মাহে রমজানের মানবিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক তাৎপর্য
হিজরী বর্ষের নবম মাস রমজান। রমজানের অর্থ পুড়ে ফেলা, ধ্বংস করা, নিশ্চিহ্ন করা, রোদের প্রখরতা,
কুরআনুল কারীম নাযিলের পর থেকে রমযানের শিক্ষা ও তাৎপর্য সম্পর্কে যত আলোচনা-পর্যালোচনা, গবেষণা, রচনা কিংবা প্রকাশনা কর্মসম্পাদিত হয়েছে তা একত্রিত করলে আমার মনে হয় কয়েক মিলিয়ন পৃষ্ঠার কলেবরে পরিণত হবে। তারপরও এ নিবন্ধে এ বিষয়ে দু’চারটি কথা ও কিছু বিক্ষিপ্ত ভাবনা ব্যক্ত করার আশা করছি ইনশাল্লাহ।
চলুন আমরা একটু পবিত্র কুরআনের সেই ঘোষণার দিকে ফিরে যাই যার মাধ্যমে আমরা রোজার বিধান লাভ করেছি। ইরশাদ হচ্ছেÑ “ওহে যারা ঈমানের ঘোষণা দিচ্ছ (শোনো) তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হলো। যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, উদ্দেশ্য এই যে, তোমরা যেন তাকওয়ার শিক্ষা লাভ করতে পার। তবে তোমাদের যারা রুগ্ন কিংবা সফরের অবস্থায় থাকবে তাদের জন্য পরবর্তী সময়ে এ সংখ্যা পূর্ণ করে দেয়ার অবকাশ থাকল। আর যাদের রোজা দৈহিক সামর্থ্য নিঃশেষিত প্রায় হয়ে এসেছে তাদের জন্য প্রতি রোজার বিনিময়ে একজন মিসকীনের খাবার দানের ব্যবস্থা রাখা হলো। তবে কেউ অতিরিক্ত কিছু কল্যাণকর্ম সম্পাদন করলে তা হবে তার পক্ষে উপকারী আর তোমরা রোজা রাখতে পারলেই তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর যদি তোমরা জানতে পার। রমজান মাস হলো এমন একটি সময় যার মধ্যে অবতীর্ণ হয়েছে কুরআনুল কারীম।
মানবগোষ্ঠীকে হেদায়েতের সন্ধ্যান দানের উদ্দেশ্য আর যা নাকি হেদায়েতের সুস্পষ্ট নির্দেশনাবলি এবং সত্য ও মিথ্যা পার্থক্য বিধায়ক। অত্রএব, তোমাদের যে কেউ রমজান মাসটি প্রাপ্ত হবে সে যেন তাতে অবশ্যই রোজা রাখে। (আল-বাকারা : ১৮৩-১৮৫)
আমি মনে করি রমজানের তাৎপর্য ও শিক্ষাকে যথাযথ উপলব্ধি করার জন্য প্রধানতম উৎস হচ্ছেÑ আল-কোরআনের এ ঘোষণা। রোজার বিধান সংক্রান্ত ঘোষণার আরেকটি লক্ষণীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছেÑ এখানে একই ঘোষণার কোন বিশেষ অবস্থায় কার জন্য সাময়িক কিংবা চূড়ান্তভাবে ছাড় দেয়া হল যে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে, যা সাধারণত অন্যান্য বিধানের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। দেখা যাচ্ছে যে, ইহা এমন একটি বিধান যা মূলত পূর্ববর্তী প্রত্যেক নবীর উম্মতের ওপরও ফরজ ছিল। আমরা দেখতে পাই যে, বিশ্বের প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী জাতিই কোন না কোনভাবে রোজাকে তাদের ধর্মের একটি অপরিহার্য অংশ রুপে গণ্য করে থাকে। যেমন খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পাদ্রীদেরকে বিভিন্ন উপলক্ষে উপবাসব্রত পালন করতে হয়। ইহুদিদের ওপর মহরম মাসের প্রথম দশদিন রোজা ফরজ ছিল। কেননা ঐদিনগুলোতে হযরত মুসা (আ:) তুর পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থান করে, তৌরাতের বিধানবলি লাভ করেছিলেন। ইহুদিদের রোজার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, ওরা যত দেরিতে রোজা ভাংত ততই উত্তম ছিল এবং এ রোজা ভাঙ্গার পর চোখে ঘুম এসে পড়লে পরে কোন পানাহার গ্রহণ বৈধ ছিল না। তদুপরি রোজা পালনের দিনগুলোতে রাত্রি বেলায়ও স্ত্রী সহবাস ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
