Inqilab Logo

বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে খুনের ঘটনা

প্রকাশের সময় : ১১ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৫৯ পিএম, ১০ এপ্রিল, ২০১৬

স্টাফ রিপোর্টার : আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে খুনের ঘটনা। শুধু পেশাধার খুনি কিংবা দুর্বৃত্তদের হাতেই নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে খুন হচ্ছেন নিরীহ মানুষ। একটা খুনের ঘটনার কূলকিনারা হতে না হতেই ঘটছে আরো খুন। চলতি বছরের ৩ মাস ৯ দিনের মধ্যে রাজধানীসহ সারাদেশে ১৪৫ শিশুসহ ৬৩৭ জন খুনের শিকার হয়েছেন। এসব খুনের মধ্যে দেশ-বিদেশে সর্বাধিক আলোচিত হচ্ছে কুমিল্লায় তনু হত্যা, বাঁশখালীতে নির্বিচারে গুলি করে ৫ গ্রামবাসীকে হত্যা, প্রকাশ্য দিবালোকে চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খুন, পুরান ঢাকায় মসজিদে বেলাল হোসেন নামের একজন মুয়াজ্জিনকে হত্যা এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র নাজিম উদ্দিন হত্যাকা-। বিশিষ্ট আইনজীবী ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুনের ঘটনায় অপরাধীদের যথাযথ বিচার হচ্ছে না। খুনের ঘটনার তদন্ত কার্যক্রমে পুলিশের অবহেলা, স্বজনপ্রীতি এবং অর্থের বিনিময়ে চার্জশিট থেকে খুনিদের বাদ দেয়ার কারণে খুনিরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক নেতাদের অবৈধ হস্তক্ষেপ এবং একশ্রেণীর দলবাজ পুলিশের স্বজনপ্রীতি ও ঘুষ লেনদেনের কারণেও খুনিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। তারা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে যারা খুন হয়েছেন তাদের খুনের বিচার হয়নি। সাগর-রুনি, বিশ্বজিৎ, অভিজিৎ রায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল কাসেম ফজলুল হকের ছেলে দীপেন হত্যাকা-সহ শতাধিক আলোচিত হতাকা-ের বিচার হয়নি। পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলা নির্যাতনের এক বছর পরও অপরাধীরা গ্রেফতার হয়নি। এসব কারণে খুনখারাবি আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে বলে দাবি করছেন একাধিক আইনজীবী।  
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, শতভাগ অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব নয়, তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অপরাধীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। সব কয়টি আলোচিত খুনের ঘটনায় তদন্ত হচ্ছে এবং পুলিশ, ডিবি, সিআইডি ও র‌্যাব খুনিদের গ্রেফতারে তৎপর রয়েছে। অনেক খুনের ঘটনায় অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি বলেন, বাঁশখালীর ঘটনায় মামলা হয়েছে এবং অপরাধীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।
আকস্মিক হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া রাজধানীর ঝব্বু খানম জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন বেলাল হোসেন (৫০) নিরাপত্তা চেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন। এর নয় মাসের মাথায় মসজিদের ভেতরেই খুন হলেন তিনি। গত সোমবার সকালে তার রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
পুরান ঢাকার ২৪ নম্বর ইসলামপুর রোডের চারতলা একটি ভবনের ওপরের তিনতলাজুড়ে ঝব্বু খানম মসজিদ, নিচতলায় মার্কেট। মসজিদের তৃতীয় তলার এক পাশে তিনটি কক্ষ। এর পশ্চিম পাশের কক্ষটিতে থাকতেন বেলাল হোসেন। প্রায় ৩২ বছর যাবৎ এই মসজিদে মুয়াজ্জিন ছিলেন তিনি। খুন হওয়ার আগে রাতে এশার নামাজ শেষে বেলাল মসজিদ থেকে বের হয়ে যান। ওই রাতে কোনো এক সময় তিনি মসজিদে ফেরেন। গতকাল ফজরের নামাজ পড়তে গিয়ে সারোয়ার নামে স্থানীয় এক মুসল্লি বেলালকে রক্তাক্ত অবস্থায় সিঁড়ির ওপর পড়ে থাকতে দেখেন। পরে তার মাধ্যমে অন্যরা খবর পান।
৫ এপ্রিল রাত ৯টা ১০ মিনিটে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ফেসবুকে লিখেছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র নাজিম উদ্দিন। এর ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই খুন হলেন তিনি। গত বুধবার পুরান ঢাকায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করা হয় তাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নূর মোহাম্মদ বলেন, হত্যাকা-ে জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেফতার করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ  থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারী জোনের উপ-কমিশনারকে চিঠি দেয়া হয়েছে।
পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, ‘ফেসবুকে লেখালেখির কারণেই তাকে হত্যা করা হতে পারে বলে আমরা ধারণা করছি। তবে হত্যার পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে পুলিশ-গ্রামবাসীর সংঘর্ষের ঘটনায় নিহতদের স্বজনদের শোকের মাতম থামতে না থামতেই সিলেটের বিয়ানীবাজরে নিহত নাজিমের বাড়িতে চলছে কান্না আর আহজারি।
