মহীন সাংস্কৃতিক চিন্তা-চেতনা সৃষ্টির কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে।
এ দেশের একশ্রেণীর মানুষ শতকরা ৯২ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে আচার সাম্য প্রতিষ্ঠার নামে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে, উলুধ্বনি দিয়ে, শাঁখা বাজিয়ে, মঙ্গল কলস সাজিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করার অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে। সালামের পরিবর্তে প্রণাম জানানোর সংস্কৃতি অনুশীলন করে বাঙালি সাজার কসরৎ করা হচ্ছে। তাছাড়া বাংলাদেশের ভাষা স্বাতন্ত্র্যকে নষ্ট করার জন্য আরবি-ফার্সি-তুর্কি-উর্দু শব্দ প্রধান ভাষাকে সংস্কৃতি ও পালিকরণ করা হচ্ছে। দেশের সার্বভৌমত্ব ও রাজনৈতিক সীমানাকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলার লক্ষ্যে এবং সাংস্কৃতিক অভিন্নতাবোধের আবেগ সৃষ্টির চেষ্টার অংশ হিসেবে মনোগ্রাম, নাটকীয় সংলাপ, মঞ্চ সজ্জা, নৃত্য, নাচের পোশাক, বইয়ের প্রচ্ছদ, পোস্টারের ছবি, গৃহসজ্জা, উৎসব সজ্জা, দেয়াল সজ্জা, তোরণ সজ্জা প্রভৃতি ক্ষেত্রেও বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুশীলনের মহড়া দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া পবিত্র বিসমিল্লাহ, আল্লাহ হাফেজ, জিন্দাবাদ ধ্বনি পরিহার এবং ইসলামী প্রতিষ্ঠানে ছবি টানানোর নির্দেশ ও সরকারি প্রচার মাধ্যমে ইসলামী পরিভাষা পরিহার করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন, আল্লাহর পরিবর্তে সৃষ্টিকর্তা, পবিত্র বিসমিল্লাহর বদলে মহান সৃষ্টিকর্তার নামে শুরু করিতেছি, জিন্দাবাদ ধ্বনি পরিত্যাগ করতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
একই লক্ষ্যে ধর্ম ও ইসলামী শিক্ষাকে ডাউনগ্রেড করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ১৭৮০ সালে লর্ড হেস্টিংসের সময় শুরু আলিয়া মাদ্রাসা এবং ১৮৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকায়ন ও মূল স্রোতে নিয়ে আসার নামে মাদ্রাসা শিক্ষার সিলেবাসে ক্রমশ মাত্রাতিরিক্ত সাধারণ বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে, যাতে মাদ্রাসা শিক্ষার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দারুণভাবে ক্ষুণœ হয়। মাদ্রাসা শিক্ষার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে আলিয়া মাদ্রাসায় সহশিক্ষা প্রবর্তন ও এক-তৃতীয়াংশ মহিলা শিক্ষিকা নিয়োগের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। আলিয়া মাদ্রাসায় সহশিক্ষা প্রবর্তন ও মহিলা শিক্ষিকা নিয়োগের নির্দেশ দিয়ে এবং পর্দা প্রথাকে ঐচ্ছিককরণ সম্বলিত নোটিশ জারি করে জাতীয় ঐতিহ্য চেতনায় পর্দা প্রথার ওপর কুঠারাঘাত করা হয়েছে। কেননা পর্দা জাতীয় ঐতিহ্য চেতনায় গুরুত্বপূর্ণ। পর্দার প্রভাব এ দেশের মুসলিম মহিলাদের ওপর অপরিসীম। মুসলিম নারীদের পৃথক অস্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্যের অন্যতম ভিত্তি হলো ইসলামী পোশাক পর্দা। পর্দা মুসলিম পরিচিতির অন্যতম উৎস বিধায় এ ভিত্তিকে চুরমার করার এবং পর্দার সংস্পর্শ ও প্রভাব থেকে মহিলাদের সরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে সর্বাত্মক অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
মুসলিম প্রধান বাংলাদেশের একটি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়েও ইসলামী পোশাক পর্দা-বিদ্বেষী আচরণ ফুটে উঠেছে। সম্প্রতি নেকাব পরিহিতা এক ছাত্রীকে শ্রেণীকক্ষ থেকে বের করে দেয়া হয়। অথচ মুসলিম জাতীয় ঐতিহ্য চেতনায় গুরুত্বপূর্ণ পর্দা মুসলিম পরিচিতির অন্যতম উৎস এবং নারীদের পৃথক অস্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্যের অন্যতম ভিত্তি। উল্লেখ্য, পর্দার অর্থ নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের বিরোধিতা নয় এবং নারীদের গৃহবন্দী করে রাখাও নয়। বরং শালীনতা বজায় রেখে নারীরা যে কোনো কর্ম গ্রহণ করতে পারে। আপত্তি শুধু মুক্ত জীবনের নামে মহিলাদের দ্বারা অশ্লীল নৃত্য-গীত ও দেহবল্লরী প্রদর্শন।
