Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কর্মের মূল্যায়নে আশাবাদী ত্যাগীরা

দ্বিতীয় ধাপে গুরুত্বপূর্ণ ১৫ পদে নেতার নাম ঘোষণা : ১২ নতুন মুখ

প্রকাশের সময় : ১০ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফজাল বারী : দলের পরিচ্ছন্ন ও ত্যাগী নেতাদের প্রতি দেয়া অঙ্গীকার রাখছেন বিএনপির শীর্ষ নেতা বেগম খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। প্রতিপক্ষ দমনের জামানায় জীবন বাজি রেখে যারা দলীয় আদর্শ লালন এবং সংগঠনের দেয়া গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন তাদের ত্যাগের মূল্যায়ন করছেন নেতা-কর্মীদের এই দুই অভিভাবক।
ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে এবং এর আগে-পরে নিপীড়িত-নির্যাতিত নেতাদের আশস্ত করেছিলেন তাদের ত্যাগের মূল্যায়ন করবেন খালেদা জিয়া। গত ১৯ মার্চ দলের কাউন্সিলে ভিডিও বক্তব্যে তারেক রহমানও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দলের জন্য নেতাকর্মীর উজার করা প্রতিটি কর্মের মূল্যায়ন করা হবে। প্রতিপক্ষের সাথে আঁতাত না করে বা লোভ ত্যাগ করে যারা কর্মসূচি পালন করেছেন আগামীর নেতৃত্ব তাদের হাতেই তুলে দেয়া হবে। একই সাথে দলের ভেতর ঘাপঁটি মেরে থাকা বেঈমানদের বিতাড়িত করার জন্য দাবিও আমলে নিয়েছেন তারা। কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে নেতা নির্বাচনের বেলায় শীর্ষ দুই নেতাক প্রতিশ্রুতির বাস্তবতা মিলছে। ইতোমধ্যে দুই ধাপে দলের মহাসচিব, সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিবসহ ১৮ গুরুত্বপূর্ণ পদ যাদের স্থান দিয়েছেন তাতে বিএনপির আপোষহীন, ত্যাগী, দক্ষ ও পরিচ্ছন্ন নেতারা প্রচ- আশাবাদী হয়ে উঠছেন।
গতকাল বিএনপির ৭ যুগ্মমহাসচিব ও ৮ সাংগঠনিক সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। দুপুরে ওই পদগুলোতে নেতাদের নাম প্রকাশের পর আলাপকালে বিএনপির অর্ধডজন নেতা ইনকিলাবকে বলেন, দীর্ঘ প্রায় ৯ বছরের গুম, খুন, মামলা-হামলা, সহায় সম্পদ বেহাত, কারাবাস ও নির্যাতের ফলে হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে তা থেমে যাচ্ছে। কারণ শীর্ষ নেতৃত্ব ত্যাগের মূল্যায়ন করছেন। আমরা প্রচ- আশাবাদী। অবশ্য দুই-একজনকে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে বলেও তারা জানান।
দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে দীর্ঘ পাচ বছর নানা নিপীড়নের শিকার হয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। উচ্চ শিক্ষা, ব্যক্তি ইমেজ এবং দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ মানুষের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতার মূল্যায়ন করেছেন খালেদা জিয়া। গত ৩০ মার্চ মির্জা ফখরুলকে মহাসচিব হিসেবে নির্বাচিত করেছেন। আন্দোলন সংগ্রামে আরেক ত্যাগী ছাত্র নেতা রিজভী আহম্মেদ। তার ত্যাগের মূল্য দিয়েছেন বিএনপি প্রধান। গত কমিটিতে দলের ৮ যুগ্ম-মহাসচিবের তালিকায় তার নাম ৮ নম্বরে থাকলেও এবার তাকেই সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব নির্বাচিত করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। যে পদে ছিলেন দলের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং বর্তমান মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আগামী কাউন্সিল পর্যন্ত বিচক্ষণতা, সততা, দক্ষতা আর বিশ্বাসের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে মহাসচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ আসতে পারে তার হাতেই। রাজপথে ত্যাগের খতিয়ান স্বল্পদৈর্ঘ হলেও বিশ্বাসের দিক থেকে উত্তীর্ণ আরেক নেতা মিজানুর রহমান সিনহাকে এবারো কোষাধক্ষ্য নিযুক্ত করেছেন বিএনপি প্রধান।
