Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভেজাল-নকলে সয়লাব

০ মসলায় ইটের গুঁড়া

| প্রকাশের সময় : ১৪ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

০ অভিযানের ঠেলায় ফ্যাক্টরি স্থানান্তর
০ অসাধু কারবারিরা তৎপর, বেড়েছে বিক্রি
নূরুল ইসলাম : ঈদকে সামনে রেখে জমতে শুরু করেছে সেমাই, লাচ্চা, ঘি ও মসলার বাজার। রমযানে রাজধানীর ফুটপাত থেকে শুরু করে অলি-গলিতে যেভাবে ইফতার সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে আর দুদিন পরে সে সব দোকানেই মিলবে সেমাই, লাচ্চা, মসলা, ঘি, মিষ্টি, দধিসহ নানান মুখরোচক সামগ্রী। এসব সামগ্রী তৈরীতেও বসে নেই ভেজালকারবারীরাও। দেদারছে তৈরী হচ্ছে ভেজাল সেমাই, লাচ্চা, ঘি, ভোজ্যতেলসহ ঈদে ব্যবহার্য নিত্য খাদ্য সামগ্রী। মসলায় মেশানো হচ্ছে ইটের গুঁড়াসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল। ভেজালের সাথে নকল পণ্য বিক্রিও বেড়েছে। পুরান ঢাকার চকবাজার, লালবাগ ও কেরানীগঞ্জের অলিগলিতে প্রস্তুতকৃত নকল ও নিম্নমানের সাবান, চন্দন, মেছ্তা-দাগ নাশক ক্রিম, নানা প্রসাধনী, তেল, পারফিউম সবকিছুই পাইকারী ও খুচরা বিক্রিও হচ্ছে। এসব নকল সামগ্রীর প্যাকেট বা বোতলে সাঁটানো বিভিন্ন দেশের লেভেল।পৃথিবীর যত নামকরা ব্র্যান্ডের প্রসাধণ সামগ্রী সবই তৈরী হচ্ছে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায়। রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানেও বিক্রি হচ্ছে নকল পণ্য। ভেজালবিরোধী অভিযান প্রসঙ্গে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম ইনকিলাবকে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি মানুষকে ভেজালমুক্ত খাবার খাওয়াতে। বিক্রেতারা যাতে ভেজালযুক্ত খাবার বিক্রি করতে না পারে সে চেষ্টায় মোবাইল কোর্টের অভিযান অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, এটা ঠিক আগের তুলনায় ভেজাল মেশানোর প্রবণতা অনেকটা কমেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রমজান মাসজুড়ে ভেজালবিরোধী মোবাইল কোর্ট সচল থাকায় পুরান ঢাকার লাচ্চা ও সেমাই ব্যবসায়ীদের কয়েকটি গ্রæপ ইতোমধ্যে তাদের ফ্যাক্টরী কেরানীগঞ্জ, রুপগঞ্জ, টঙ্গী, সাভার, আশুলিয়াসহ ঢাকার আশপাশে স্থানান্তর করেছে। সেখানে রাতদিন তৈরী হচ্ছে ভেজাল সেমাই, লাচ্চা, ঘিসহ বিভিন্ন সামগ্রী। আবার পুরান ঢাকার কোতয়ালী, বংশাল, লালবাগ, সূত্রাপুর, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী,ওয়ারী, গেন্ডারিয়া থানা এলাকায় দেদারছে ভেজাল সেমাই, ঘি ও লাচ্চা তৈরী হচ্ছে। বিক্রেতারা জানান, ঈদের দুদিন আগে থেকে সেমাই ও লাচ্চা বিক্রি হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। অল্প সময়ের মধ্যে মানুষ সেগুলো কেনে বলে আসল বা নকল তা খেয়াল করে না। এই সুযোগটাই নেন তারা। কিছু কিছু নামীদামী কোম্পানীর সেমাইয়ের দাম বেশি। ভেজালকারবারীরা ওই সব কোম্পানীর মোড়কে ভরে ভেজাল সেমাই, লাচ্চা কম দামে বিক্রি করে। তুলনামুলক কম দাম হওয়ায় ক্রেতাদের কাছে সেগুলোর চাহিদাও থাকে বেশি। