Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান : বিদ্যুৎ ও বন্দর উন্নয়নে ভারতের বিনিয়োগ

প্রকাশের সময় : ২৫ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৪৪ পিএম, ২৪ জানুয়ারি, ২০১৬

বিশেষ সংবাদদাতা : ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপ বাংলাদেশে বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে। এই বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৩শ’ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। জানা যায়, এই পরিমাণ বিনিয়োগ তারা করবে বাংলাদেশে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়নে। গতকাল রোববার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে বিনিয়োগ ও নীতিমালা সম্মেলন ২০১৬’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গ্রুপটির পক্ষ থেকে এই ঘোষণা দেয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বিনিয়োগ বোর্ডের আয়োজনে দেশি এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিয়ে ঢাকায় প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই সম্মেলন। সম্মেলনে দেশ-বিদেশের ব্যবসায়ী ছাড়াও গবেষক, শিক্ষাবিদ, শিল্প ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা অংশ নিচ্ছেন। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এদেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতেই মূলত আয়োজন করা হয়েছে এই সম্মেলনের। বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে এসময় বিনিয়োগকারীর প্রতি সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
এ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অংশীদার হতে বিশ্বের বড় বড় বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, অর্ধদশক আগের চেয়ে বাংলাদেশ এখন এক ভিন্নরকম দেশ। তিনি বলেন, আজকের বাংলাদেশ হচ্ছে সম্পূর্ণ পরিবর্তিত এক বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মানুষ এখন আরো বেশী আত্মবিশ্বাসী। তারা যে কোন অসম্ভব কাজকে বাস্তবায়ন করতে আরো বেশী আত্মবিশ্বাসী ও অঙ্গীকারাবদ্ধ।
বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশকে আকষর্ণীয় স্থান উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এ দেশে-বিদেশীদের বিনিয়োগের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশ একট সুন্দর দেশ আসুন এখানে বিনিয়োগ করুন। আমাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় আপনাদের সক্রিয় অংশীদার হওয়ার এখনই যথার্থ সময় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারপার্সন হিসেবে আমি আপনাদের, বিশেষ করে দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের, নিশ্চিত করতে চাই যে আমরা আপনাদের বাস্তবভিত্তিক বিনিয়োগ প্রস্তাবনা বাস্তবায়নে সব ধরণের সহায়তার দেয়ার জন্য প্রস্তুত। বাংলাদেশে আপনার বিনিয়োগের সুরক্ষা ও বৃদ্ধি সুনিশ্চিত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিনিয়োগ কার্যক্রম সহজীকরণের লক্ষ্যে আমরা ইতোমধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা সারাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছি। ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির জন্য ৩০টি এলাকা নির্বাচন করা হয়েছে। আগামী মাসে ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে বলেও প্রধানমন্ত্রী জানান। তিনি বলেন, আমাদের প্রধান প্রধান বৈদেশিক বিনিয়োগ খাতগুলোর মধ্যে বিদ্যুৎ, গ্যাস, সড়ক-মহাসড়ক, সেতু, স্বাস্থ্যসেবা, ওষুধশিল্প, সমুদ্রবন্দর, শিল্পোৎপাদন, হালকা প্রকৌশল, অটোমোবাইল, সিরামিকস, টেক্সটাইল, চামড়া এবং চামড়া-জাত শিল্প, আইসিটি, বিভিন্ন সেবাসহ বিভিন্ন ভৌত অবকাঠামো উল্লেখযোগ্য।
শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বব্যাপী ব্যাপক অনিশ্চয়তা ও উন্নত দেশগুলোতে মন্দাসহ সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। গত ৭ বছর ধরে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শুধু ধরেই রাখেনি, ক্রমাগতভাবে তা এগিয়েও নিয়ে গেছে। গত অর্থবছরে আমাদের প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক পাঁচ-এক শতাংশ। আগের ৫ বছরের গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ। আমরা চলতি অর্থবছরে ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি। অর্থবছরের অর্ধেক সময় পেরিয়ে যে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে, তাতে আমরা ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে যথেষ্ট আশাবাদী,’ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন প্রধানমন্ত্রী। দেশের অর্থনীতি এখন জিডিপি’র ভিত্তিতে বিশ্বের ৪৫তম ও ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে ৩৩তম স্থান অধিকার করেছে বলেও জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, আজকের বাংলাদেশ বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। আজকের যে বাংলাদেশ তা অর্ধ-দশক আগের বাংলাদেশের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বাংলাদেশ। দেশের মানুষ আজ অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী, যেকোনো অসাধ্য সাধনে অনেক বেশি আত্মপ্রত্যয়ী ও সংকল্পবদ্ধ। এটি সম্ভব হয়েছে নীতি-নির্ধারক, উদ্যোক্তা, বিশেষজ্ঞ ও কর্মীদের দক্ষতার মধ্য দিয়ে।
তিনি বলেন, ব্যক্তিখাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের দক্ষতা বেড়েছে, মনোবল বেড়েছে উদ্যোক্তাদেরও। আমাদের বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে যে সাহসী উদ্যোগ আমরা নিয়েছি, তা সক্ষমতারই পরিচয় বহন করে।
