বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
রহমত, বরকত ও নাজাতের মাস রমজান। এমাসেই পবিত্র কোরআন নাজিল শুরু হয়। এমন একটি মহিমান্বিত রাত এ মাসে আছে যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। রমজান মাসের রোজা ফরজ করা হয়েছে। আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘ হে ঈমানদারগণ, তোমাদের জন্য রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য করা হয়েছিল।
যাতে তোমরা তাকওয়া (আল্লাহভীতি) অর্জন করতে পারো।’ এ মাসের যে লক্ষ্য, পঠিত কোরআনেরও সেই একই লক্ষ্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন: ‘এ সেই গ্রন্থ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যারা মুত্তাকী (আল্লাহ ভয়ে ভীত) তাদের পথ প্রদর্শক (এ গ্রন্থ)’। তাকওয়া আত্মার এমন একটা গুণ বা আস্থা যা মানুষকে আল্লাহর নির্দেশ পালন করতে ও নিষেধাজ্ঞা থেকে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। ইসলামী শরীয়তে তাকওয়া শব্দটি আল্লাহকে ভয় করা অর্থে বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়।
তাকওয়া অর্জনকারী বা আল্লাহর ভয়ে ভীত মানুষের পক্ষে কোনো অন্যায়, অপকর্ম ও অনাচার করা সম্ভব হতে পারে না। অবৈধ অর্থ উপার্জন ও মানুষকে ঠকিয়ে কিংবা প্রতারণা করে সম্পদ বৃদ্ধি সম্ভব হতে পারে না। কারণ, তা তাকওয়ার পথে বাধা স্বরূপ। মহানবী সা. উপার্জন পবিত্র বা হালাল রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। একে দোয়া কবুল হওয়ার শর্ত হিসাবে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন: ‘কেউ হারাম খাদ্যের এক লোকমাও মুখে নিলে ৪০ দিন তার দোয়া কবুল হয় না। ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী অবৈধভাবে সম্পদ উপার্জনের পাশাপাশি ভোগ্যপণ্য বিশেষত খাদ্যশস্য অস্বাভাবিক অবস্থায় ৪০ দিনের অধিক গুদামজাত করা, ওজনে হেরফের করা ইত্যাদি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো খাদ্যদ্রব্য ৪০ দিনের বেশি মজুদ করে রাখবে সে ব্যক্তি উক্ত খাদ্য সদকা করে দিলেও তার গুদামজাত করার গুনাহ মাফ হবে না।’ পবিত্র কোরআনে ওজনে হেরফেরকারীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে: ‘ওজনে হেরফেরকারীদের দুর্ভোগ ও সর্বনাশ, যারা লোকের কাছ থেকে নেয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় নেয় আর যখন মানুষদের মেপে বা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়।’
রমজান মানুষের প্রতি সহানভ‚তি ও সহমর্মিতা প্রদর্শনের মাস। ন্যায়, সদাচার, সংযম, সহিষ্ণুতা প্রকাশের মাস। এসব সদগুণ অনুসরণ ও বাস্তবায়নের মাস। অথচ আমাদের দেশে এর ব্যতিক্রমটিই লক্ষ্য করা যায়। ব্যবসায়ীদের একটি অংশ এ মাসকে তাদের আয় উপার্জন ও সম্পদ বৃদ্ধি করার উপলক্ষ বা উপায় হিসাবে গ্রহণ করে নেয়। বরাবরের মতো এবারও তারা রমজান মাসকে সামনে রেখে নিত্যপণ্য অবৈধভাবে মজুদ করে মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। নকল ও ভেজাল পণ্যে বাজার সয়লাব করে দিয়েছে। ওজনে হেরফের করার গর্হিত কর্ম তো আছেই। প্রতি রমজানের আগে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়, রমজানে পণ্যমূল্য তারা বাড়াবে না। অথচ কোনো বছরেই তারা এ কথা রাখে না। সরকারের পক্ষ থেকে একই ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু পণ্য-সামগ্রির অস্বাভাবিক ও অন্যায় মূল্যবৃদ্ধি রুখতে সরকার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয় না। সরকারের তরফে বিশেষ কিছু