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম জানান, রমজানে কমপক্ষে ৩০টি খাদ্য ও পণ্য সামগ্রীকে টার্গেট করে অভিযান পরিচালিত হয়েছে। সেই তালিকায় সেমাই, লাচ্চা, দই, মিষ্টিও রয়েছে। অভিযানের লক্ষ্যে আমাদের কর্মতৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে, ঈদ উপলক্ষে প্রসাধনী সামগ্রীসহ বিভিন্ন বাহারি নকল পণ্যের বিক্রিও বেড়েছে। রাজধানীর অভিজাত শপিং সেন্টার থেকে শুরু করে শহর-বন্দর, প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাটবাজার পর্যন্ত সর্বত্রই বিক্রি হচ্ছে নকল পণ্য। বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে বিক্রি বেড়েছে বড় সাইজের টেলিভিশনের। সেনগুলোও নকল হচ্ছে। নকলেরভিড়ে আসল পণ্য এখন অনেকটাই উধাও। শিশুদের চকলেট ও গুঁড়া দুধ, ঘি, আটা, তেল, সাবান, মধু, মসলা, দই, মিষ্টি থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী, নিত্যব্যহারের কসমেটিকস, এনার্জি সেভিং বাল্ব, মোবাইল ফোন, ফ্রিজসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স ও খেলনা সামগ্রীও নকল হচ্ছে। নকল সামগ্রী মানেই কোনো ব্রান্ডেড কোম্পানীর সামগ্রী হুবুহু প্যাকেট করে বাজারজাত করা। চোখ ধাঁধানো নকল সামগ্রীর ঝকমকে প্যাকেটের সামনে আসল পণ্য পাত্তাই পায় না। হাইটেক সামগ্রীসহ সব ধরনের নকল পণ্য রাজধানীর ফুটপাতেও পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নকলের প্রবণতা বন্ধ করতে হলে আইনের সঠিক প্রয়োগসহ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার। ভোক্তারা যদি সচেতন হয়ে সংঘবদ্ধভাবে নকল পণ্য বা ভেজাল খাদ্যকে বর্জন করে তাহলে এর দাপট আর থাকবে না। যারা অধিক মুনাফার আশায় এগুলো তৈরী করছে তারা নিরাশ হতে হতে একদিন এই ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে।
বিএসটিআই এর একজন কর্মকর্তা জানান, এক সময় পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকায় ৫৩ রকমের নকল প্রসাধনী তৈরী হতো। ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালিত হওয়ার পর এখন আর আগের মতো নকল জিনিস তৈরী হচ্ছে না। তবে একেবারে যে বন্ধ হয়েছে তাও নয়। বিএসটিআই-এর ওই কর্মকর্তা জানান, কয়েক বছর আগে চকবাজারের খান মার্কেটে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছুসংখ্যক ব্যবসায়ীকে জেল জরিমানা করা হয়। মালিক সমিতির কিছু ব্যবসায়ী নকল সামগ্রীর ব্যবসা ছেড়ে দেয়ার অঙ্গীকারও করেন। কিন্তু বন্ধ করা যায় নি নকলের তৎপরতা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এখন চীনের তৈরী খেলনা সামগ্রী থেকে শুরু করে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সব সামগ্রীর নকলের মহোৎসব চলছে। ঢাকার বাইরে এগুলো বিক্রি হয় বেশি। চকবাজার থেকেই পাইকাররা সেগুলো কিনে নিয়ে যায়। দেশের গ্রামে-গঞ্জে, হাট-বাজারে ‘চায়না’ বলেই বিক্রি হয় এসব। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার নকল কারখানাগুলোর দিকে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান পরিচালিত হওয়ার পর অনেক নকল কারবারী সেখান থেকে কারখানাগুলো অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে কিছু কারখানা কেরানীগঞ্জ, টঙ্গী, সাভার, রুপগঞ্জসহ ঢাকার আশেপাশে স্থানান্তর করা হয়েছে। আবার সেখানেও নিরিবিলিতে ধরা পড়ার ভয়ে কেউ কেউ যাত্রাবাড়ী, ডেমরা ও মুগদার ব্যস্ত ও ঘিঞ্জি এলাকাকে বেছে নিয়েছে। যাত্রাবাড়ীর মীরহাজিরবাগে অনেক আগে থেকেই আছে নকল ফ্যানসহ ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি তৈরীর কারখানা। রায়েরবাগে আছে নকল খাঁটি গাওয়া ঘি, মধু, দই ও মিষ্টির কারখানা। দনিয়া ও পাটেরবাগ এলাকায় নকল মশার