শিশু, মসজিদের ইমাম, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শ্রমিক, রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, আইনজীবী, শিক্ষক এবং সাধারণ গ্রামবাসী কেউ রেহাই পাচ্ছেন না। অহরহ খুনের শিকার হচ্ছেন। যশোরে বন্ধুর ছুরিকাঘাতে হাসিব তরফদার জিন (১৮) নামের একজন কলেজছাত্র খুন হয়েছেন। যশোর শহরের রায়পাড়া কলোনি এলাকায় এই হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে। নিহত হাসিব সরকারি সিটি কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র। সে রায়পাড়া চোরমারা দীঘিরপাড় এলাকার আজিম তরফদারের ছেলে।
রাজশাহীর দুর্গাপুরে নাসিম উদ্দিন প্রামাণিক নামের এক কলেজছাত্রকে গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহত নাসিম উদ্দিন প্রামাণিক দুর্গাপুর উপজেলার পানানগর পূর্বপাড়া গ্রামের অসির উদ্দিনের ছেলে। তিনি ধরমপুর কলেজের ছাত্র ছিলেন বলে জানা গেছে। ২৯ মার্চ বুধবার ভোরে একই গ্রামের পাশে ব্রিজের নিচ থেকে তার লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে উপকূলীয় গন্ডামারা এলাকায় কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ নিয়ে এলাকাবাসীর সাথে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয় গত সোমবার। এ ঘটনায় নিহত হন ৫ জন।  নিহতরা হলেন গন্ডামারা ইউনিয়নের চরপাড়ার গন্ডামারা গ্রামের আশরাফ আলীর ছেলে মরতুজা আলী (৫২), তার ভাই আঙ্গুর আলী (৪৫), নুর আহমদের ছেলে জাকের আহমদ (৩৫), আবুল খায়েরের ছেলে জহির উদ্দিন (৪৫) ও অজ্ঞাত পরিচয় এক নারী।
এ রক্তাক্ত ঘটনায় আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি, ১৯ ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে পুলিশের চার সদস্যসহ মোট ১৪ জন চিকিৎসাধীন আছেন। আহতরা হলেন মুজিবুর রহমান (২০), আনসার উদ্দিন (৩০), জহির আলম (৩০), আবদুল খালেক (২৫), আবু খান (৫০),  মোতালেব (২৩), নুরুল ইসলাম (১৮)। পুলিশ সদস্যের মধ্যে আছেন মিরাজ উদ্দিন (২৮), নুরুল কবির (২৯), ওয়াসিম (২২), কনকচন্দ্র সিংহ (২৪)। তাছাড়া তিনজনের কোনো ঠিকানা পাওয়া যায়নি বলে হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ি সূত্রে জানা যায়।
বাঁশখালী থানা সূত্রে জানা যায়, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ ও সরকারি  লোকজনের ওপর হামলার ঘটনায় বাঁশখালী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) বাহার মিয়া বাদি হয়ে ৫৭ জনের নাম উল্লেখ ও ৩২০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি মামলা করেছেন। তাছাড়া নিহত দুই সহোদর ও জামাতার পরিবারের পক্ষে মাওলানা বশির আহমদ বাদি হয়ে ছয়জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত ১৪০০ থেকে ১৫০০ জনকে আসামি করে একটি এবং নিহত জাকের আহমদের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম বাদি হয়ে ১৮০০ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেছেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) হাবিবুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় তিনটি মামলা দায়ের হয়েছে।
এ বছরের প্রথম তিন মাসে দেশে ১৪১ শিশু খুন হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) মানবাধিকার লঙ্ঘনের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরেছে। আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত তিন মাসে ক্রসফায়ার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ৩২ জন মৃত্যুর মধ্যে ১৫টি ঘটেছে।
পুলিশের হাতে সংঘটিত ঘটনা ১২টি। বাকি চারটি ডিবি পুলিশ ও একটি ঘটনা ঘটে বিজিবির হাতে।  
প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিন মাসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ২৮০টি সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় নিহত হয় ৩৫ জন। এর মধ্যে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সংঘর্ষে নিহত হয় ২৯ জন। আহত হয় ৩ হাজার ৮৭৮ জন।
এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত শুধু চট্টগ্রাম নগরীতেই খুন হয়েছে ২৬টি। চাঞ্চল্যকর খুন, ছিনতাই, ডাকাতি, নারী ও শিশু নির্যাতন লাগামহীন পর্যায়ে রয়েছে। ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে এ পর্যন্ত ৫ শতাধিক আহত হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরে অপরাধ পর্যালোচনা সভায় সব মেট্রোপলিটন পুলিশের পুলিশ কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি, পুলিশ সুপার, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের প্রধান কর্মকর্তা এবং পুলিশ  হেডকোয়ার্টার্সের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ওই সভায় তিন মাসে সংঘটিত অপহরণ, খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, নারী ও শিশু পাচার, অস্ত্র উদ্ধার, মাদকদ্রব্য উদ্ধারসহ সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। পর্যালোচনার পর  দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।
বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, দেশে খুনখারাবি যে হারে বেড়েছে তা সত্যিই উদ্বেগের বিষয়। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আমরা অন্ধাকারে নিমজ্জিত হবো। তখন দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা কষ্টকর হবে। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে খুনের ঘটনা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