Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

শত নারী ইয়াবা ব্যবসায়ী

০ সারাদেশে সক্রিয় শতাধিক ০ ডেরায় হানা দিলেও ধরা পড়ছে না কেউ

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ৯ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

দেশে শতাধিক নারী ইয়াবা ব্যবসায়ী শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। সীমান্ত থেকে রাজধানী পর্যন্ত এদের বিশাল নেটওয়ার্কে সক্রিয় রয়েছে চার শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী। যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। এ নারী ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সাথে শক্ত নেটওয়ার্ক রয়েছে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথিপয় দুনীতিবাজ কর্মকর্তার। একই সাথে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদফতরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সাথেও এদের সখ্যতা রয়েছে। সারাদেশে মাদক বিরোধী অভিযান চললেও নারী ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ডেবায় হানা দিয়ে গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এসব অভিযানে শুধু মাদক উদ্ধার করেই সন্তুষ্ট থাকরেত হচ্ছে অভিযানের সাথে সংশ্লিষ্টদের। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশনস) সহেলী ফেরদৌস দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, মাদকের সাথে সম্পৃক্ত কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। মাদক ব্যবসায়ী নারী না পুরুষ সেটি বড় কথা নয়, যারা মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত তাদের গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
শীর্ষ নারী ইয়াবা ব্যবসায়ীরা ধরা পড়ছে না কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইয়াবা ব্যবসায়ীরা সর্তক থাকে বলেই তাদের গ্রেফতার করতে অনেক সময় নানা কৌশল অবলম্বন করতে হয়। তবে সে যেই হউক আইনের আওতায় তাকে আনাই হবে। এছাড়া এদের সাথে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী বা অন্য কারো সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে ছাড় দেয়া হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তা জানান, এক সময় ইয়াবার সঙ্গে নিকিতার নাম শোনা যেত। এখন আর আলোচনায় নেই সে। তবে অনেক নারী অল্প সময়ে অনেক টাকা আয়ের সুযোগ হিসেবে শুরু করেছে ইয়াবা ব্যবসা। যারা এরই মধ্যে দখল করেছে নিকিতার জায়গা।
আইন-শৃংখলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে ইয়াবা কারবারে জড়িত ৩৯ জন নারী। তারা প্রত্যেকে ১৫ থেকে ২০ শিশু, নারী-পুরুষ বাহকের মাধ্যমে ইয়াবার চালান পাঠিয়ে আসছে বিভিন্ন জায়গায়। রাজধানীকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে এসব চক্র। পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকায় উঠে এসেছে রাজধানীকেন্দ্রিক এ রকম ২৫ নারী মাদক ব্যবসায়ীর নাম। তাদের মধ্যে ২২ জন পলাতক। বাকি তিনজন কারাগারে রয়েছে।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, অপরাধ কে করেছে, সেটা মুখ্য। এখানে কারও অন্য কোনো পরিচয় দেখার সুযোগ নেই। নারী মাদক ব্যবসায়ীদেরও কঠোর আইনের আওতায় আনা হবে।