নেকাব পরিহিতা ছাত্রীর সাথে ঢাবির আচরণে জাতীয় আদর্শ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, রীতিনীতি, তাহযিব-তমদ্দুন ও স্বকীয়তা এবং চিরায়ত মূল্যবোধ বিরোধী মনোভাবের যে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, এতে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির অনৈসলামী চেতনার স্বরূপ সম্পর্কে সচেতন মানসে কোনো সংশয় থাকবে না। এ ধরনের আচরণে ইসলাম বিরোধী শিক্ষা-সংস্কৃতি, বিশ্বাস, চেতনা ও উপলব্ধি প্রতিবিম্বিত হয়েছে এবং তার প্রকৃত স্বরূপ চিনতে দেশবাসী সক্ষম হয়েছে। যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিল এবং মক্কা-মদিনা বিশ^বিদ্যালয় বলে উপহাস করেছিল, সেই বিশ^বিদ্যালয়ে উপহাসকারীদের সংস্কৃতি ধারণ, চর্চা ও অনুশীলনে বাধা নেই যা এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের পরিপন্থী। তাছাড়া বিজাতীয় সাংস্কৃতিক কর্মকা- সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়। ঢাবি ছাড়াও ব্র্যাক, আইইউবির মতো বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়, কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণকে বৈশিষ্ট্যহীন করার মতো অপসংস্কৃতির চর্চা হয় অহরহ। লক্ষ্য একটাই, কুসংস্কারাচ্ছন্ন আচার-রীতির আগ্রাসনের মাধ্যমে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের চেতনাকে ভিন্নমুখী করা। অথচ ভিনদেশি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধ এবং নিজস্ব সংস্কৃতির স্বাভাবিক বিবর্তনকে অব্যাহত রাখার লক্ষ্যেই একদিন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তাই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ধর্ম, বিশ্বাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, নিয়ম, রীতি-রেওয়াজ ধারণ, চর্চা ও অনুশীলনের ওপর গুরুত্বারোপ করা উচিত। কোনো অবস্থায় ঢাবিসহ এ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিধর্মীয় আদর্শ-ঐতিহ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সভ্যতার অনুকরণ অভিপ্রেত নয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে যেন পোশাকসহ আমাদের স্বতন্ত্র জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও সংস্কৃতির অনুশীলন করা হয়। কেননা, পরানুকরণ করতে করতে আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য যে বিনষ্ট হচ্ছে তা নয়, বরং স্বতন্ত্র জাতিসত্তা ও আত্মপ্রত্যয়ের মূলেও চরম আঘাত লাগছে। তাই বিশ^বিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্দাসহ নিজস্ব প্রথা-পদ্ধতি, নিয়মনীতি বা রীতি-রেওয়াজের অনুশীলন কাম্য। কেননা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই ছাত্রদের সুকুমার বৃত্তির বিকাশ, নৈতিক উৎকর্ষতা সৃষ্টি, সৃজনশীল প্রতিভার উন্মেষ, তাদের স্বশিক্ষিত ও মার্জিত করে গড়ে তোলা এবং প্রকৃত মানব সৃষ্টির ক্ষেত্রে নিজস্ব সংস্কৃতির লালন ও চর্চার ক্ষেত্র। ধর্মীয় শিক্ষা-সংস্কৃতি আমাদের চেতনাকে শাণিত, কর্তব্যবোধে উজ্জীবিত, দীপ্ত পথে বলিয়ান ও উদ্দীপ্ত করতে সহায়তা করে। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ছাত্রদের উন্নত চিন্তা-ভাবনা, উন্নত মানবিক জীবন এবং সমাজের মনোভূমিতে শৃঙ্খলা আনার প্রশিক্ষণ হয়ে থাকে। ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি মানুষের অন্তরে পারস্পরিক ভালোবাসা, সাম্য ও মৈত্রীর অনুভূতি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই জাগ্রত করে।
এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রয়েছে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক চেতনা। রয়েছে একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। অন্য যে কোনো সংস্কৃতির বিকল্প মডেল যা অন্য কোনো সংস্কৃতিতে লীন হওয়ার নয়। জাতীয় আদর্শ, ঐতিহ্য রীতি-নীতি ও স্বকীয়তাবিরোধী নগ্নাশ্রয়ী অপসংস্কৃতির পথ রুদ্ধ করতে সবারই সচেষ্ট হওয়া উচিত। দেশের মহিলাদের সাংস্কৃতিক ও স্বাতন্ত্র্যের প্রতীক নেকাবসহ পর্দা পরিপন্থী কোনো উদ্যোগ গ্রহণ থেকে বিরত থাকার জন্যে সচেষ্ট হওয়া উচিত।