গতকাল যুগ্ম-মহাসচিব হিসেবে মনোনীন হয়েছেন ৭ জন। তাঁরা হলেনÑ ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, মজিবর রহমান সারোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, হারুন-অর রশিদ ও লায়ন আসলাম চৌধুরী। এর মধ্যে মাহবুব উদ্দিন খোকন বাদে সবাই এই পদে নতুন মুখ।
দলীয় নেতাদের দৃষ্টিতে সবাই ত্যাগী-পরীক্ষিত নেতা। ১/১১-এর সময় জিয়া পরিবারের অতন্ত্র প্রহরি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। আইনাঙ্গনে তার প্রভাত ও গ্রহণযোগ্যতার কমতি নেই। জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে সকল মামলায় লড়াইয়ে তিনি লড়াকু সৈনিকের ভূমিকা পালন করেছেন। প্রতিদানস্বরূপ গত কমিটির মতো এবারো আছেন যুগ্ম-মহাসচিব পদে।
জাতীয় সংসদের একাধিকবার নির্বাচিত এমপি বিএনপির গত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক (বরিশাল বিভাগ) শ্রমিক নেতা মজিবুর রহমান সারোয়ার। আওয়ামী লীগ অধুষ্যিত বরিশাল অঞ্চলে এই দুর্দিনে সংগঠনকে আগলে রেখেছেন তিনি। হবার কথা ছিলো শ্রমিক দল সভাপতি। তার যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন শীর্ষ নেতা।
বিএনপির ভ্যানগার্ড যুবদলকে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সচল রেখেছেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। মামলার আসামী হিসেবে তিনিই সেঞ্চুরিতে আক্রান্ত হন। স্থান-কালপাত্র ভেদে নিজেকে কখনো আড়ালে-কখনো প্রকাশ্যে এনে কর্মীদের সাহস যোগিয়েছেন তিনি। তার কর্মগুণের বিচারে প্রমোশন হিসেবেই যুগ্ম-মহাসচিব করা হয়েছে বলে মনে করে নেতারা।
৯০’এর ছাত্র আন্দোলনের সময় নেতা কেনাবেচার বাজারে অনেকেই নিজেকে এরশাদের কেনাপন্যে পরিণত হয়েছিলো। প্রাণনাশ, গাড়ী-বাড়ি অর্থলোভের যারা টলেনি তাদেরই একজন খায়রুল কবির খোকন। তার অধীনে যারা ছাত্র রাজনীতি করেছেন এখন রাষ্ট্র পরিচালনায় এখন তারা গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। গত কমিটিতে তাকে শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক করা হলেও প্রশ্ন উঠেছিলো তার ত্যাগের মূল্যায়ন নিয়ে। এবার যুগ্ম-মহাসচিবের দায়িত্ব পাওয়ায় বিএনপির অনেক নেতাকর্মীই ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছেন।
বিএনপির অঙ্গ-সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দল যখন বিলুপ্ত প্রায় বিএনপি চেয়ারপার্সনের নিদের্শে সেই সংগঠনের যৌবনীরূপ দিয়েছেন সাবেক ছাত্র নেতা হাবিব-উন-নবী খান সোহেল। ঢাকা মহানগর বিএনপি যখন নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব তখন সংগঠনকে জাগিয়ে তুলতে তাকে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব নিযুক্ত করেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন। আন্ডাগ্রাউন্ডে অবস্থান করে দলীয় রাজনীতিতে সফলতায় ঈর্ষান্বিত হয়েই তার বিরুদ্ধে বিদেশী খুনের মামলা দেয়া হয়েছে বলে দাবি বিএনপির। এ প্রেক্ষিতে প্রতিদারস্বরূপ যুগ্ম-মহাসচিবের দায়িত্ব দিয়েছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব।
উত্তরবঙ্গের আকে সাবেক ছাত্র নেতা চাপাই নবানগঞ্জের হারুন অর রশিদ। গত কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদকের (রাজশাহী) দায়িত্ব পালন করেছেন। দলের জন্য ভূমিকা রাখার কারণে হারুন-পাপিয়া দেশের আলোচিত দম্পতি। তাকেও যুগ্ম-মহাসচিবের উন্নীত করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের আরেক দক্ষ সংগঠনক। লায়ন আসলাম চৌধুরী। ওই অঞ্চলে ডজন নেতার অবদানের মধ্যে আসলামেরটি প্রসংশনীয়। চেয়ারপার্সন ও সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যানের পছন্দের উদীয়মান নেতা তিনি। ১/১১-থেকে শুরু করে গত কয়েকটি আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন তাকে যুগ্ম-মহাসচিব নির্বাচিত করায় ত্যাগের যথাযথ মূল্যায়ন হয়েছে বলে চট্টগ্রাম অঞ্চলের নেতা-কর্মীরা।
