Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন বার্তা

মালয়েশিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর শপথ নিলেন মাহাথির

| প্রকাশের সময় : ১১ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মাহাথির বিন মোহাম্মদ নেতাদের নেতা, বিশ্বনেতাদের মহাবিশ্বনেতা। দেশের মানুষের স্বার্থে ‘মসনদে বসা’ এবং হাসিমুখে ‘মসনদ ত্যাগ’ তাদের মতো বরেণ্য নেতাদের পক্ষ্যেই সম্ভব। নেলসন ম্যাÐেলা, হুগো শ্যাভেজ, ফিদেল কাস্টো, সাদ্দাম হোসেনরা বেঁচে নেই। বিশ্বজুড়ে ট্রাম্পিজমের পাগলানাচ আর পুতিনবাদের দম্ভের যুগে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন মুসলিম দেশ মালয়েয়িশায়। বিশ্ব রাজনীতিতে বিজলির চমক দিয়ে ৯২ বছর বয়সে মাহাথির বিন মোহাম্মদ গতকাল মালয়েশিয়ার সপ্তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন। দেশে নতুন নতুন নেতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নিজের ইচ্ছায় ক্ষমতা থেকে সরে গিয়ে দীর্ঘদিন রাজনীতি থেকে দূরে থেকে আবার রাজনীতিতে ফিরে এসে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করলেন গণতন্ত্রের এই বিশ্ব দূত। নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বাধীন জোট পাকাতান হারাপাত বিজয়ী হওয়ায় রাজা সুলতান মোহাম্মদ কেন্দ্রীয় সরকার গঠনে আমন্ত্রণ জানান মাহাথির মোহাম্মদকে। মালয়েশিয়ার স্থানীয় সময় গতকাল রাত ১০টায় (বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা রাত ৮টা) রাজপ্রসাদে রাজা সুলতান মোহাম্মদের উপস্থিতিতে শপথ নেন তিনি। মালয়েশিয়ার বর্ষীয়ান এই রাষ্ট্রনায়ক এখন বিশ্বের সব চেয়ে বয়স্ক জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে মালয়েশিয়ার ইতিহাসে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়া প্রথম প্রধানমন্ত্র্।ী এর আগে ১৯৮১ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে তিনি মালয়েশিয়াকে বিশ্বের উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে গেছেন। দেশটি বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছে। জনগণের ভোটে প্রধানমন্ত্রী হয়ে মাহাথিরের এই ফিরে আসা বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর নেতাদের জন্য শিক্ষনীয় বটে।
বুধবার মালয়েশিয়ার ১৪তম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিশাল, চমকপ্রদ জয় পেয়েছেন দীর্ঘদিন পর রাজনীতিতে ফিরে আসা সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। এ নির্বাচনের ফলাফলে তার নেতৃত্বাধীন পাকাতানলহারাপান (আশার জোট)কে জয়ী ঘোষণা করেছে দেশটির নির্বাচন কমিশন। বুধবার স্থানীয় সময় রাত ১টা ১০ মিনিটে নির্বাচন কমিশন এ ফলাফল ঘোষণা করে।
এদিকে ভোট গণনার সরকারী ফলাফলে দেখা যায় যে মাহাথির মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট পাকাতান হারাপান (পিএইচ) ২২২টি আসনের মধ্যে ১১৩টি আসন পেযেছে। ক্ষমতাসীন বারিসান ন্যাসোনাল (বিএন) জোট পেয়েছে ৭৯টি আসন। এছাড়া ইসলাম পার্টি ইসলাম- সে মালয়েশিয়া পেয়েছে ১৫টি আসন।
সরকার গঠনে পিএইচ-এর দরকার ছিল ১১২টি আসন। বুধবার সকাল ৮টা থেকে শুরু হওয়া ভোটগ্রহণ শেষ হয় স্থানীয় সময় বিকেল ৫টায়। মালয়েশিয়ার ভোটারের সংখ্যা দেড় কোটি। প্রথমদিকে নির্বাচনে তুমুল প্রতিদ্ব›িদ্বতা পরিলক্ষিত হয়। তারপরই পাকাতান হারপানকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। দেশটিতে স্বাধীনতার পর থেকেই ক্ষমতায় থাকা তারই সাবেক দল ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের নেতৃত্বাধীন বারিসান ন্যাশনাল কোয়াালিশন এই প্রথমবারের মতো হারলো।
