Inqilab Logo

বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

‘প্রবীণ নিবাস’ নয় নিঃস্ব করার ফাঁদ!

মোঃ খলিল সিকদার, রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) থেকে | প্রকাশের সময় : ২ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

রূপগঞ্জে প্রবীণ নিবাসের আড়ালে প্রবীণদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের চনপাড়া পূর্ণবাসন কেন্দ্রের পাশে চনপাড়া চত্বরে গড়ে তোলা হয়েছে এ প্রবীণ নিবাস। দেশবাংলা কল্যান পরিষদ (ডিবিকেপি) নামে একটি এনজিও সংস্থার ট্রাস্টের অর্থায়নে এ বৃদ্ধাশ্রমটি গড়ে উঠেছে। তবে এ নিবাসের আড়ালে চলছে নানা প্রতারণা। এগারো তলার ভবনটি প্রবীণ নিবাসের জন্য কাগজে-কলমে দেখানো হলেও স্বল্পসংখ্যক ফ্ল্যাটে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে বৃদ্ধাদের। তাদের দেখভাল করার থাকলেও উল্টো তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে মোটা অংকের টাকা। বাকী ফ্ল্যাটগুলো মাসিক চুক্তিতে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। বৃদ্ধাশ্রমের নামে সরকারী- বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থা থেকে আসা অনুদানের টাকা যাচ্ছে ট্রাষ্টের চেয়ারম্যান আব্দুল খালেকসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালীর পকেটস্থ হচ্ছে। দুর্ণীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি প্রতিনিধি দল এ প্রবীণ নিবাস পরিদর্শন করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুস্থদের পূর্ণবাসন ও সামাজিক ভাবে হেয়প্রতিপন্ন বৃদ্ধ মা-বাবাদের আশ্রয়-প্রতিপালন করতে দেশবাংলা কল্যান পরিষদ (ডিবিকেপি) ট্রাষ্টের অর্থায়নে প্রবীণ নিবাস গড়ে তোলা হয় কায়েতপাড়ার চনপাড়া বটতলা এলাকায়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনে বিদেশী অনুদানে চনপাড়া মোড়ের বটতলা পাশে একটি ১১তলা, দুটি ছয়তলা ও একটি সাততলা বিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করা হয়। একটি ভবনে দেশ বাংলা কল্যাণ পরিষদ (ডিবিকেপি) নামে হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছে। হাসপাতালটি হঠাৎ বন্ধ হয় হঠাৎ চালু হয়। হাসপাতাল ছাড়া তিনটি ভবনে প্রবীণ নিবাস গড়ে তোলার কথা রয়েছে। তিনটি ভবনে এক হাজার প্রবীণের বসবাস করার সুযোগ রয়েছে। দেশবাংলা কল্যান পরিষদ (ডিবিকেপি) নামে এনজিও সংস্থাটির চেয়ারম্যান এম এ খালেক “প্রবীণ নিবাসের” নামে বিভিন্ন সরকারী- বেসরকারী সংস্থা থেকে আসা অনুদানের টাকা নিজেই আত্মসাৎ করছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া বৃদ্ধাশ্রমের নামে ফ্লাট ভাড়া দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। বৃদ্ধাশ্রমে থাকা বেশ কয়েজন নাম পরিচয় গোপন করে আসছে। নাম-পরিচয় গোপন রাখা লোকজনকে সন্দেহ করছে এলাকাবাসী। বৃদ্ধারশ্রমের নামে বিভিন্ন স্থান থেকে চাঁদা আদায় করারও অভিযোগ রয়েছে বলে গেছে।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ১১ তলা ভবনে ৪০ টি কক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে ১০ টি রুমে প্রবীণ রয়েছে। বাকীগুলো মাসিক তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা চুক্তি ভিত্তিতে ভাড়া দেওয়া আছে। সে হিসাবে মাসে প্রায় দেড় লাখ টাকা ভাড়া হাতিয়ে নেয় । আর বছরে প্রায় ১৮ লাখ টাকা। শুধু তাই নয়। প্রবীণদের জন্য সরকারী-বেসরকারী সংস্থা থেকে অনুদান আসলেও তা প্রবীণদের কাছ পর্যন্ত পৌছায় না।
