Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চট্টগ্রামে গণপরিবহন বিশৃঙ্খলা

বাস-মিনিবাস সঙ্কটে দুর্ভোগ গলাকাটা ভাড়া

| প্রকাশের সময় : ১৩ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : ইপিজেড মোড়ে বাস আসতেই তাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে সবাই। বাসের ভেতরে ঠাসা-ঠাসি, অনেকে উঠে পড়েন ছাদে। দরজায় ঝুলছে কয়েকজন। এরমধ্যে হেলপারের ঘোষণা, ‘বাস যাবে আগ্রাবাদ পর্যন্ত, ভাড়া উঠানামা ১০ টাকা’। শনিবার বিকেলে এমন চিত্র দেখা যায় বন্দরনগরীর ব্যস্ততম ইপিজেড মোড়ে। ছয় নম্বর রুটের ওই বাসটির গন্তব্য কাটগড় থেকে ইপিজেড হয়ে নগরীর লালদীঘির পাড়। কিন্তু বাসটি আগ্রাবাদেই যাত্রীদের নামিয়ে দিচ্ছে। কাটগড় থেকে লালদীঘির পাড় পর্যন্ত ভাড়া ১২ টাকা। অথচ ইপিজেড থেকে আগ্রাবাদ পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে ১০ টাকা। বিকেলে অফিস ছুটির পর আর সকালে অফিস শুরুর সময় এমন দৃশ্য নগরীর প্রতিটি ব্যস্ততম মোড়ে। নির্ধারিত গন্তব্যে না গিয়ে মাঝপথে যাত্রীদের নামিয়ে দেয়া হচ্ছে। আবার ভাড়াও নেয়া হচ্ছে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ। নগরীতে পরিবহন সঙ্কটকে পুঁজি করে এভাবে যাত্রীদের পকেট কাটা হচ্ছে নিয়মিত। অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন আর ট্রাফিক আইন ভাঙার প্রবণতায় চরম বিশৃঙ্খলা গণপরিবহনে।
ট্রাফিক বিভাগের হিসাবে, নগরীর ১৭টি রুটে ১৫শ’ ৪৭টি বাসের রুট পারমিট দেয়া আছে। কিন্তু বাস্তবে বাস চলছে এক হাজারেরও কম। আর এদের বিরাট একটি অংশ বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী পরিবহনের জন্য রিজার্ভ ভাড়ায় চলে যাচ্ছে। ত্রæটিসহ নানা কারণে একটি অংশ বিকল বসে থাকছে টার্মিনালে। এতে গণপরিবহন সঙ্কট চরমে উঠেছে। বিশেষ করে অফিস শুরু ও ছুটির সময় কর্মজীবী লোকজনদের চরম দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এ সঙ্কটের কারণে ভাড়া নৈরাজ্যে মেতে উঠেছে পরিবহন চালক ও সহকারীরা। নগরীতে টেম্পু ও হিউম্যান হলারের ১৬টি রুট রয়েছে। এসব রুটে ১২শ’ ২৫টি যানবাহনের রুট পারমিট রয়েছে। কিন্তু রাস্তায় নেই বেশিরভাগ যানবাহন। নগরীতে টেম্পু চলছে ৬৮২টি, রুট পারমিট রয়েছে ১২শ’ টেম্পুর। বাস সঙ্কটের কারণে নগরীর বিভিন্ন রুটে টেম্পু, ব্যাটারিচালিত টমটমসহ অবৈধ যানবাহনের রীতিমত ঢল নামে। সম্প্রতি উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে এসব অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয় পুলিশ। এর ফলে গত কয়েকদিনে নগরীতে পরিবহন সঙ্কট চরমে উঠেছে।
নগরীর বিমানবন্দর থেকে ইপিজেড রুটে তিন শতাধিক টেম্পু চলাচল করে। চালকরা বলছেন, এদের মধ্যে রুট পারমিট রয়েছে মাত্র ৫০টির। হঠাৎ করে অবৈধ টেম্পু চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় আড়াই শতাধিক টেম্পু শহর থেকে উঠে গেছে। ফলে ওই রুটে যাতায়াতকারী যাত্রীদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। একই অবস্থা নগরীর প্রায় প্রতিটি এলাকায়। নগরীতে বাস-মিনিবাস ও টেম্পুর সর্বনিম্ন ভাড়া (উঠানামা) ৫ টাকা হলেও বেশিরভাগ এলাকায় দ্বিগুণ এবং কোন কোন এলাকায় চারগুণ পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে।