কয়েল, ঘি, গুড়, হারপিক, খাবার স্যালাইন, ভিটামিন ওষুধ, সুইচ, ছকেট, হোল্ডার কারখানা আছে বেশ কয়েকটি। আছে শতাধিক নকল মিনারেল ওয়াটারের কারখানা। মুগদা ও মান্ডাতে নকল সোয়াবিন তেল থেকে শুরু করে নকল ডিটারজেন্ট পাউডার পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে অবাধে। পুরান ঢাকার নর্থ সাউথ রোডের অলিতে গলিতে তৈরী হচ্ছে নকল টিভি, ফ্রিজ, এনার্জি সেভিং বাল্ব, মোটর, ফ্যান, এয়ারকন্ডিশন মেশিনসহ বিভিন্ন দামী ইলেকট্রিক সামগ্রী। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বিউটিশিয়ানদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নকল প্রসাধনী সামগ্রী ব্যবহারে ত্বকের সমস্যা জটিল হয়, দেহে ছড়িয়ে পড়ে নানা ধরণের রোগ। এসব তৈরিতে এসিড, পানি, মোম, সুগন্ধি ও পারফিউমের অতিরিক্ত ব্যবহার করা হয়। মোমের পরিমাণ বেশি হলে তা ত্বকে ঢুকে লোমক‚প বন্ধ করে দেয়। ফলে মেছতা, ব্রন, ফাঙ্গাস জাতীয় রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। মার্কারিযুক্ত প্রসাধণী ব্যবহারে সরাসরি স্কিন ক্যান্সারের আশঙ্কা থাকে। নকল প্রসাধণী তৈরিতে নিম্নমানের ভেজাল সামগ্রী ব্যবহার করায় চুলকানি, ফোস্কা পড়া, ত্বকের প্রদাহ, সংক্রমণ এসব নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
জানা গেছে, একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীরা জেনেশুনেই অতি লাভের আশায় নকল পণ্যবিক্রি করেন। প্রতারিত হন ব্যবহারকারী বা ক্রেতারা। থাইল্যান্ডের বিখ্যাত হেড অ্যান্ড শোল্ডার, যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি প্যান্টিন প্রো-ভি শ্যাম্পু ও ডাভ ক্রিম বা ভারতের গার্নিয়ার শ্যাম্পুসহ বিভিন্ন ব্রান্ডের ক্রিম, লিপস্টিক, লোশন দেদারছে বিক্রি হচ্ছে রাজধানীর চকবাজার ও মৌলভীবাজারে। সেখানকার শতাধিক পাইকারি দোকানে এসব পণ্য মূল দামের অর্ধেক দামে বিক্রি হয়। তবে এগুলো সবই নকল। পণ্যের প্যাকেট বা বোতল ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করেও আসল-নকল বোঝারও উপায় থাকে না। কদমতলীর মুরাদপুরের এক বাড়ীতে তৈরী হচ্ছে এসব বিদেশি ব্রান্ডের প্রসাধন সামগ্রী ও পারফিউম।
ভুক্তভোগীরা মনে করেন, এবারের রমজানে ভেজালবিরোধী অভিযানে ভেজালের প্রবণতা অনেকটাই কমেছে। বিশেষ করে কেমিক্যাল দেয়া আম আর মানুষকে কিনতে হয়নি। এভাবে অভিযান অব্যাহত থাকলে নকল পণ্যের দাপট কমতে বাধ্য। জানতে চাইলে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম ইনকিলাবকে বলেন, ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে খাদ্য সামগ্রীতে ভেজালের মতো পণ্যসামগ্রীতেও নকলের প্রবণতা আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক কমেছে। তবে এখনও যে তৈরী বা বিক্রি হচ্ছে না তা বলা যাবে না। এ প্রসঙ্গে কনজুমার কেয়ার সোসাইটির (সিসিএস) উপদেষ্টা প্রফেসর ডা. আব্দুর রহমান (পিএইচডি) বলেন, নকলের প্রবণতা আমাদের দেশের তৈরী পণ্যের ভবিষ্যত নষ্ট করে দিচ্ছে। এগুলো বন্ধের জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি আইনের প্রয়োগ দরকার।

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভেজাল

৩ নভেম্বর, ২০২২
১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২
১১ জানুয়ারি, ২০২২
১১ জানুয়ারি, ২০২২
২৩ অক্টোবর, ২০২১
২২ অক্টোবর, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