Inqilab Logo

রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

‘টাকশালে’ বিতর্কিতকে নিয়োগের পাঁয়তারা

প্রকাশের সময় : ৮ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হাসান সোহেল : টাকশাল। দেশের টাকা ছাপানোর প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮শ’ কোটি টাকা চুরির ঘটনায় সারাবিশ্ব তোলপার। বাংলাদেশ ব্যাংক ইস্যুতে মন্ত্রণালয় থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান সর্বত্র সতর্ক। অথচ বিতর্কিত এক ব্যক্তিকে টাকা ছাপানোর স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান ‘টাকশালে’ নিয়োগ দেয়ার পায়তারা চলছে। টাকশাল নামে পরিচিত দ্যা সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন বাংলাদেশ লিমিটেড নামে এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনস্থ। এমনিতেই প্রতিষ্ঠানটিতে অনিয়ম পিছু ছাড়ছেনা। ২০১০ সালে ক্রয় করা বিদেশি প্রতিষ্ঠান কেবিএ-নোটাসিস সুইসের টাকা ছাপানোর মেশিনটির দাম ১২৪ কোটি টাকা ও ২০১৪ সালে ক্রয় করা একই কোম্পানির মেশিনটির দাম ১৪২ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। যা মেশিন দুটির প্রকৃত দামের অধিক। এই মেশিন দুটি ক্রয়ে বড় ধরণের অনিয়ম নিয়ে এখনো দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান চলছে। এর শেষ না হলেও নতুন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিতর্কিত কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়ার পায়তারা চলছে। আর এতে করে আবারও বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানটিকে বলে আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।      
সূত্র মতে, সম্প্রতি টাকশালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জিয়াউদ্দীন আহমেদের দায়িত্বের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এই কর্মকর্তার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই টাকশালের এমডি হিসেবে বিতর্কিত এক কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিতে প্রস্তাব করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সদ্য পদত্যাগকারী গভর্নর ড. আতিউর রহমান দায়িত্বে থাকাকলীন প্রতিষ্ঠানটির এমডি হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক বিষ্ণুপদ সাহাকে নিয়োগ দেয়ার সুপারিশ করেন। এই পদের জন্য একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে বিষ্ণুপদ সাহার নাম পাঠান ড. আতিউর। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা চুরি ঘটনার পর অর্থমন্ত্রণালয় এ প্রস্তাবকে ফিরিয়ে দিয়ে আরও নাম পাঠানোর জন্য বলেছে। অর্থমন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্রটি জানায়, শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করায় বৈধতা দিতে আরও কিছু নাম চাওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র মতে, দ্যা সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন বাংলাদেশ লিমিটেড ঢাকার বাইরে গাজীপুরে অবস্থিত। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে দায়িত্ব পালন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহি পরিচালক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ক্ষমতাবলে এ প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান। সম্প্রতি বর্তমান এমডির মেয়াদ শেষ হয়েছে। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই এমডি পদে নিয়োগ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু এক বিতর্কিত কর্মকর্তার নাম অনুমোদনের জন্য প্রস্তাব পাঠায় অর্থমন্ত্রণালয়ে। সূত্র জানিয়েছে, নামটি নিয়ে বিতর্ক থাকায় প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে অর্থমন্ত্রণালয়। টাকশালের এমডি হিসেবে একাধিক কর্মকর্তার নামের প্রস্তাবও চেয়েছে মন্ত্রণালয়। সূত্র আরও জানায়, টাকশালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে একজন ব্যক্তির নাম পাওয়ায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ক্ষুদ্ধ হন। ড. আতিউর রহমানের সুপারিশকৃত ওই পদে একটি নাম থাকায় তিনি তাৎক্ষনিক এ পদের জন্য একাধিক নাম প্রদানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়েছেন।
কে এই বিষ্ণুপদ সাহা
বিষ্ণুপদ সাহা ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। সর্বশেষ ২০১৫ সালের জুলাই মাসে চার জন সিনিয়র কর্মকর্তাকে পেছনে ফেলে সাবেক গভর্নরের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত বিষ্ণুপদ সাহা পদোন্নতি পেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হন। পরে তাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের বগুড়া অফিসের দায়িত্ব দেয়া হয়। এখন তিনি নির্বাহী পরিচালক হিসেবে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের বগুড়া অফিসে।