এদিকে গতকাল ঘোষিত ৮ সাংগঠনিক সম্পাদক হলেন- ডা. শাহাদাৎ হোসেন, নজরুল ইসলাম মঞ্জু, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, বিলকিস জাহান শিরিন, সৈয়দ ইমরান সালেহ প্রিন্স, শ্যামা ওবায়েদ, আসাদুল হাবিব দুলু ও ফজলুল হক মিলন। তবে সিলেট বিভাগে কারোর নাম ঘোষণা করা হয়নি। বর্তমানে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজ রয়েছেন।
আলাপকালে বিএনপির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা ইনকিলাবকে বলেন, সিনিয়র নেতাদের সাথে সমন্বয় করে চট্টগ্রাম বিভাগে সংগঠনকে সক্রিয় রাখায় ডা. শাহাদাৎ হোসেনকে ওই বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। আন্দোলন সংগ্রামে খুলনা বিভাগের নেতাকর্মীদের নিয়ে অগ্রভাগে যিনি থাকতেন সেই নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়েছে। রাজশাহী বিভাগে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়েছে রুহল কুদ্দুস তালুকদার দুলুকে। গত কয়েকটি কর্মসূীচতে নেতাকর্মীরা যখন আতাত বা আত্মগোপনের পথ বেছে নিয়েছেন তখন দুলু নাটোরের নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজপথে থাকতেন। কর্মের ফল হিসেবেই তাকে ওই বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। পুরুষ নেতৃত্বে ভিড়ে দুই নারীকে সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছেন খালেদা জিয়া। তারা হলেন বরিশাল বিভাগে এডভোকেট বিলকিস জাহান শিরিন ও ফরিদপুর বিভাগে শ্যামা ওবায়েদ। নতুন বিভাগ হওয়ায় পরীক্ষিত আরেক ছাত্র নেতা সৈয়দ ইমরান সালেহ প্রিন্সকে ময়মনসিংহ বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। রংপুর বিভাগে আসাদুল হাবিব দুলু ও ঢাকা বিভাগের ফজলুল হক মিলনকে এবারো সাংগঠনিক সম্পাদকের পদেই রাখা হয়েছে। খোদ বিএনপির একাধিক স্থায়ী কমিটির সদস্য মনে করেন তৃণমূলের নানামুখি অভিযোগের পরও মিলনকে পদে রাখায় বিতর্ক থেকেই গেলো। বিতর্কের বাইরে নেই শ্যামা ওবায়েদও। রাজনীতিতে তিনি একেবারে জুনিয়র। একমাত্র মরহুম পিতার অবদানের জন্য তাকে এতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়াটা অনেককেই নানা প্রশ্নের মধ্যে ফেলেছে। খালেদা জিয়ার সমালোচনাকারী মা, আওয়ামী পরিবারের একজন স্বামীর সংসারে তরুণ নারী নেত্রী শ্যামা নিজেকে কতটুকু বিএনপিপন্থী রাখতে পারবে সেই এখন দেখার বিষয়।
বিএনপির সদ্য সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম বিভাগ) গোলাম আকবর খন্দকার ইনকিলাবকে বলেন, বিএনপির একটি প্রতিশ্রুতি ছিলো দলকে তৃণমূলে নিয়ে যাওয়া হবে। নতুনদের উৎসাহিত করা হবে। নেত্রী তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করছে। নতুন-তরুণদের উৎসাহিত করছেন।
সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ লাভের পর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে এডভোকেট বিলকিস জাহান শিরিন ইনকিলাবকে বলেন, আজ (গতকাল) যে ১৫ জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন ম্যাডাম খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমান একেবারে রাস্তার রাজনীতিতে পরীক্ষিতদেরই এবারের কমিটিতে স্থান দিয়েছেন। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমাদের ত্যাগের মূল্যায়ন করা হয়েছে। অন্যরা অবশ্যই আশাবাদী হয়ে উঠছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কর্মের মূল্যায়নে আশাবাদী ত্যাগীরা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