Inqilab Logo

শুক্রবার, ৩১ মে ২০২৪, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সব মহলে অস্বস্তি

প্রকাশের সময় : ৯ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৪৫ পিএম, ৮ এপ্রিল, ২০১৬

সাখাওয়াত হোসেন বাদশা
সরকার আরও এক দফা ‘বিদ্যুৎ’ ও ‘গ্যাস’-এর দাম বাড়াতে যাচ্ছে। এলক্ষ্যে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এর কাছে প্রস্তাবনাও পাঠানো হয়েছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সরকারি এই প্রস্তাবকে অন্যায় ও অযৌক্তিক বলছেন- ব্যবসায়ী, শিল্প উদ্যোক্তা, রাজনীতিবিদসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষ। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির এমন প্রস্তাবনায় সরকারের ভেতরেও অস্বস্তি বিরাজ করছে। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা হচ্ছে- তেলের দাম কমলে ‘বিদ্যুৎ’ ও ‘গ্যাস’ এর দাম কমবে। এতে করে গণপরিবহনের ভাড়া, বিদ্যুতের দাম, পণ্যের দাম কমবে। যার সুফল পাবে দেশের সব মহল। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম কমানোর ঘোষণা আসলেও-জনআকাক্সক্ষা ঠিকই উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই সরকার ফার্নেস অয়েলের দাম কমিয়েছে। কিন্তু সরকারের এমন সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের কোন কল্যাণেই আসেনি।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে তখন দফায় দফায় দেশীয় বাজারে তেলের দাম বাড়িয়ে জনগণের কাঁধে মূল্যস্ফীতির দায়ভার চাপানো হয়েছিল। বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় গ্যাস ও বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ অনেক কমেছে। আর সে কারণেই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা সরকার গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য কমাবে। কিন্তু তা না করে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবনা এসেছে। যা সাধারণ মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়াবে। বাড়বে বাড়ীভাড়া, পরিবহন ভাড়া ও কৃষি উৎপাদন ব্যয়। বাড়বে জীবনযাত্রার ব্যয়। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসা ও বিনিয়োগসহ সার্বিক অর্থনীতিতে। ফলে সর্বক্ষেত্রে দেখা দেবে অস্থিরতা।  
বিইআরসি’তে পেট্রোবাংলা গ্যাসের দাম বাড়ানোর যে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে তাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাসের মূল্য ৬৩ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। গ্যাসের দাম গড়ে ৮৭.৬৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়। গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করে বাসা-বাড়িতে এক চুলা ব্যবহারকারীদের প্রতিমাসে গ্যাসের মূল্য বাবদ ১১শ’ টাকা এবং দুই চুলা ব্যবহারকারীদের প্রতি মাসে গ্যাসের মূল্য বাবদ ১২শ’ টাকা পরিশোধ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বর্তমানে এক চুলা ব্যবহারকারীদের গ্যাসের মূল্যবাবদ ৬শ’ টাকা এবং দুই চুলা ব্যবহারকারীদের ৬৫০ টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। সিএনজি চালিত গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে ৮৩ শতাংশ। এতে সিএনজি চালিত সকল পরিবহনের ভাড়া অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাবে। একইভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবনাও রয়েছে বিইআরসি’র কাছে। বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, ডিপিডিসি, ডেসকোসহ সকল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানীর পক্ষ থেকে গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম কেন বাড়ানো হবে-এর কোন যৌক্তিকতা দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ফার্নেস অয়েলের দাম কমায় এই জ্বালানি নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের  উৎপাদন ব্যয় কমে গেছে। একই সাথে পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এটা বাস্তবায়ন হলে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের উৎপাদন ব্যয় আরও কমবে। এই পর্যায়ে সকলের প্রত্যাশা জ্বালানি তেলের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দামও কমানো হোক।
উল্লেখ্য, বর্তমান সরকারের সাড়ে ছয় বছরের শাসনামলে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হয়েছে ৮ বার এবং গ্যাসের মূল্য বাড়ানো হয়েছে ৩ বার। আর এবার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে বিদ্যুতের দাম ৯ বার ও গ্যাসের মূল্য ৪ বার বৃদ্ধি করা হবে।
এদিকে, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলনে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে বিএনপি কঠোর কর্মসূচি দেবে। তিনি জ্বালানি তেলের দাম কমানোর পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দামও কমানোর দাবি জানান।
জামায়াতে ইসলামি ও বাম রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবনাকে অযৌক্তিক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এসব দলের পক্ষ থেকে থেকে দেয়া বিবৃতিতে অবিলম্বে জ্বলানি তেলের সাথে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম কমানোর দাবি জানিয়ে বলা হয়, গ্যাস এবং বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির ফলে জনগণের দুঃখ ও দুর্দশা আরো বাড়বে। গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে। সকল পণ্যের পরিবহন খরচ ও উৎপাদন খরচ বাড়বে। বাড়িভাড়া, যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধি পাবে। ফলে মানুষের জীবন যাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বাড়বে। কৃষক, শ্রমিক, চাকরিজীবীসহ সীমিত আয়ের লোকদের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করবে। অন্যদিকে,  গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সকল স্তরের জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আরও লাভবান হবেন কুইক রেন্টালে বিনিয়োগকারীরা।
এফবিসিসিআই সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদ বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার পরিপ্রেক্ষিতে দেশেও এর মূল্য কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম কমলে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম কমিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে আনবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৫৫ লাখ মেট্রিক টন। যার প্রায় পুরোটাই আমদানি করা হয়। জ্বালানি তেল সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় পরিবহন খাতে যা মোট আমদানিকৃত তেলের ৪৫ শতাংশ। এ ছাড়া বিদ্যুৎ খাতে ২৫ শতাংশ, কৃষি খাতে ১৯ শতাংশ, শিল্প খাতে ৪ শতাংশ এবং গৃহস্থালী ও অন্যান্য খাতে ৭ শতাংশ ব্যবহার হয়।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. ম. তামিম বলেছেন, জ্বালানি তেলের দাম বেশি বলে এর আগে বারবার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে সরকার। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। কারণ জ্বালানি তেল দিয়ে ২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার সময় বলা হয়েছিল-এখন উৎপাদন খরচ বেশি পড়ছে; তাই বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হচ্ছে। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। বরং তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম কমানো উচিত।
এমন পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ, জ্বলানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জ্বালানি তেলের দাম কমানোর কথা বললেও বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম কমানোর বিপক্ষে। তিনি বলেন, আমাদের গ্যাস ফুরিয়ে আসছে। তাছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এখনও অনেক কম দামে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। আর জ্বালানি তেলের কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কিছটিা কমলেও সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যয় বেড়েই চলেছে। তাই এ মুহুর্তে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম কমানোটা ঠিক হবে না। তবে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে কীনা-সে সম্পর্কে তিনি কিছু বলেননি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সব মহলে অস্বস্তি

৯ এপ্রিল, ২০১৬
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