হিন্দুরা বছরের একটি বিশেষ সময়ে দু’দিন ব্যাপি উপবাসব্রত পালন করে থাকে এবং বৌদ্ধদের মধ্যে ভিক্ষু সম্প্রদায়কে প্রতিদিন দ্বিপ্রহর থেকে নিয়ে সূর্যস্ত পর্যন্ত নিয়মিত উপবাস করতে হয়। অবশ্য হিন্দু ও বৌদ্ধরা তাদের উপবাসব্রত পালন প্রথাকে নানাভাবে শিথিল করে নিয়েছে। এ কথায় বুঝা গেল বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মে শর্ত বিকৃতির পরও যে কিছু নবী রাসূলদের মৌলিক শিক্ষা স্মৃতি চিহৃ মুছে ফেলতে পারেনি। রোজা হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম।
রোজার উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য : এ প্রবন্ধে আমি রোজার উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলার প্রয়োজন মনে করছি। রোজার আসল উদ্দেশ্য আল্লাহ বলে দিয়েছেন “তাকওয়ার শিক্ষা গ্রহণ করা”। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাকওয়া কি? বস্তুত তাকওয়া হচ্ছে এমন একটি গুণ যা না থাকলে কোন ব্যক্তি হেদায়েতের পথে অগ্রসর হতে পারে না। যেমন ইরশাদ হচ্ছে “এ হচ্ছে এমন কিতাব যাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই ইহা তাকওয়ার গুণ বিশিষ্ট লোকদের জন্য হেদায়েত। (আল-বাকারা ১-২) ইহা এমন একটি গুণ যা না হলে কোন লোক হেদায়েতের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে না। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হচ্ছেÑ যদি তোমরা ধৈর্য্যরে পরিচয় দাও এবং তাকওয়া অবলম্বন করতে থাক তাহলে ইহা হবে এক দৃঢ়সংকল্পের ব্যাপার। (আল-ইমরান-১৮৬)
রোজার মাধ্যমে অন্তত: পক্ষে তাকওয়ার দুটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা যায়। ১। তাকওয়া হচ্ছেÑ এমন একটি অনুভূতি যা দ্বারা মানুষ উপলব্ধি করতে শিখে যে, সে নিজেকে সদা আল্লাহর সম্মুখে উপস্থিত দেখতে পায়। ফলে এমন সব কাজ থেকে বিরত থাকে যা আল্লাহর অবাধ্যতার পর্যায়ে পড়ে। বস্তুত রোজার মাধ্যমে এ অনুুভূতির যে শিক্ষা মানুষ লাভ করতে পারে তার কোন তুলনা নেই। যেমন কেউ রোজার নিয়ত করার পর যদি তৃষ্ণায় তার ছাতি ফেটে যায় কিংবা ক্ষিদের তাড়নায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পরে আর কোন নির্জন স্থানে সে সুস্বাদু খাবার কিংবা ঠাÐা উপাদেয় পানীয় ও হাতের নাগালে প্রাপ্ত হয় তবুও সে সেদিকে ভ্রক্ষেপ করে না। যে জিনিষটি তাকে এ কাজ থেকে বিরত রাখে তাকেই বলা হয় তাকওয়া।
২। তাকওয়া হচ্ছেÑ এমন একটি বস্তু যা বান্দার অন্তরে এ বিশ্বাস জন্মায় যে ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে হালাল ও হারামের যে ফিরিস্তি আমাদের পরিচিত তাই হালাল ও হারাম নয় বরং আল্লাহ যখন যে বস্তুকে যেভাবে হালাল বা হারাম বলেছেন তাই হচ্ছে হালাল হারামের প্রকৃত মাপকাঠি। রোজা অবস্থায় রোজাদারের জন্য এমন সব বস্তু হারাম হয়ে যায় যা মূলত তার জন্য বৈধ ছিল। যেমন সাধারণ পানাহার ও বৈধ স্ত্রীর সাথে মিলন ইত্যাদি। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে একজন বিত্তশালী ক্ষুধার যন্ত্রণায় অনুধাবন করতে পারে। ফলে তার মাঝে গরিবের প্রতি সহানুভূতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হয়।