বিগত ৬ বছরে বাজেটের আকার প্রায় ৫ গুণ বেড়ে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। রফতানি আয় বেড়েছে ৩২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। তা আজ পৌনে আট গুণ বেড়ে ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে,’ উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বর্তমান সরকার ব্যবসা করতে আসেনি। আমরা ব্যবসা করি না। ব্যবসা করবেন ব্যবসায়ীরা। সরকার ব্যবসাবান্ধব ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করছে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আঞ্চলিক সহযোগিতা বেড়েছে। দক্ষিণ এশিয়া অদূর ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধির একটি বড় কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে এটিকে আর ‘গরীব মানুষের সমিতি হিসেবে অবহিত করার অবকাশ থাকছে না। বিগত কয়েক বছরেই আমরা অবকাঠামো ও নিয়ম-নীতির ব্যাপক সংস্কার করে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছি।
এ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের নেয়া পদক্ষেপের কথাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অপরিহার্য উপাদান। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে এখন ১৪ হাজার ৭৭ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। গ্যাসের দৈনিক উৎপাদন ২০০৬ সালের ১৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে বেড়ে ২ হাজার ৭২৮ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত হয়েছে। ভবিষ্যতে গ্যাসের ঘাটতি মেটানোর জন্য এলএনজি আমদানির পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এজন্য এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণেরও কাজ চলছে’ যোগ করেন শেখ হাসিনা
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের রয়েছে বিপুলসংখ্যক যুব কর্মশক্তি। বিশাল বাজার, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সুদৃঢ় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। কার্যকর বাজার অর্থনীতির যথাযথ ব্যবহারের জন্য আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রসারে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও পদ্ধতিগত সরলীকরণ করেছি।
তিনি বলেন, ব্যক্তিখাতের নীতি-নির্ধারণী বিষয়ক সমস্যাসমূহ তথ্যনিষ্ঠ ও গবেষণার মাধ্যমে চিহ্নিত করা ও তার সমাধানের জন্য আমার দপ্তর ‘প্রাইভেট সেক্টর ডেভলপমেন্ট পলিসি কো-অর্ডিনেশন কমিটি (পিএসডিপিসিসি) নামে একটি কমিটি গঠন করেছি। এতে সরকারী ও ব্যবসায়ী চেম্বার ও বাণিজ্য সংস্থাসমূহ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সব ধরণের বেসরকারী বিনিয়োগে রাজস্ব এবং রাজস্ববহির্ভূত আকর্ষণীয় প্রণোদনা দিচ্ছি। বিনিয়োগকারীদের প্রবেশ এবং বহির্গমন সহজ করা হয়েছে এবং তাঁরা তাঁদের বিনিয়োগকৃত অর্থ ও মুনাফা সহজেই দেশে নিয়ে যেতে পারেন।
বাংলাদেশ সামাজিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে অন্তর্ভুক্তি ও সমসুবিধা নিশ্চিত করার এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খাদ্য-উৎপাদনে আমরা স্বয়ং-সম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। জনগণের গড় আয়ু বেড়ে ৭০ দশমিক ৭ বছর হয়েছে এবং এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে মা ও শিশুর যতেœ বাংলাদেশ সর্বোচ্চ স্থান অর্জন করেছে। দারিদ্র্যসীমা হ্রাস পেয়ে ২২ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে।
ব্লু-ইকোনমির সুযোগ গ্রহণে বিনিয়োগকারীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গোপসাগরে আমাদের অফুরন্ত সামুদ্রিক সম্পদ যথাযথভাবে ব্যবহারের জন্য বিনিয়োগকারীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। মায়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমানার বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে এটি সম্ভব হয়েছে। ব্লু-ইকোনমি আমাদের এখন নতুন সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে।
আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য সরকারে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের জোর প্রচেষ্টার ফলে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্যএশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা, আফ্রিকার সাথে আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের দিকগুলি আরও গভীর ও বিস্তৃত হয়েছে। ব্যবসায়ী ও জনগণের মধ্যে সম্পর্কের নতুন মাত্রা উন্মেচিত হয়েছে।
২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার লক্ষ্য পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের লক্ষ্য ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা দূর করে বাংলাদেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের এ পথচলায় আমরা আপনাদের সহযোগিতা চাই। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমেই এ বিশ্ব একদিন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত হবে, অন্তত এ অঞ্চল এবং বাংলাদেশ দারিদ্র্যমুক্ত হবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান এসএ সামাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চিফ মিনিস্টার মুকুল শর্মা, ভারতের আদানী গ্রুপের চেয়ারমান গৌতম আদানী, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ প্রমুখ বক্তব্য দেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান : বিদ্যুৎ ও বন্দর উন্নয়নে ভারতের বিনিয়োগ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