Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপকূলের বন বেপরোয়া ধ্বংস

দেড় দশকে ৪৫ ভাগ ঝাউবীথি উজাড় : ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকিতে ৪ কোটি মানুষ : হুমকিতে জনবসতি উদ্ভিদ জীববৈচিত্র্য

প্রকাশের সময় : ১১ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শফিউল আলম : সাগর উপকূলের জনগণের জন্য দুর্যোগে প্রাকৃতিক ‘ঢাল’ বা ‘বর্ম’ বন-জঙ্গল বেপরোয়াভাবে ধ্বংস করে চলেছে সংঘবদ্ধ বনখেকো দুর্বৃত্তরা। বৃহত্তর নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকু-, সন্দ্বীপ, বন্দরনগরীর হালিশহর-কাট্টলী, আনোয়ারার পার্কি থেকে শুরু করে কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, কক্সবাজার সদর, উখিয়া-টেকনাফ-সেন্টমার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে প্রতিনিয়তই চলছে এই ভয়াবহ ধ্বংসলীলা। কক্সবাজারে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের সুশোভিত ঝাউবিথি উজাড় করে দেয়া হচ্ছে বন বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের নাকের ডগায়। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ দিক-নির্দেশনায় কক্সবাজার সাগর সৈকতকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ সুরক্ষা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি রোধে সেখানে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল ঝাউ-বীথি। এখন তা অনেকটাই ফাঁকা হয়ে গেছে। সেই ঝাউবন গত দেড় দশকে ধ্বংসের কালো হাত থেকে রেহাই পায়নি।
বিগত দেড় দশকের ব্যবধানে সাগর সৈকত ও আশপাশ এলাকায় প্রায় ৪৫ শতাংশ ঝাউবীথি উজাড় হয়ে গেছে এবং ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে প্যারাবন একথা বিভিন্ন এনজিও’র জরিপ-গবেষণা সূত্রে জানা গেছে। তদুপরি গত ১৫ বছরে বন ধ্বংসকরণ প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণরূপে বিরান হয়ে গেছে ‘চকরিয়ার সুন্দরবন’। উপকূলীয় ঝাউবন-বীথি আর প্যারাবন, ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের পাশাপাশি কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে সৈকত ঘিরে থাকা প্রকৃতির প্রাচীর পাহাড়-টিলা কেটে-খুঁড়ে সাবাড় করে দেয়া হচ্ছে। অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নীরব-নির্বিকার রয়েছে। ‘বনের ডাকু’দের পাশাপাশি সাগর উপকূলে, খাল ও খাড়িতে চলাচলকারী দেশীয় কার্গোজাহাজ, ট্যাংকার, কোস্টার, ট্রলারসহ বিভিন্ন যান্ত্রিক নৌযানের বর্জ্যতেল কিংবা পোড়া জ্বালানি তেলের নিঃসরণ অহরহ ঘটছে। এ কারণে উপকূলের গাছপালা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে গতকাল (রোববার) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের পরিচালক প্রফেসর ড. খালেদ মিসবাহুজ্জামানের সাথে আলাপকালে তিনি দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, সার্বিকভাবে উপকূলীয় বন হুমকির মুখে রয়েছে। জাতীয় স্বার্থে উপকূলীয় বনায়ন অব্যাহত রাখার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। যেকোন মূল্যে আমাদের উপকূল সুরক্ষা করতে হবে। অবশ্য সরকার বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে এই প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।   
এদিকে পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্যের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনের তুলনায় খুব সামান্যই রয়েছে উপকূলের বন-জঙ্গল। অথচ এই বন (যেমন- সুন্দরবন) ‘সিডর’, ‘আইলা’র মতো ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসকে নিজের বুক তছনছ করে হলেও ঠেকিয়ে দেয়। তেমনি উপকূলীয় বন প্রাকৃতিক বর্মের মতোই আগলে রেখেছে দেশের বিস্তীর্ণ সমুদ্র উপকূলভাগ। কিন্তু তা সত্ত্বেও নির্বিচারে ধ্বংস করা হচ্ছে সাগর উপকূলের বনভূমি। হুমকির মুখে পড়েছে বন্য জীবজন্তু পাখ-পাখালির নিরাপদ চারণভূমি, বিরল ও মূল্যবান উদ্ভিদরাজ্য, হরেক জীববৈচিত্র্য। এতে করে ৪ কোটিরও বেশি উপকূলবাসী প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা, তাদের জীবন-জীবিকা, জনবসতির ওপর ঝুঁকির মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রাকৃতিক বর্ম বৃক্ষরাজির ঢাল যতই বিপন্ন হচ্ছে ততই উপকূলীয় ভূমির গঠন দুর্বল হয়ে পড়ছে। আকার-আয়তনেও হ্রাস পাচ্ছে। বিনষ্ট হচ্ছে মাটির গুণাগুণ। অরক্ষিত হয়ে পড়েছে সমগ্র উপকূল। টেকনাফ কিংবা সীতাকু-ের সমুদ্রসৈকতে ঝাউগাছ, কেওড়া গাছ কেটে ফেলার মধ্যেই শুধুমাত্র উপকূলের বন উজাড় প্রক্রিয়া থেমে নেই। বরং বঙ্গোপসাগর উপকূলভাগে চর ও দ্বীপাঞ্চলজুড়ে দেশের ৭১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তটরেখা বরাবর বন-জঙ্গল কেটে ফেলে উপকূলভাগকে ক্রমেই বৃক্ষশূন্য করা হচ্ছে।
