Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

পরিবহন সেক্টরে অরাজকতা

প্রকাশের সময় : ৮ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৪৪ পিএম, ৭ এপ্রিল, ২০১৬

নূরুল ইসলাম : সরকারী চাকরিজীবী রহমত সাহেব বাসে চলাচল করেন। সচিবালয়ে অফিস শেষ করে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে শাহবাগ নামেন। সেখান থেকে মোহাম্মদপুরের বাসে ওঠেন। যেদিন প্রেস ক্লাবের সামনে মোহাম্মদপুরের বাস পেয়ে যান সেদিন আর শাহবাগে নামতে হয় না। তার মুখে বাসে চলার অভিজ্ঞতার কথা শুনলে যে কেউ অবাক হবেন। প্রেসক্লাব থেকে শাহবাগের দূরত্ব দেড় কিলোমিটারের বেশি নয়। প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৬০ পয়সা ভাড়া হিসাবে এই দূরত্বে বাস ভাড়া হওয়ার কথা সাড়ে তিন টাকা। রহমত সাহেব একদিন দিশারী পরিবহনের এক বাসে উঠলে কন্ডাক্টার তার কাছে শাহবাগের ভাড়া ২৫ টাকা দাবি করেন। কোনো যুক্তিতে পেরে উঠতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ২৫ টাকাই দিতে বাধ্য হয়েছেন। আরেকদিন শিকড় পরিবহনে উঠে ২৬ টাকা ভাড়া দিয়েছেন। এরপর থেকে ওই দুই পরিবহনের বাসে কখনওই ওঠেন না। বরং বাসে ওঠার আগে ভাড়ার কথা জিজ্ঞাসা করে ওঠেন। একদিন ভুলবশত: স্বাধীন পরিবহনের বাসে উঠে ৩০ টাকা ভাড়া দিতে হয়েছে। কোন নিয়মে কোন আইনে একই স্থানের ভাড়া এতো বেশি এবং তিন রকম তা জানা নেই রহমত সাহেবের। এটি বাস ভাড়া নিয়ে রাজধানীর একটি খন্ডচিত্র মাত্র। ঢাকার পরিবহন সেক্টরের এই অরাজকতা নতুন নয়। সেবার নামে বিড়ম্বনা, বাড়তি ভাড়া আদায়, কথায় কথায় যাত্রীদের মারধর, দুর্ঘটনায় মারা গেলেও হত্যা মামলা না করতে চাপ সৃষ্টি, যত্রতত্র গাড়ি দাঁড় করিয়ে যানজট সৃষ্টি, সুবিধা আদায়ে কথায় কথায় ধর্মঘটের ডাক দিয়ে জনসাধারণকে জিম্মি করাসহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত পরিবহন সেক্টর। জ্বালানী তেলের দাম বাড়ার আগেই বাসের ভাড়া বেড়ে যায়। কিন্তু তেলের দাম কমলে ভাড়া কমে না। বিদ্যুত ও জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, এ সপ্তাহের মধ্যে সব ধরণের জ্বালানী তেলের দাম কমবে। সাধারণ যাত্রীদের প্রশ্ন তেলের দাম কমলে বাস ভাড়া কি কমবে? ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, যুক্তিসঙ্গত হলে অবশ্যই কমবে। তিনি বলেন, ভাড়া নির্ধারণী জাতীয় কমিটি আছে। কমিটির সিদ্ধান্তেই সবকিছু হবে। এদিকে, গতকাল জ্বালানী তেলের মূল্য কমানোর ইস্যুতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে স্মারকলিপি দিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এতে দাবি করা হয়েছে, পরিবহন ভাড়া কমানো না গেলে জ্বালানী তেলের মূল্যের অর্জিত মুনাফা থেকে দেশের বেসরকারী খাতে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারী, শিক্ষক, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ নিম্ম আয়ের লোকজনের যাতায়াতে ভূর্তকি হিসেবে প্রতিমাসে এক হাজার টাকা হারে “যাতায়াত ভাতা” প্রদান করা হোক।
যুগ যুগ ধরে সমস্যায় জর্জরিত পরিবহন সেক্টর। এর প্রতিকারে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলেই ধর্মঘট করে জনসাধারণকে জিম্মি করা হয়। আদায় করা হয় অন্যায্য দাবি। এজন্য পরিবহন শ্রমিকদের ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন নামের সংগঠনটিকে ব্যবহার করা হয় মালিক শ্রমিকদের স্বার্থ আদায়ের জন্য। নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান এই সংগঠনের সভাপতি। যাত্রী সাধারণের স্বার্থ নয়, মালিক-শ্রমিকদের স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটলেই সারাদেশে ফেডারেশনের নেতাকর্মীরা গর্জে ওঠে। দীর্ঘদিন থেকে এ অবস্থা বিরাজমান। পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলার জন্য মূলত