সূত্র মতে, আগে থেকেই বিষ্ণুপদ সাহা বিতর্কিত ছিলেন। নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ ছিল এ বিতর্কিত কর্মকর্তার নামে। তিনি যখন বাংলাদেশ ব্যাংকে যুগ্ম-পরিচালক ছিলেন, তখন কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে বড় ধরণের উৎকোচ নেয়ার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে।  তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো (বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন) থেকে তার বিরুদ্ধে একটি চিঠির রেফারেন্সও আসে বাংলাদেশ ব্যাংকে।
জানা যায়, বিষ্ণুপদ তখন ব্যাংকগুলোর তদারকিতে নিয়োজিত ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-১ (ডিবিআই-১ নামে অভিহিত) এ যুগ্ম-পরিচালক ছিলেন। এ বিভাগ থেকে ব্যাংকগুলোতে নানা অনিয়ম ধরতে পরিদর্শনে যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। বিষ্ণুর বিরুদ্ধে এমনই একটি ব্যাংকে পরিদর্শনে গিয়ে উৎকোচ নেয়ার অভিযোগ ওঠে। যখন এ অভিযোগ আসে তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ছিলেন মুহাম্মদ এ (রুমি) আলী। দুর্নীতি দমন ব্যুরোর এ চিঠির প্রেক্ষিতে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে বদলী করার নির্দেশ দেন রুমী আলী। তিনি সংশ্লিষ্ট বিভাগকে এমনও নির্দেশ দেন, যে বিভাগে মধু নেই ওই বিভাগে তাকে বদলী করতে। রুমী আলীর নির্দেশে তাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মানিটারি পলিসি বিভাগে বদলী করা হয়। পরবর্তীতে ডিজিএম করে ডেট ম্যানেজমেন্ট বিভাগে পাঠানো হয়।   
ডেট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট বা ঋণ ব্যবস্থাপনা বিভাগেই ডিজিএম থেকে জিএম পদে পদোন্নতি  নেন তিনি। রেমিটেন্স ও বিনিয়োগ মেলা আয়োজন তহবিল নাম দিয়ে দুই দেশে যাওয়ার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বুদ্ধিও দেন তিনি। তার পরিকল্পনার আলোকে কর্মকর্তাদের ভ্রমণ খরচ বাবদ ১৬ টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছ থেকে লন্ডন ও নিউইয়র্কে যাওয়ার জন্য ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ওই সফরে জিএম বিষ্ণুপদ সাহাও বিদেশে গিয়েছিলেন। ১৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রতিটির কাছ থেকে ৪ লাখ করে টাকা নেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে টাকা  নেওয়ার বিষয়টি ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করে।
এদিকে এমনিতেই বাজার মূল্যের চাইতে বেশি মূল্যে টাকা ছাপানোর মেশিন কেনার মাধ্যমে সরকারের শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এরপর আবার রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানটিতে বিতর্কিত ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়ার পায়তারায় রিভার্জ চুরির ঘটনায় টালমাটাল বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরণের ক্ষোভ বিরাজ করছে। অনেকের মতে, এই ধরণের বিতর্কিত ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া হলে প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের মুখে পড়বে।  
টাকশালের ইতিহাস
বাংলাদেশের মুদ্রার নাম টাকা, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এই নামটিই মুদ্রার সরকারি নাম হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ তারিখ থেকে ১ টাকার নোট প্রচলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে নিজস্ব ব্যাংক নোট চালু করে। ১৯৭৪ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত চালু থাকা এই নোট ছাপা হয় ইন্ডিয়ান সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে। পরে সুইজ্যারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ভারত, কোরিয়া, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশের নোট ছাপা হয়। গাজীপুরে অবস্থিত দেশের প্রথম ও একমাত্র আধুনিক টাকশাল থেকে ব্যাংক নোট ছাপানো শুরু হয় ১৯৮৮-১৯৮৯ সালে। টাকার নোট ছাপানোর প্রথম বছর ২৬ কোটি ৪৩ লাখ পিস নোট ছাপানো হয়। আর গত বছরে ছাপনো হয় প্রায় ১১০ কোটি লাখ পিস নোট। টাকা ছাপাকেন্দ্রিক এই প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ৮০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন। টাকশাল সূত্রে জানা যায়, ১০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা মূল্যমানের ব্যাংক নোটগুলো ছাপানোর কাজ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এক, দুই ও পাঁচ টাকার টাকার নোট ও ধাতব মুদ্রা সরকারি হিসেবে বের করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এসব নোট ছাপানোর কাজটি করে একমাত্র টাকশাল। তবে কয়েন বা ধাতব মুদ্রাগুলো জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্সসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে মুদ্রণ করা হয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ‘টাকশালে’ বিতর্কিতকে নিয়োগের পাঁয়তারা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