Inqilab Logo

শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

ভেজাল পণ্যে সয়লাব চট্টগ্রাম

| প্রকাশের সময় : ১ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : ভেজাল পণ্যে সয়লাব ঈদ বাজার। বেপরোয়া ভেজালকারী চক্র। ভেজাল ও মানহীন ভোগ্যপণ্য উৎপাদন ও বিক্রির হিড়িক পড়েছে চট্টগ্রাম অঞ্চলে। ভেজাল, মানহীন ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি ভোগ্যপণ্যে ভরে গেছে মহানগর থেকে গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজার। ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানেও থামছে না ভেজালের কারবার। ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছে। ভেজাল ও নিম্নমানের ভোগ্যপণ্যে চরম হুমকিতে জনস্বাস্থ্য। প্রতিবছর রোজা আসলে ভেজাল প্রতিরোধে নেয়া হয় নানা উদ্যোগ। চলে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান। কিছুদিন পর অভিযান থেমে যায়। অব্যাহত থাকে ভেজালকারীদের তৎপরতা। এবারও অভিযান চলছে, চলছে ভেজালপণ্য ধ্বংস ও জরিমানা। তবে অভিযানে বাইরে রয়ে গেছে শত শত কারখানা।
অভিযানে দেখা গেছে, ভেজাল, নকল, মানহীন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাংলা সেমাই, লাচ্ছা সেমাই, নুডলস, ঘি তৈরি হচ্ছে। খাওয়ার অযোগ্য উপকরণে তৈরি হচ্ছে বেকারি সামগ্রী। মানহীন হলুদ, মরিচ, মসলা, বেসনেও ভেজালের মিশ্রণ। মেয়াদোত্তীর্ণ আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল, লবণও বিক্রি হচ্ছে দেদারছে। আম, কলা, পেঁপে, ফলমূল, মাছ, শুঁটকিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর নানা উপকরণ ও রাসায়নিক মেশানো হচ্ছে। মেয়াদোত্তীর্ণ কাঁচামাল, ফরমালিন-কার্বাইড, সূতা রাঙানোর বিষাক্ত রং, ভেজাল পাম তেল, সেন্ট, পচা ডিম মেশানো হচ্ছে খাদ্যপণ্যে। নগরীর অভিজাত চেইন শপ থেকে শুরু করে সুপার মার্কেট, হাট-বাজার, ফুটপাত সর্বত্রই মিলছে ভেজাল পণ্য।
জানা গেছে, দেশের বৃহত্তম ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের আশপাশের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে বেশ কিছু নকল ও নিম্নমানের বাংলা ও লাচ্ছা সেমাই, নুডলস, মসলার গুঁড়া, লবণ ও ঘি উৎপাদনের কারখানা গড়ে উঠেছে। নগরীর রেয়াজুদ্দিন বাজারে বিভিন্ন অলিগলি, পাহাড়তলী-সিডিএ মার্কেট এলাকা, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, সাবানঘাটা, ঘাসিয়াপাড়া, চকবাজার, পশ্চিম মাদারবাড়ি, পূর্ব মাদারবাড়ি, আলকরণ, পাঠানটুলি কাপুরিয়াপাড়া, পাথরঘাটাসহ নগরীর অনেক ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অলিগলিতে গড়ে উঠেছে ভেজাল ভোগ্যপণ্যের ছোট ছোট কারখানা। রাজাখালী, বাকলিয়া, চরচাক্তাই, ডিসি রোড, খাতুনগঞ্জ, আসাদগঞ্জ, কোরবানিগঞ্জ, খলিফাপট্টি, বউবাজার এলাকায় রয়েছে কিছু সেমাই-মসলা ও ঘি তৈরির ভ্রাম্যমান কারখানা। এসব ভেজাল পণ্যের কারখানার সন্ধান পায় না ভ্রাম্যমান আদালত। পশ্চিম মাদারবাড়ী ও বহদ্দারহাট এলাকায় কিছু লাচ্ছা সেমাই কারখানা গড়ে উঠেছে। ভেজাল কেক ও পাউরুটি কারখানা ছড়িয়ে আছে নগরজুড়ে। জানা যায়, এসব কারখানায় তৈরি পণ্য চটকদার বর্ণিল প্যাকেটে বিভিন্ন নামি-দামি কোম্পানির লেভেল লাগিয়ে বাজারজাত করা হয়। মহানগরীর উপকণ্ঠ গ্রাম-গঞ্জ থেকে শুরু করে সর্বত্রই আসল পণ্যের আড়ালে এ ভেজাল পণ্য সরবরাহ করে ভেজাল সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এসব পণ্যের প্যাকেট এতটাই নিখুঁত যে বোঝার উপায় নেই এটি আসল না নকল।
ভেজালের শীর্ষে রয়েছে ঘি। রমজান ও ঈদে সেমাইর পাশাপাশি হরেকরকম ইফতার ও নাশতা তৈরির জন্য ঘিয়ের চাহিদা বেড়ে যায়। এছাড়া বছরব্যাপী বিয়ে, মেজবানসহ নানা আয়োজনেও পণ্যটির চাহিদা থাকে। এ চাহিদাকে পুঁজি করে নগরীর খুলশী, বায়েজিদের বিসিক, রাজাখালী, হামজারবাগ, মাদারবাড়ী, চকবাজারসহ বাড়বকুÐ, দোহাজারী, পটিয়া, আনোয়ারা, হাটহাজারী, ফটিকছড়িতে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক ঘি কারখানা। এছাড়া অলিগলিতে ছড়িয়ে আছে বেশকিছু ‘ভ্রাম্যমাণ’ ঘি কারখানা। সাবান, ডালডা, গরুর চর্বিসহ খাওয়ার অযোগ্য উপকরণ দিয়ে তৈরি হয় এসব ভেজাল ঘি। চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ ও আসাদগঞ্জ এবং রেয়াজুদ্দিন বাজারে খেজুরের আড়তে আমদানিকৃত পচা খেজুরের মজুদ রয়েছে। প্রতিবছর রমজান আসলে আমাদানিকৃত খেজুরের সাথে এসব পচা খেজুর মিশিয়ে বাজারজাত করা হয়। প্রতিবছরই ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে টনে টনে খেজুর জব্দ করা হয়। তবে এবার খেজুরের গুদামে এখনো হাত পড়েনি ভ্রাম্যমান আদালতের।
ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি প্রসাধন সামগ্রী, পোশাক-আশাক ও জুতাতেও ভেজালের কারবার থেমে নেই। মার্কেটগুলোতে নিম্নমানের পোশাকের গায়ে বিদেশি লেভেল লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। একদরের (ফিক্সড রেইট) নামে পোশাকে লিখে দেয়া দামে কিনতে গিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। কেনাদাম এক হাজার টাকা হলেও বিক্রির জন্য পোশাকের গায়ে লিখা হয় ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা বেশি। গত ঈদের বাজারে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে কোন কোন পোশাকের দাম ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা বেশি হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে এবার এখনো ঈদ বাজারে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান শুরু হয়নি।
ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে যাওয়ার বিষয়ে কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রামের সভাপতি নাজের হোসাইন বলেন, ভেজাল প্রতিরোধে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে। আইনের মারপ্যাঁচে ভেজালকারীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। ভেজালের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি ভেজালবিরোধী কঠোর আইন প্রণয়ণ করা জরুরী বলে মত দেন তিনি। তিনি বলেন, রোজা এবং ঈদ আসলেই ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান শুরু হয়। অভিযানে কিছু ভেজালকারীকে অর্থদÐ করা হলেও বেশিরভাগ ভেজালকারী আড়ালে থেকে যায়। ফলে ভেজালমুক্ত ভোগ্যপণ্য পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয় না। এতে ভোক্তারা প্রতারিতই হচ্ছে। এত বড় একটি মহানগরে হাতেগোনা কিছু অভিযান দিয়ে ভেজাল, মানহীন, নকল পণ্য উৎপাদন বন্ধ করা যাবে না উল্লেখ করে তিনি বরেন, এজন্য জেলা প্রশাসন, বিএসটিআই, সিটি কর্পোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, র‌্যাব, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, রোজার আগ থেকে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা বাজার মনিটরিংয়ের পাশাপাশি ভেজালবিরোধী অভিযান অব্যাহত রেখেছে। ইতোমধ্যে ভেজাল, পচাবাসি খাবার উৎপাদন ও বিক্রয়ের দায়ে অনেক প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠান সীলগালাও করে দেয়া হয়েছে। অভিযান পরিচালনার মতো প্রয়োজনীয় লোকবল নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, পাবলিক পরীক্ষা ও নিয়োগ পরীক্ষাসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ততার কারণে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা অভিযান অব্যাহত রাখতে পারছেন না। তবে অভিযান যেটুকু চলছে তাতে কিছুটা সাফল্য আসছে। ভেজালকারীরা আতঙ্কে রয়েছে, ভোক্তাদের মধ্যেও ভেজাল পণ্য বিষয়ে সচেতনতার সৃষ্টি হচ্ছে। রোজার পরেও ভেজালবিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান জেলা প্রশাসক।
এদিকে চোরাই পথে আসা ভারতীয় পোশাকে সয়লাব প্রতিটি মার্কেট। সম্প্রতি অর্ণব নামে নগরীর একটি শাড়ীর দোকান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে দেড় কোটি টাকা দামের দুই ট্রাক ভারতীয় পোশাক। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরাই পথে এসব পণ্য এনে বিক্রির জন্য মজুদ করা হয়। গতকাল নগরীর অন্যতম পাইকারি দোকান টেরিবাজারে আকস্মিক হানা দেয় কোস্টগার্ডের সদস্যরা। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা পণ্যের সন্ধানে অভিযান শুরু হলে ব্যবসায়ীরা সম্মিলিতভাবে দোকান-পাট বন্ধ করে রাস্তায় নেমে আসে। এ নিয়ে সেখানে উত্তেজনা দেখা দেয়। কয়েকটি দোকান থেকে কিছু পোশাক নিয়ে যায় কোস্টগার্ডের সদস্যরা। এসময় তাদের সাথে র‌্যাব ও শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিল। অভিযান প্রসঙ্গে টেরিবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি ফরিদুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, কাগজপত্র দেখানোর পরও কিছু পোশাক নিয়ে গেছে কোস্টগার্ডের সদস্যরা। তিনি দাবি করেন, টেরিবাজারে কোন ব্যবসায়ীর কাছে অবৈধ কোন পোশাক নেই। বৈধপথে শুল্ক দিয়েই মার্কেটে পোশাক তোলা হয়েছে।

 



 

Show all comments
  • সাজ্জাদ ১ জুন, ২০১৮, ৪:৪২ এএম says : 0
    রোজার পরেও ভেজালবিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভেজাল

৩ নভেম্বর, ২০২২
১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২
১১ জানুয়ারি, ২০২২
১১ জানুয়ারি, ২০২২
২৩ অক্টোবর, ২০২১
২২ অক্টোবর, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