পণ্যের দামদরের তালিকা করে দেয়া হয়। ব্যবসায়ীরা সে তালিকার তোয়াক্কা করে না। এবারও এর ব্যতিক্রম হয় নি। কোনো পণ্যেরই কোনো ঘাটতি নেই। বরং পর্যাপ্ত মজুদ ও সরবরাহ রয়েছে। তবে দাম সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে। রমজানে রোজা পালন ও এবাদত বন্দেগী করার জন্য মানুষের মধ্যে দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনামুক্ত স্বস্তির পরিবেশ যে অধিক প্রয়োজন তা অস্বীকার করা যায় না। বাস্তবে এর বৈপরীত্যই আমরা লক্ষ্য করি। এটা শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে হওয়া উচিৎ নয়, সঙ্গত নয়।
বিভিন্ন অমুসলিম দেশে তাদের ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠান উপলক্ষে প্রয়োজনীয় পণ্য-সামগ্রীর দাম কমানো হয়। ব্যবসায়ীরা স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে ঘোষণা দিয়ে পণ্য-সামগ্রীর দাম কমিয়ে দেয়। সরকারের তরফেও মূল্য কমানোর পক্ষে ভ‚মিকা রাখা হয়। প্রয়োজনে ব্যবসায়ীদের জন্য ভুর্তকি দেয়া হয়। আরব দেশগুলোতে রমজানে পন্য-সামগ্রীর দাম কমিয়ে দেয়া হয়। ব্যবসায়ীরা সাধ্যমত প্রতিযোগিতা করে পণ্যমূল্য কমিয়ে দেয়। এতে দেখা যায়, সাধারণ সময়ের চেয়ে এ মাসে গোশত, চাল, ডাল, ময়দা, চিনি, তেল দুধসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম অর্ধেক কিংবা তারও নিচে নেমে এসেছে। এবার রমজানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থ মন্ত্রণালায় ৯০ শতাংশ মূল্য ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছে। প্রায় একহাজার পণ্যের ক্ষেত্রে এই ছাড় দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এই ঘাটতি পূরণ করবে অর্থ মন্ত্রণালয়। সউদী আরবেও শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মূল্য ছাড় ঘোষণা করা হয়েছে। এর বাইরে ব্যবসায়ীরাও মূল্য ছাড় দিয়েছে। আরবের অন্যান্য দেশেও একইভাবে মূল্যছাড় দেয়া হয়। অনারব মুসলিম দেশগুলোর মধ্যেও এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতনতা পরিলক্ষিত হয়। রমজানে পণ্যমূল্য কমানো ছাড়াও রোজাদাররা যাতে আরাম-স্বস্তিতে রোজা পালনসহ অন্যান্য এবাদত ঠিক মত করতে পারে সে ব্যাপারে খেয়াল রাখা হয়। পাকিস্তানে এবার সরকারীভাবে ১৭৩ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, যাতে রমজানে পণ্যের দাম না বাড়ে। শুধু তাই নয়, ফ্রান্স, থাইল্যান্ডসহ অনেক অমুসলিম দেশেও ব্যবসায়ীরা মূল্য ছাড় দিয়ে থাকে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, আমাদের দেশেই উল্টো যাত্রা কেন? এর কারণ, আমাদের ব্যবসায়ীদের একটি অংশ ইসলামের নির্দেশনা ও শিক্ষা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। তাদের অনেকে রোজা রাখে, ইফতার-সেহেরীর আনুষ্ঠানিকতা পালন করে, তারাবি পড়ে, এমনকি দান-খয়রাতও করে। আসলে এসবে তাদের কোনোই ফায়দা হয় না। মানুষকে ঠকিয়ে, প্রবঞ্চনা করে, নকল-ভেজাল করে, ওজনে কম দিয়ে পাপই কেবল বাড়ে। এই সত্য উপলব্ধি করেও তাদের মধ্যে আসলে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না। এক্ষেত্রে সরকারের ভ‚মিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। এই মাসের জন্য সরকার ভুর্তকি ঘোষণা করতে পারে। এখানেও আন্তরিকতা ও সচেতনতার ঘাটতি বিদ্যমান। ইসলামের শিক্ষা ও নির্দেশনা অনুসরণ করার মধ্যেই সকলের সার্বিক কল্যান ও মঙ্গল নিশ্চিত হতে পারে। হিতৈষী ও সহৃদয় সমাজ গড়ে উঠতে পারে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।