দায়ী সরকারি কর্তৃপক্ষ। পরিবহন ব্যবসায়ীদের কাছে নতজানু নীতির কারণ পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। ফলে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা যে কোনো অন্যায় দাবি আদায় করে আন্দোলনের মাধ্যমে। এ পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। সরকারের হাতেই এটি তৈরি। গণপরিবহনে এখন গণমালিক। এটি বড় সমস্যা। পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবহন সেক্টরে বেসরকারি সংস্থার ওপর ভরসা করেই জনসাধারণকে চলাচল করতে হয়। আবার নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কমিটিতেও রয়েছে তারা। এতে করে দাবি মানতে অনেক ক্ষেত্রেই বাধ্য হয় সরকারি সংস্থা। এছাড়া যে কোনো দাবি আদায়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করতে পরিপক্ব পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কাছে এরকম জিম্মিদশা একদিনে তৈরি হয়নি। সরকারি পরিবহন সংস্থাগুলোর যাত্রীচাহিদা পূরণে অপ্রতুলতা একটা কারণ। বেসরকারি খাতের অধীনে চললেও গণপরিবহন হওয়ার কথা কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠানের আওতায়। কিন্তু এখন তা ব্যক্তিপর্যায়ে চলে যাওয়ায় রয়েছে অসংখ্য মালিক-শ্রমিক। গঠন হচ্ছে নানা সংগঠন। এর ফলে রাজনৈতিক ছত্রছায়া, পেশিশক্তি ও অবৈধ লেনদেনের পথ তৈরি হয়েছে। এছাড়া পরিবহন সেক্টর নিয়ন্ত্রণের সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা তথা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পেশাদারিত্ব, অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার অভাব রয়েছে। রেগুলেটরি কমিটিতে যারা আছেন, তাদের অনেকেরই এ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা বা ধারণা নেই। এসব কারণেই পরিবহন খাতকে গ্রাস করছে স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম।
ভাড়া নিয়ে বিশৃঙ্খলা ঃ বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, বিগত ২৬ বছরে ৩ দফা জ্বালানী তেলের দাম কমার পর দেশের পরিবহন সেক্টরে ভাড়া কাগজে কলমে কমানো হলেও বাস্তবে কমেনি। ২০০৮ সালের ২৫ অক্টোবর ৫৫ টাকার ডিজেল ৭ টাকা কমে ৪৮ টাকা হলে পরিবহন ভাড়া যাত্রী প্রতি কিলোমিটারে ০৭ পয়সা কমানো হয়। ২০০৯ সালের ১২ জানুয়ারী  ৪৮ টাকার ডিজেলের মূল্য কমে ৪৪ টাকা নির্ধারণ করায় যাত্রী প্রতি বাস ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ০৪ পয়সা কমানো হয়। এরপর পরিবহন মালিকদের দাবীর প্রেক্ষিতে পরিবহন সেক্টর শিল্প খাত ঘোষনা ও জ্বালানীর মূল্য ৪৪ টাকা থেকে কমে ৪০ টাকা হলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাস ভাড়া যাত্রী প্রতি কিলোমিটারে ০৫ পয়সা কমানোর ঘোষনা দেয়া হয়। এই সকল ভাড়া কমানোর ক্ষেত্রে  কাগজে কলমে এই ভাড়া কমানো হলেও প্রকৃতপক্ষে কোন বাস-মিনিবাস ভাড়া কমে নি। সরকার জনস্বার্থে জ্বালানীর মূল্য কমালেও গুটি কয়েক পরিবহন মালিক এই সুবিধা ভোগ করছে। দেশের যাত্রী সাধারণসহ আপামর জনগন এর সুফল থেকে বার বার বঞ্চিত হয়েছে। যাত্রীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের অক্টোবর থেকে মেট্রোতে বাস ভাড়া বাড়ানো হয়। বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ৭০ পয়সা করা হয়। মিনি বাসের ভাড়াও ১ টাকা ৫০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ৬০ পয়সা করা হয়। ঢাকাসহ মেট্রো শহরে এই ভাড়া কার্যকরের কথা বলা হলেও বাস্তবতার সাথে এর আকাশ-পাতাল ফারাক এখনও বিদ্যমান। যেমন মোহাম্মদপুর থেকে শাহবাগ পর্যন্ত এলে মিনিবাসের ভাড়া রাখা হয় ১০ টাকা। কিন্তু শাহবাগের পর যে কোনো স্থানে নামলে এই ভাড়া ১৫ টাকা হয়। মোহাম্মদপুর থেকে প্রেসক্লাবের ভাড়া কোনো কোনো বাসের ভাড়া ১৫ টাকা। ওই বাসেই আবার মতিঝিল পর্যন্ত ভাড়া ২০ টাকা। কিলোমিটারের হিসাবে যা একেবারে বেমানান। এসব বিষয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, এটা করা হয় বিরতিহীন বাসের ক্ষেত্রে। তিনি বলেন, এটা অনিয়ম ও অন্যায়। এসব অনিয়ম ধরার জন্য বিআরটিএ এর মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হচ্ছে। আমরাও মনিটরিং করছি। যারা এখনও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। রাজধানীতে ভাড়া নিয়ে এরকম অসংখ্য অসঙ্গতি আছে। যা নিয়ে যাত্রীদের সাথে পরিবহন শ্রমিকদের বাক-বিতন্ডা লেগেই থাকে।