আগেই বলা হয়েছে, মুসলমানসহ প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক আচার-আচরণের ক্ষেত্রে নিজস্ব প্রথা-পদ্ধতি, নিয়মকানুন বা রীতি-রেওয়াজের মধ্যে ধর্মের সম্পৃক্ততা রয়েছে, রয়েছে প্রভাব। সেই প্রভাবকে খর্ব করার জন্যই এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্ম ইসলামের অপরিহার্য অঙ্গ ফতোয়া নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছিল। তাছাড়া সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে ইসলামের চিরায়ত মূল্যবোধ ধ্বংস করার পাঁয়তারা চালানোর প্রয়াসও একই সূত্রে গাথা। পশ্চিমা সভ্যতার চর্চা ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ এবং ধর্মকে পশ্চাৎমুখী ও ব্যক্তিগত বিশ্বাস তত্ত্ব অনুযায়ী এ দেশেও ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সকলের’ তত্ত্ব প্রচার করতে দেখা যায়। অথচ ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সকলের’ পশ্চিমা এই সেক্যুলার তত্ত্বের সাথে ইসলাম ধর্মের মৌলিক তফাৎ বিদ্যমান। ইসলাম ধর্মানুসারী মুসলমানরা এমন এক জাতি যে, তাদের বিশ্বাস, আমল-আখলাক, আচার-ব্যবহার, জীবনধারণ, জীবন-মনন, শাসন পদ্ধতি, আনন্দ-উৎসব, জন্ম-মৃত্যু, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, আইন-আদালত ইত্যাদি সব কিছুই একটি সুস্পষ্ট ঐশীবিধান ও মহানবীর (সা.) সর্বোত্তম জীবনাদর্শনুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকে। আর এসব রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত। তাছাড়া সংবিধান থেকে ঈমান-আক্বিদার সংশ্লেষ সম্বলিত ধারা রহিত করারও একই উদ্দেশ্য।
সারা পৃথিবীতে মানুষ নিজেদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। কিন্তু আমরা আমাদের ধর্মের ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিতে লজ্জিত হই। অথচ আমাদের অস্তিত্ব, স্বাধীন মর্যাদা, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, ঐক্য, শক্তি, সৃজনশীলতা, শৃঙ্খলা, কর্মপন্থা, সমষ্টি উদ্যোগ, সামগ্রিক কল্যাণ এবং ভবিষ্যৎ সবকিছু ইসলাম ধর্মভিত্তিক সংস্কৃতি বিকাশের ওপরই নির্ভরশীল। তাই বাংলাদেশে জাতিসত্তা নির্মাণে ইসলামী সংস্কৃতিকে ভিত্তিশর্ত হিসেবে আঁকড়ে ধরতে হবে।
নববর্ষ বা যে কোনো উৎসব উদযাপনে নিজস্ব শিক্ষা-সংস্কৃতির অনুবর্তী হওয়া বাঞ্ছনীয়। উৎসব উদযাপনে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর পৃথক সংস্কৃতি তথা আচার-আচরণ, নিয়ম, রীতি-রেওয়াজের অনুশীলনের ওপর গুরুত্বারোপ করা উচিত। যে কোনো অনুষ্ঠানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার ধর্ম, বিশ্বাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটানোর প্রয়াস চালানো উচিত। কোন অবস্থায়ই বিধর্মীয় আদর্শ-ঐতিহ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সভ্যতার অনুকরণ অভিপ্রেত নয়। পহেলা বৈশাখ অথবা যে কোনো উৎসব উদযাপনে আমরা যেন আমাদের স্বতন্ত্র জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও সংস্কৃতি বিস্মৃত না হই। পরানুকরণ শুধু যে সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট করে তা নয়, বরং স্বতন্ত্র জাতিসত্তা ও আত্মপ্রত্যয়ের মূলেও চরম আঘাত হানে। তাই এক্ষেত্রে নিজস্ব প্রথা-পদ্ধতি, নিয়ম-নীতি বা রীতি-রেওয়াজের অনুশীলন কাম্য। কেননা এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রয়েছে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক চেতনা। রয়েছে একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। তাই পহেলা বৈশাখের উৎসব উদযাপনে আমরা যেন আমাদের স্বতন্ত্র জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও সংস্কৃতি বিস্মৃত না হই।
লেখক : ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: উৎসব উদযাপনে বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুশীলন কাম্য নয়
আরও পড়ুন