Inqilab Logo

বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জনবান্ধব পুলিশবাহিনী ও বাস্তবতা

প্রকাশের সময় : ২৫ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা : ব্রিটিশ-ভারত থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত প্রশাসনিক কাঠামো প্রধানত দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য উপযোগী ছিল। কিন্তু সুশাসন ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সহায়ক ছিল না। বিদেশী শাসকদের নিকট জাতীয় উন্নতির ধারণা ছিল অনেকটা অমূলক ও কল্পনাবিলাস। রাষ্ট্র ছিল তখন পুলিশী রাষ্ট্র (Police State)| । মূলত আধুনিক রাষ্ট্র এক জনকল্যাণকর প্রতিষ্ঠান। জনহিতকর কার্যাবলী সম্পাদনই বর্তমান রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড লাস্কি (Harold Laski) বলেছেন, The modern state is a territorial society divided into government and subjects, claiming within its allotted physical area supremacy over all other institutions. অর্থাৎ আধুনিক রাষ্ট্র ভূখন্ডে অবস্থিত এমন এক সমাজ, যা শাসকগোষ্ঠী ও শাসিত-এ দু’ভাগে বিভক্ত এবং নিজের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের মধ্যে অবস্থিত সকল সংস্থার উপর প্রধান্য দাবি করে।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ থাকে। আর রাষ্ট্রের উল্লেখ্যযোগ্য বিভাগ হলো প্রশাসন। আর প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ উপবিভাগ হলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দেশের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বলতে প্রধানত পুলিশকেই বোঝানো হয়। যদিও সংজ্ঞা অনুযায়ী অপরাপর বাহিনীগুলোও এক সাথে জড়িত আছে। মূলত পুলিশই আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করে। আর অন্যবাহিনীগুলো পুলিশের সহায়ক শক্তি। তাই পুলিশ বাহিনীর উপর জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও সুশাসন অনেকটাই নির্ভরশীল। কিন্তু আমাদের দেশের এই অতিগুরুত্বপূর্ণ বাহিনীর তার সে দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি সুবিচার করতে পেরেছে বলে মনে হয় না।
উন্নত বিশ্বে পুলিশ বাহিনী জনগণের সার্বক্ষণিক সেবায় নিয়োজিত থাকে। যেকোন সমস্যায় মানুষ পুলিশের দ্বারস্থ হয়। পুলিশের কাজই হলো জনগণের যেকোন সমস্যায় সকল প্রকার সহযোগিতা করা। এ ব্যাপারে অতি চমকপ্রদ ঘটনার উল্লেখ করছি। চুয়াডাঙ্গা সফরকালে দুই কোরীয় নাগরিক কিছু টাকা হারিয়ে ফেলেন। থানায় যোগাযোগ করে জানতে চান যে, তাদের হারানো টাকাগুলো থানায় জমা হয়েছে কী-না? থানা কর্তা তো একেবারে আক্কেলগুরুম। যে দেশে সিন্দুক কেটে টাকা চুরি করা হয়, সে দেশে এমন আশা করা বাতুলতা বৈ কিছু নয়।
এবিষয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অনেকটা বুদ্ধিমত্তারই পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বিদেশীদের জানান যে, হারানো টাকাগুলো এখনো তাদের কাছে জমা পড়েনি। তাদেরকে পরে যোগাযোগ করতে বলে ওসি সাহেব জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় টাকা ম্যানেজ করে কোন মতে দেশের মানটা বাঁচিয়েছিলেন। এঘটনা থেকেই বোঝা যায় আমাদের দেশের পুলিশের সেবার ধরন, আর অন্যদেশের পুলিশের সেবার ধরনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্যটা।
যাহোক এসব কথা কারো কারো কাছে আষাঢ়ে গল্পই মনে হওয়ার কথা। এ দেশের একশ্রেণীর পুলিশ সদস্য অবৈধ অর্থলিপ্সার জন্য রাস্তা থেকে পথচারি ধরে নির্মম ও নিষ্ঠুর নির্যাতন করে। তাই পুলিশের কাছে বেশি আশা করা কতখানি যৌক্তিক তা বিচারের ভার দেশের সচেতন মানুষের উপর ছেরে দেয়া শ্রেয় মনে করছি। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে একশ্রেণীর পুলিশ সদস্য পেশাগত অসদাচারণ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেই চলেছেন। কোনভাবেই এসব অসৎপ্রবণ পুলিশ সদস্যদের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। অভিজ্ঞজনরা বলছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় পুলিশে লোক নিয়োগ, বেপরোয়া ক্ষমতাদান ও বিরোধী দল দমনে নিয়োজিত করায় পুলিশ বাহিনী যেমন পেশাদারিত্ব হারিয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে বাহিনীর চেইন অফ কমান্ডও ভেঙ্গে পড়েছে। সম্প্রতি সংঘঠিত কিছু ঘটনা থেকে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যা আমাদের জন্য রীতিমত আতঙ্কের।