মারাত্মক এ ধ্বংসযজ্ঞ চলছে দীর্ঘদিন যাবৎ। অতিলোভী কাঠ ব্যবসায়ী, চোরাকারবারী ও ভূমিদস্যুদের সংঘবদ্ধ চক্র গাছপালা অবাধে নিধন করেই চলেছে। এদের সাথে সরাসরি যোগসাজশ রয়েছে বন বিভাগের বেপরোয়া দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী। উপকূলীয় বন বিভাগ পরিণত হয়েছে হরিলুটের আখড়ায়। সরকারি যথাযথ তদারকির অভাবে অনিয়মই সেখানে নিয়মে পরিণত হয়েছে। দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার কোন বালাই নেই। উপকূলে বনায়ন আর পরিচর্যার নামে নয়-ছয় গোঁজামিল করে কোটি কোটি টাকা পকেটে ভরছে দুর্নীতিবাজ চক্রটি। উপকূলে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল রক্ষা করার বদলে ভক্ষকের ভূমিকায় পালন করেও অসৎ চক্রটির কারো বিরুদ্ধে কোনরকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না।
উপকূলীয় অঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের কিনারভাগে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ছাড়াও উপকূলের কাছাকাছি এলাকায় অবস্থিত পাহাড় টিলা বা উঁচুনিচু ভূমি কাটা হচ্ছে সমানে। বন-জঙ্গলে গাছপালা আশংকাজনক হারে কমে গেছে। গত প্রায় এক দশকে ১৫-২০ প্রজাতির গাছপালা বিলুপ্ত হয়ে গেছে অথবা বিরল দৃষ্টিগোচর হচ্ছে।
বন বিশেষজ্ঞ সূত্র মতে, উপকূলে গাছপালা কমে যাওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন প্রজাতির পাখ-পাখালি, জীবজন্তু, হরেক জীববৈচিত্র্যের বিচরণ, বসতি ও বংশবৃদ্ধির হারও কমে যাচ্ছে। এ কারণে সামগ্রিকভাবে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। এককালে এমনকি দ্ইু-এক দশক আগেও দেখা যেতো বিভিন্ন পাখির গাছের বিচরণ করে ফলমূল খেতে গিয়ে গাছের উপর থেকে যে বিষ্ঠা ছড়িয়ে দিয়েছে তাতেই বট, অশ্বথ, আম-জামসহ বহু জাতের গাছপালা গজিয়ে উঠেছে। মানুষের হাতের ছোঁয়া বা কোন যতœ ছাড়াই গাছগুলো বড় হয়ে ঘন বৃক্ষরাজিতে আচ্ছাদিত হয়েছে ছোট ছোট পাহাড়, উপকূল। কিন্তু ইদানিং পাখির বিচরণযোগ্য বৃক্ষরাজি কমে আসার সাথেই এভাবে বৃক্ষ বাড়ছে না।
কালক্রমে হরেক জাতের গাছপালা বাংলাদেশের উপকূল সংলগ্ন পাহাড় টিলা ও উঁচুনিচু উপত্যকাময় উর্বর পললভূমি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। শুধু কেওড়া বা ঝাউবীথি নয়- উপকূলে বা এর কাছাকাছি এলাকাগুলোতে যেসব গাছপালা এখন প্রায় বিলুপ্তির মুখে এর মধ্যে রয়েছে, বাবলা, হরতন, বট, অশ্বথ, মান্দার, তেলসুর, চাপালিশ, গামার, মেহগনি, বহেরা, নিম, তেঁতুল, জাম, ঢাকিজাম, শিমূল, শিশু, কাও, ডালিম, বাইন, হারতকি, গাব প্রভৃতি। গাছাপালা কমে গিয়ে মানুষের বন্ধু পাখি, পোকা ও জীবজন্তু তাদের বংশ বিস্তারের পরিবেশ হারিয়ে ফেলছে।
বন ও পরিবেশ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. খালেদ মিসবাহুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে একটি ব-দ্বীপ হওয়ায় এখানে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। শিপব্রেকিং খাত, চিংড়ি ঘের, ছিন্নমূল মানুষের বসতির জন্যও উপকূলের বনরাজি, ঝাউবনও কেটে ফেলা হচ্ছে। তাছাড়া ভূমি দখল হচ্ছে বিভিন্ন উপায়ে। তিনি জানান, উপকূলীয় অঞ্চলে যেখানে চারা টিকবে সেখানেই শুধু রোপন, যেখানে টিকবে না সে জায়গাগুলো এড়িয়ে যাওয়ার একটি নেতিবাচক প্রবণতা বন বিভাগের মাঝে দেখা যায়। এভাবে পূর্ণাঙ্গ বন সৃজন হয় না। যেমন- সীতাকু-, মিরসরাই এলাকা। পূর্ণাঙ্গ বন সৃজনের দিকেই গুরুত্ব দিয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

















































 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: উপকূলের বন বেপরোয়া ধ্বংস
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