বিষয়টি স্বীকার করে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) কুসুম দেওয়ান গতকাল রোববার ইনকিলাবকে বলেন, আদালতের নির্দেশে রুট পারমিটবিহীন যানবাহন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ কারণে পরিবহন সঙ্কটে জনগণ দুর্ভোগের মুখোমুখি হচ্ছে। তিনি বলেন, এমনিতেই নগরীতে গণপরিবহনের স্বল্পতা রয়েছে। রুট পারমিট নিয়েও অনেক বাস-মিনিবাস রাস্তায় চলছে না। তিনি বলেন, পরিবহন সঙ্কট নিরসনে ট্রাফিক বিভাগ ও বিআরটিএ’র পক্ষ থেকে পরিবহন মালিক সমিতির সাথে কয়েক দফায় বৈঠক করা হয়েছে। বিআরটিএএর উদ্যোগে জরিপ করে নগরীতে রুট পারমিট পাওয়া বাস চলাচল নিশ্চিত করারও উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে এর কোনটিই তেমন ফলপ্রসু হয়নি।
দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী ও দ্বিতীয় বৃহত্তম এ মহানগরীর লোকসংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ। নগরবাসীর বিরাট একটি অংশ গণপরিবহনের উপর নির্ভরশীল। দেশের সর্ববৃহৎ ইপিজেড চট্টগ্রাম ইপিজেডে কর্মরত দেড় লক্ষাধিক শ্রমিক। কর্ণফুলী ইপিজেডে শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় পৌনে এক লাখ। কালুরঘাট, ষোলশহরসহ বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে কর্মরত আরও কয়েক লাখ শ্রমিক। নগরীর সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রধান বাহন গণপরিবহন। অথচ এ বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য গণপরিবহনের সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা। রুট পারমিট নিয়েও রাস্তায় চলছে অনেক বাস-মিনিবাস। এদের একটি অংশ ইপিজেডসহ বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক পরিবহনে রিজার্ভ ভাড়ায় চলে যায়। এ সঙ্কট নিরসনে নগরীর বিভিন্ন রুটে রুট পারমিট পাওয়া বাসের অতিরিক্ত ১০০শ’টি বাস নামানোর সিদ্ধান্ত হয় ১০ বছর আগে। এখনো পর্যন্ত রাস্তায় নেমেছে মাত্র ৪০টি বাস।
বাস সঙ্কটকে পুঁজি করে নগরীতে ছোট গাড়ির সংখ্যা বেড়ে গেছে। এতে করে গণপরিবহনে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে ট্রাফিক ব্যবস্থা। বন্দরের কারণে মহানগরীর বিরাট অংশে দিনের বেলায়ও ভারী যানবাহন চলছে। এতে করে নগরীতে তীব্র যানজট হচ্ছে। বৈধ-অবৈধ মিলে নগরীতে প্রায় দুই লাখের মতো রিকশা চলছে। গণপরিবহনের বিশাল অংশের নেই কোন ফিটনেস। চালকদেরও নেই কোন সনদ বা প্রশিক্ষণ। যেখানে-সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা হচ্ছে। ব্যস্ত সড়কে প্রতিযোগিতায় নামছে বাস চালকেরা। ট্রাফিক আইন মানছে না বেশিরভাগ চালক। এর ফলে বেপরোয়া যানবাহন চলছে নগরীতে। বন্দর ছাড়া নগরীর অন্য এলাকায় দিনের বেলা ট্রাকসহ ভারী যানবাহন চলাচল নিষেধ থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। এতে করে প্রায়ই দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটছে।
এদিকে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনার উদ্যোগ নিয়েছেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে তিনি ট্রাফিক বিভাগ, বিআরটিএ, গণপরিবহন মালিক ও চালক সমিতির নেতাদের সাথে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন জানিয়েছেন, শৃঙ্খলা আনতে রমজান মাসেই কাজ শুরু করবেন তিনি। এ লক্ষ্যে রোজার শুরু থেকেই নগরীতে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান শুরু হবে। মেয়র বলেন, চট্টগ্রামকে একটি বিশ্বমানের নগরী হিসেবে গড়ে তোলার অংশ হিসেবে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পরিবহন খাতকে এক ছাতার নিচে আনা হবে। একেকটি রুটে একেকটি কোম্পানির বা ব্যবস্থাপনায় অধীনে নিয়ে আসার কাজ শুরু হয়েছে। নগরীতে স্থায়ী কোন টার্মিনাল নেই। কর্পোরেশনের উদ্যোগে স্থায়ী টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