অকার্যকর বিআরটিসি
এক সময় রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির ডাবল ডেকার ছিল সাধারণ যাত্রীদের প্রথম পছন্দের যান। অভিযোগ রয়েছে, পরিবহন মালিকদের প্ররোচনায় বা প্রভাবে অনেক রুটে বিআরটিসির বাস বন্ধ করা হয়েছে। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিতে প্রতিষ্ঠানটি ডুবতে বসেছে। আন্ত:জেলা রুটে বিআরটিসির কিছু বাস চলাচল করলেও সেগুলোতে সরকারের লাভের চেয়ে ক্ষতির অংকই বেশি।  
কোম্পানির নামে অরাজকতা
অভিজ্ঞতা বা সামথ্য নয় পরিবহন সেক্টরের ব্যবসায়ী এখন প্রভাবশালীরা। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের আত্মীয় স্বজন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরাই কুক্ষিগত করে রেখেছে পরিবহন সেক্টর। এদের কাছে সত্যিকারের ব্যবসায়ীরা অসহায়। পরিবহন মালিকরা জানান, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজে বা আত্মীয়স্বজনের নামে দু-একটা বাস কিনে প্রথমে একটি কোম্পানি খোলেন। এরপর বিভিন্ন ব্যক্তির বাস ওই কোম্পানির অধীনে চালানোর জন্য নিয়ে আসেন। বিনিময়ে কোম্পানির উদ্যোক্তারা প্রতিটি বাস থেকে এককালীন মোটা অংকের টাকা আদায় করে চলেছেন। প্রভাবশালীদের চাপে রুট বাড়তে বাড়তে রাজধানীতে এখন রুটের সংখ্যা ১৯০ এর বেশি। চলছে ৬ সহস্যাধিক বাস ও মিনিবাস। শৃঙ্খলা না থাকায় এসব গাড়িই এখন রাজধানীবাসীর জন্য বিড়ম্বনার ও যানজটের অন্যতম কারণ। অথচ রাজধানীর ব্যস্ত এলাকাগুলোতে সময়মতো বাস পাওয়া যায় না এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। একাধিক মালিক জানান, কোম্পানী ও রুট যেভাবে বেড়েছে তাতে এই অরাজকতা ঠেকানো মুশকিল। এতে করে মালিকপক্ষ লাভবান হলেও যাত্রীসেবা মোটেও বাড়বে না।  
গোটা শহরটাই বাসস্ট্যান্ড
রাজধানীর এমন কোনো স্থান নেই যেখানে বাস দাঁড়ানো থাকে না। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যাত্রাবাড়ী থেকে রায়েরবাগ, কমলাপুর থেকে শাজাহানপুর, মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে দিলকুশা, মহাখালী থেকে নাবিস্কো, কল্যাণপুর থেকে গাবতলী, মোহাম্মদপুর সাতরাস্তা থেকে ধানমন্ডি, আদাবর থেকে শ্যামলী, রামপুরা ব্রীজ থেকে বনশ্রী পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে দিন রাতে সব সময় বাস ও মিনিবাস দাঁড় করানো থাকে। বাসের সারিতে রাস্তায় যান চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে। কিন্তু দেখার কেউ নেই। শুধু কি তাই, রাস্তায় চলাচলের সময় যেখানে দাঁড়ানো যাবে না সেখানে বেশি বেশি দাঁড়ায় বাসগুলো। এতে করে পেছনে যানবাহন আটকা পড়ে যানবাহন। সৃষ্টি হয় যানজটের। যানজট রাজধানীর জন্য নতুন কিছু নয়। সব সমস্যার মতো এটাও থাকে বারো মাস। এটা নিয়ে মানুষের কথা বলার দিনও যেনো শেষ হয়ে আসছে।  সিটি কলেজের সামনে যানজটে পড়ে থাকা একটি বাসের চালকের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, ‘ভাই যানজট কোথায় পেলেন,  গোটা শহরই তো এখন বাসস্ট্যান্ড। দেখুন কোথাও কোনো বাস চলছে না সব দাঁড়িয়ে আছে। যে কেউ দেখলে মনে করবে আসলেই এটা একটা বাসস্ট্যান্ড।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পরিবহন সেক্টরে অরাজকতা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