অসৎপ্রবণ পুলিশ সদস্যের কারণে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এসব পুলিশ সদস্য রাজধানীসহ সারা দেশেই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বরিশালের আগৈলঝাড়ায় ওসিসহ দুই পুলিশ সদস্যের দুই দফা নির্যাতনে আহত গাছ ব্যবসায়ী এক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। গত ১৬ জানুয়ারি দুপুরে এ নির্মম ও নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটে। নির্যাতনের শিকার আসাদুজ্জামান বাদল সেরনিয়াবাত শেরাল উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এবং গৈলা ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক। অপর দিকে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে কোনো অভিযোগ ছাড়াই এক ব্যবসায়ীকে আটকের পর ৪৫ হাজার টাকা আদায় করে নিয়েছে পুলিশ। গত ১৩ জানুয়ারি রাতে উপজেলার হোসেনাবাদ বাজার থেকে নাহারুল ইসলাম নামে ওই তৈরি পোশাক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে এই টাকা আদায় করে পুলিশ। গত ১৫ জানুয়ারি কাক ডাকা ভোরে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ মীরহাজিরবাগে পিটিয়ে মারাত্মক আহত করে সিটি করপোরেশন কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র দাসকে। পুলিশ বিকাশকে পেটানোর সময় নাকি বলে, ‘মাছের রাজা ইলিশ, দেশের রাজা পুলিশ’। পুলিশ রাজা হলে কোন সমস্যা নেই কিন্তু তা প্রজাবান্ধব হলেই শেষ রক্ষা।
দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োচিত পুলিশের এমন আচরণ এখন সারা দেশের নিত্যদিনের চিত্র। অপরাধ দমনের দায়িত্ব যাদের, সেই পুলিশই এখন এমন সব অপরাধ কর্মকা-ে বেপরোয়া। ঘুষ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, নির্যাতন, ব্লাকমেইলিংয়ের পাশাপাশি ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে এই বাহিনীর কতিপয় সদস্য। এমতাবস্থায় সরকারের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে আশঙ্কাজনকভাবে। পুলিশ বাহিনীকে জনগণের বন্ধু বলা হলেও তারা এখন মানুষের কাছে আতঙ্কের নাম। বিরোধী দল দমনে পুলিশকে বেপরোয়া ও নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষমতা দেয়ার কারণেই এ বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার, অনৈতিক লোভ-লালসা ও স্বেচ্চাচারিতা বেড়েছে বলেই মনে করছেন বোদ্ধামহল।
বিশিষ্টজনরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় পুলিশে লোক নিয়োগ করার কারণেই দেশের এই মহাসর্বনাশটা হয়েছে। সরকারের পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার প্রবণতাও এ সমস্যার জন্য দায়ি।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতা, সংকীর্ণ দলীয় মনোবৃত্তি, পুলিশ প্রশাসনে দলীয়করণ, পুলিশের অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং এবং চেইন অফ কমান্ড দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে পুলিশে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। পুলিশ বাহিনীতে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন নৈতিক মানদ- বিবেচনায় আনা হচ্ছে না বরং যারা দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করছে তাদেরকেই এই বাহিনীতে নিয়োগ করা হচ্ছে। ফলে পেশাদারিত্ব হারাতে বসেছে রাষ্ট্রের অতিগুরুত্বপূর্ণ এই বাহিনী। কিন্তু পুলিশ বাহিনীর কতিপয় সদস্যের এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয় বা হচ্ছে বলে কখনো শোনা যায়নি।
আসলে অপরাধীকে অপরাধী হিসাবেই চিহ্নিত করতে হবে। আর তা সে যেহোক না কেন। মূলত দেশে আইনের শাসন ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তাবিধানের জন্য একটি গণমুখী পুলিশ প্রশাসন ও অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের কোন বিকল্প নেই। আর তা করতে ব্যর্থ হলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও মারাত্মক অবণতি হতে বাধ্য, যা সরকারের জন্যও এক সময় বিপদ ঢেকে আনতে পারে।
পুলিশ বাহিনীর কতিপয় অসৎপ্রবণ ও অতিউচ্চাভিলাষী সদস্যের কারণেই গোটা বাহিনীই এখন ইমেজ সংকটে পড়েছে। জনগণ এখন পুলিশবাহিনীকে জনবান্ধব মনে করতে পারছে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য অবশ্যই পুলিশ বাহিনীর নিয়োগ প্রক্রিয়া অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ করতে হবে। নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতর ব্যক্তিদেরকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অভিযুক্তদের স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ায় বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা এখন সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। সর্বোপরি বিদ্যমান পুলিশ আইনের সংস্কার, যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ এবং মূল্যবোধ সৃষ্টি এবং সকল কাজের জন্য তাদেরকে জবাবদিহিতার আনার কোন বিকল্প নেই। রাজনৈতিক স্বার্থে পুলিশ বাহিনীর অপব্যবহারও রোধ করতে হবে। তাহলেই এই বাহিনীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে একটি জনবান্ধব বাহিনীতে পরিণত করা সম্ভব হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জনবান্ধব পুলিশবাহিনী ও বাস্তবতা
আরও পড়ুন