সিএমপির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (জনসংযোগ) অলক বিশ্বাস জানিয়েছেন, গত ৭জুন বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম মহানগরীর ষোলশহর আবাসিক এলাকার রিদোয়ান ম্যানশনের ৬ষ্ঠ তলায় মাদক সম্রাজ্ঞী শাবনুরের ৬বি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে ৭৫টি মোবাইল ফোন ও নগদ ৫ লাখ টাকা উদ্ধার করা হলেও তিনি পালিয়ে যান। অভিযানে বাসায় ইয়াবাও পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে শাবনুর শুধু ইয়াবা ব্যবসায়ী বা মাদক সম্রাজ্ঞীই নয়, মোবাইল ফোন চোকারকারবারীও। মাদক চক্রের পাশাপাশি তার মোবাইল ফোন চোরাই চক্রও রয়েছে। শাবনুরকে গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
গত ৫ জুন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ি বস্তিতে মাদক বিরোধী অভিযান চালায় পুলিশ। পুলিশের তালিকাভূক্ত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী মনিরা বেগমকে খুঁজতে গিয়ে তার কক্ষটি খুঁজে পায় পুলিশ। অভিযানে অংশ নেয়া তেজগাঁও জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (এসি) আবু তৈয়ব মোহাম্মদ আরিফ হোসেন বলেন, বাঁশবাড়ি বস্তির শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী মনিরা বেগমের খোঁজে তার বাসার দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করি আমরা। সেখানে ঢুকে চোখে পড়ে রুমে এক কোণায় দুটি এয়ারকুলার, এলইডি টিভি, ফ্রিজ। ওয়াইফাই কানেকশনও সেখানে রয়েছে। সেখানে কক্ষটির চিত্রে বিস্মিত সবাই। বস্তিবাসী পুলিশকে জানায়, মনিরার একটি গাড়িও আছে। পুলিশ বলছে, মনিরা বেগম মাদকের কারবার করেই টাকা পয়সা কামিয়েছেন। মাদকের বিশেষ অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে মনিরা বেগম গা ঢাকা দিয়েছে বলে ওই কর্মকর্তা জানান। তবে অভিযোগ রয়েছে যে, মাদক বিরোধী অভিযানে খবর আগেই পেয়ে যায় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী মনিরা বেগম।
গোয়েন্দা ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছে সবুজবাগের সুফিয়া আক্তার শোভা (৫০)। স্বামীর নাম আইয়ুব আলী। মাদক ব্যবসায় তার রাজত্ব সবুজবাগের ওহাব কলোনি ঘিরে। তার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ১০টি মামলা রয়েছে। নারী মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায় রয়েছে শামসুন্নাহার চম্পা। স্বামীর নাম মো. বাবুল ওরফে ফর্মা বাবুল। সবুজবাগ ঘিরে চম্পাও দীর্ঘদিন ধরে মাদক কারবার চালিয়ে আসছে। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ১৬টি। ধনাঢ্য নারী ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছে রহিমা। রহিমা বেগমের জন্ম ছোবাপট্টি বস্তিতে। মাদক ব্যবসা করে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ১০টি বাড়ির মালিক হয়েছে সে। তার রয়েছে একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি। ব্যাংকেও নামে-বেনামে অনেক অর্থ রয়েছে তার। রহিমার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা রয়েছে ছয়টি। সায়েদাবাদ ওয়াসা কলোনিতে মাদক ব্যবসার নারী গডফাদার হলো সুফিয়া আক্তার সুফি (৪৫)। স্বামীর নাম আক্তার হোসেন। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ছয়টি। সুফিয়া বর্তমানে কারাগারে। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন বস্তি এলাকায় মাদকের ব্যবসা করে জমিলা খাতুন। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে সাতটি। সবুজবাগ এলাকার মাদকের আরেক নারী গডফাদার হলো তানিয়া বেগম। তার বিরুদ্ধে মামলা আছে সাতটি। মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের নারী গডফাদার হলো ফারহানা আক্তার পাপিয়া। স্বামীর নাম জয়নাল আবেদীন পাচু। স্বামীর সঙ্গে মিলেমিশে দীর্ঘদিন ধরে জেনেভা ক্যাম্পে রমরমা ব্যবসা করছে সে। তার বিরুদ্ধে মামলা আছে চারটি। ভাসানটেক বস্তিতে মাদকের ব্যবসা করছে মোর্শেদা। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ১৩টি। রূপনগরের দুয়ারীপাড়ায় মাদকের ব্যবসা করছে সালেহা বেগম। তার বিরুদ্ধে রূপনগর থানায় মামলা রয়েছে ২২টি। কামরাঙ্গীরচরে মাদকের নারী গডফাদার শাহিনুর রহমান। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ১৫টি। কারওয়ান বাজার বস্তিতে মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে শিল্পী। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে সাতটি। সে বর্তমানে কারাবন্দি। কারওয়ান বাজারের আরেক নারী মাদক ব্যবসায়ী আকলিমা আক্তার। কাফরুলে মাদকের নারী গডফাদার জ্যোৎস্না বেগম। তার বিরুদ্ধে চারটি মামলা রয়েছে। ভাসানটেকের ধামালকোট এলাকায় মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করছে স্বপ্না। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে আটটি। স্বপ্না বর্তমানে জেলে আছে। কলাবাগান এলাকায় মাদকের গডফাদার শাহানাজ। তার বিরুদ্ধে মামলা সাতটি। ঢাকার আরেক আলোচিত নারী মাদক ব্যবসায়ী খুরশিদা বেগম ওরফে খুশি। স্বামীর নাম মিজান ওরফে গোল্ডেন মিজান। মিরপুরের কালাপানি, পল্লবী, নিউমার্কেট ও কামরাঙ্গীরচর এলাকায় মাদক ব্যবসা করে সে। নিউমার্কেট এলাকার আরেক মাদক ব্যবসায়ী হাসি বেগম। হাজারীবাগের চিহ্নিত নারী মাদক গডফাদার হলো বীণা। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ১২টি। একই এলাকার আরেক নারী মাদক কারবারি হলো নূর নাহার নুন্নী। তার বিরুদ্ধে মামলা আছে ১০টি। এ ছাড়া হাজারীবাগে মাদক ব্যবসা করছে জমিলা ওরফে জামেলা বেগম। তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা রয়েছে। রাজধানীর কোতোয়ালি এলাকায় মাদক ব্যবসা করছে পারুলী রানী। তার বিরুদ্ধে মামলা আছে পাঁচটি। খিলক্ষেত এলাকায় মাদক ব্যবসা করছে নাজমা বেগম। তার বিরুদ্ধে মামলা ১৯টি। এ ছাড়া রাজধানীতে মাদকের নারী গডফাদার হলো ফারজানা ইসলাম স্বপ্না। হাতিরপুলে টাইলসের ব্যবসার আড়ালে স্বপ্না দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবার কারবার করে আসছে। আরও যারা নারী মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে- ঢাকার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ইশতিয়াকের স্ত্রী পাখি বেগম, আসমা আহমেদ ডালিয়া, আনোয়ারা বেগম আনু, নার্গিস, পারভীন আক্তার, ইতি বেগম, মরিয়ম ওরফে কুট্টি, মিনা বেগম ও মাহমুদা খাতুন। এ ছাড়া কক্সবাজারের বাসিন্দা আয়েশা বেগম (৪২) বড় মাদক ব্যবসায়ী। মাদক ব্যবসায়ীরা তাকে ‘বড় আম্মা’ বলে চেনে। তার সিন্ডিকেটের সদস্য হয়ে আরও যারা এ ব্যবসায় জড়িত তারা হলো- চট্টগ্রামের নূর আয়শা, বার্মার সুলতানা রাজিয়া, টেকনাফের মুন্নী তাহের ও মোহাম্মদ, নারায়ণগঞ্জের দেলোয়ার, টঙ্গীর আমিরুল, যাত্রাবাড়ীর বাবু, কুমিল্লার রবিন ও খোকন ও নারায়ণগঞ্জের সানারপাড়ার রিপন। নারী মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায় রয়েছে কক্সবাজারের সানজিদা বেগম, তার বোন লায়লা বেগম, স্থানীয় বাবুল মেম্বারের স্ত্রী সালেহা বেগম, শামসুননাহার। তাদের ব্যবসাও মূলত রাজধানীকেন্দ্রিক।



 

Show all comments
  • পাবেল ৯ জুন, ২০১৮, ২:৪৭ এএম says : 0
    নারী হোক বা পুরুষ, কোন মাদক ব্যবসায়িকে ছাড় দেয়া যাবে না।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শত নারী
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