রোজার তাৎপর্য : রোজার তাৎপর্য সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই ঘোষণা দিয়েছেন যে, যেহেতু রমযান মাসকে মানব জাতির জন্য হেদায়েতের বিধান প্রদানের মাস হিসাবে চিহিৃত করেছন। তাই মুসলিম মিল্লাত যারা হেদায়েতের সর্বশেষ কিতাব আল-কুরাআনের ধারক ও বাহক তাদের উচিত তারা যেন প্রতিবছর এ রমজান মাসকে মাসব্যাপী সিয়াম সাধনা ও ইবাদতের নানাবিধ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদযাপন করে।
মুসনাদে আহমদে বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায় যে, হয়রত নুহ (আ:) থেকে হযরত ঈসা (আ:) পর্যন্ত প্রায় সকল নবী রাসূলই এমাসে আল্লাহর কিতাব কিংবা ছহিফা লাভ করেছিলেন। তবে হযরত মুসা (আ:) মহারম মাসের প্রথম দশদিন তাওরাত প্রাপ্ত হয়েছিলেন বলে উল্লেখ আছে।
কুরআনুল কারীম যদিও ২৩ বছরের সুদীর্ঘ সময়ে অবতীর্ণ হয়েছিল কিন্তু তা অবতরণের সূচনা হয় কদরের রাত্রিতেই। তাছাড়া ছহীহ হাদীছে বর্ণিত আছে যে প্রতি বছর রমজান মাসে হযরত জিবরাইল (আ:) নবীজীকে পুরো কুরআন পাঠ করে শুনাতেন।
আল্লাহর প্রেমের নিদর্শন : রোজার মাধ্যমে আল্লাহর নিকট্য লাভের সুযোগ লাভ করে যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন রোজা একমাত্র আমার জন্যই আমি উহার প্রতিদান নিজ হাতে দিব। রিয়াম্কুত ইবাদত অন্যান্য ইবাদতের মত রোজার মধ্যে লোক দেখানোর কোন সুযোগ নেই। আমাদের রোজার সাক্ষী একমাত্র আল্লাহ।
নৈতিক বিকাশ সাধনে রোজাদার ব্যক্তি সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণে থাকে। রোজা অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে। একটি আদর্শ সমাজ গঠনে সহায়তা করে ধৈর্য্য ধারনের শক্তি যোগায়। মহানবী (সা:) বলেছেন, রমযান মাস ধৈর্য্যরে মাস, ধৈর্য্যরে প্রতিদান জান্নাত।
রোজা ঢাল স্বরূপ : কাম, ক্রোধ, লোভ, লালসা ইত্যাদি রিপুর তাড়নায় মানুষ বিপথগামী হয়ে ধ্বংসের মুখোমুখি হয়। রোজা মানুষের সে সকল কুপ্রবৃত্তি দমনের ঢাল স্বরূপ।
রোজা মুক্তির উপায় : কিয়ামতের কঠিন মুহূর্তে রোজা বান্দার মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। চরিত্র গঠনে সহায়ক : সিয়াম সাধনায় মানব মনে খোদাভীতি জাগ্রত করে। সংযম ও আত্মশুদ্ধিতে উদ্ধুদ্ধ করে এবং মানুষকে কঠিন সাধনায় অভ্যস্ত করে চারিত্রিক দৃঢ়তায় উপনীত করে।
আলহামদুলিল্লাহ মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় বিষয়ে বহু অবহেলা সত্তে¡ও পবিত্র মাহে রমযানকে সিয়াম সাধনা, কিয়ামুল লাইন ও আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয়ের মাস হিসেবে উদযাপনের প্রশংসনীয় প্রথা এখনও বিদ্যমান আছে।
লেখক: কড়িহাটি ফাজিল মাদ্রাসা, চাটখিল, নোয়াখালী।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।