এম এ খালেকের ঘনিষ্ট একটি সূত্র জানায়, যেসব প্রবীণ ব্যক্তির জায়গা-জমি কিংবা অঢেল টাকা-পয়সার মালিক থাকে কেবল তাদেরকেই প্রবীণ নিবাসে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে অনুমতি মেলে। যারা সহায়-সম্বলহীন তাদের এ প্রবীণ নিবাসে কোন আশ্রয় দেওয়া হয়না। ঐ সূত্রটি আরো জানায়, সম্পদের মালিক প্রবীণদের আশ্রয় দেওয়ার কারণ হিসেবে তাদের সম্পদ প্রতারণা করে হাতিয়ে নেওয়া হয়। অনেক প্রবীণ এ প্রবীণ নিবাসের কবলে পড়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে।
ডেন্টাল চিকিৎসক মেহেদী হাসান, বাবুল মিয়া, সুরুজ মিয়াসহ বেশ কয়েকজন ভাড়াটিয়ার সঙ্গে কথা হলে তারা জানায়, ১১তলা বিশিষ্ট বহুতল ভবনটি বৃদ্ধাশ্রমের জন্য হলেও এখানে বৃদ্ধার সংখ্যা কম। ভাড়াটিয়ার সংখ্যাই বেশি। প্রায় ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া দিয়ে বসবাস করে আসছেন লোকজন। তবে ফ্ল্যাট বাসা হওয়ায় অন্য ফ্ল্যাটে কি হচ্ছে তা তাদের জানার কোন উপায় নেই। কথা হয় ফ্ল্যাটের ৩০১ নম্বর ফ্ল্যাটের এক নম্বর রুমের প্রবীণ ভাড়াটিয়া কেরানীগঞ্জ এলাকার এ কে এম মাহাবুব আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, গত দুই বছর আগে এ প্রবীণ নিবাসে আমি আসি। আমার একটা সম্পদ ছিলো। এটা জানতো খালেক। বিনে পয়সায় আমাকে থাকতে দেয়। জমির বায়না পাওয়া ১৬ লাখ টাকা কৌশলে হাতিয়ে নেয় এম এ খালেক। এখন এ টাকা চাইতে গেলে নানা টালবাহনা করছে। এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ বিজ্ঞ আদালতে আর রূপগঞ্জ থানায় অভিযোগ দায়ের করেও কোন সুরাহা পাইনি। কথা হয় মিনা চক্রবতীর ( ছদ্মনাম) সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি একটি এনজিওতে চাকরি করতাম। আমার একমাত্র মেয়ে দেশের বাইরে থাকে। আমার নিকট থেকে ঐ প্রতারক এম এ খালেক নানা ছলচাতুরী করে ১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এ টাকা চাইতে গেলেই নানা ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদান করে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আর মরতে চাইনা। তাই ভয়ে ভয়ে দিন পার করছি।
দেশবাংলা কল্যাণ পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ খালেকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমার এবং বৃদ্ধাশ্রম বিষয়ে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সঠিক নয়। প্রবীণ মাহাবুব ও সহযোগীরা আমার বদনাম ছড়াতে এমন অপপ্রচার চালাচ্ছে।
রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ মনিরুজ্জামান মনির বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশের লোক জড়িত থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সোলায়মান মিয়া বলেন, দেশবাংলা কল্যান পরিষদ প্রবীণ নিবাস আমাদের এখতিয়ারে নেই। মন্ত্রণালয়ের লোকজন তদারকি করেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবরা যখন আসেন তখন আমরা খবর পেয়ে ওখানে যাই। উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আবুল ফাতে মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, কোন প্রবীণ আমার কাছে অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রবীণ নিবাস
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