বৃহস্পতিবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে নাজিব রাজজ্জাক বলেন, তিনি ‘জনগণের রায়’ মেনে নিয়েছেন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি একথাও বলেন যে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী যিনি হবেন তাকে সংসদ সদস্যদের আস্থা অর্জন করতে হবে। তিনি বলেন, কোনো দলেরই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। ৪ দলের শিথিল জোট পিএইচ কার্যকর সরকার গঠন করতে পারবে কিনা তার সন্দেহ আছে। নাজিব বলেন, মালয়েশিয়ার রাজা সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি কাকে প্রধানমন্ত্রী করবেন।
মালয়েশিয়ায় সরকার গঠন কিছুটা বিলম্বিত হয়। বলা দরকার, প্রধানমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ মালয়েশিয়ার রাজা সুলতান পঞ্চম মুহাম্মদের অনুমতির উপর নির্ভরশীল। মালয়েশিয়ায় কোনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার না থাকায় সরকার গঠন জরুরী। তাই বৃস্পতিবারই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সর্বশেষ খবরে বলা হয়, ড. মাহাথির মোহাম্মদকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের জন্য রাজা অনুমোদন দেন। তাকে শপথ গ্রহণের জন্য রাতে রাজপ্রাসাদে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি রাজপ্রাসাদে পৌঁছে শপথ গ্রহণ করেন।
চ্যানেল নিউজ এশিয়ার খবরে বলা হয়, মাহাথির মোহাম্মদ বলেন, তিনি বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় বিকেল ৫টার মধ্যে নয়া সরকার গঠন করতে চান। তিনি বৃহস্পতিবার কুয়ালালামপুর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমাদের এখন সরকার গঠন করা দরকার। অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে নাজিব সরকারের শাসন শেষ হয়ে গেছে। এ সময় ওয়ান আজিজা ও লিম গুয়ান এং তার সাথে ছিলেন। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে বিলম্বের অর্থ দেশে কোনো সরকার থাকবে না। সরকার নেই মানে আইন নেই। সুতরাং সরকার গঠন জরুরি। মাহাথির মোহাম্মদ বলেন, তিনি ১৩৫ জন নির্বাচিত সংসদ সদস্যের নেতৃত্ব দেয়ার আশা করছেন। এদিকে এ বিজয়ের জন্য ইতোমধ্যেই মাহাথিরকে রাজনীতির জাদুকর, নতুন ইতিহাস রচয়িতা, রেকর্ড ভাঙ্গার রেকর্ড গড়ার নায়ক ইত্যাদি অভিধায় ভ‚ষিত করা হয়েছে।
মাহাথির সাংবাদিকদের বলেন, আমরা প্রতিশোধ নিতে চাই না, আমরা শুধুমাত্র আইনের শাসন পুনর্বহাল করতে চাই। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাতের জন্য আমরা নাজিবের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করছি না। আমরা আইনের শাসন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি।’
মাহাথির প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন দু’বছর পর তিনি ক্ষমতা আর কারও হাতে তুলে দেবেন। এর আগে তিনি অনেককে অবাক করে স্বীকার করেন, তিনি জীবনে অনেক ভুল করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে আনোয়ার ইব্রাহিমকে বরখাস্ত করা। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা মালয়েশিয়ার রাজনীতির ক্ষেত্রে আরেকটা চমক সৃষ্টি করতে পারে, কারণ সেক্ষেত্রে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবার বড় ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে সাবেক উপ প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের যিনি মাহাথিরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং মতবিরোধের কারণে যাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ছিলেন মাহাথির নিজেই। সমকামিতার অভিযোগে তিনি বর্তমানে তিনি কারাদÐ ভোগ করছেন। আনোয়ার ইব্রাহিম আগাগোড়াই একে একটি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা বলে আখ্যায়িত করেন।
১৯৫৭ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকেই দেশটিতে ক্ষমতায় রয়েছে বারিসান ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স। কিন্তু দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিসহ নানা অভিযোগে সা¤প্রতিক বছরগুলোতে তাদের জনপ্রিয়তা কমেছে।
উল্লেখ্য,ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই দেশটির রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল রাজনৈতিক জোট ‘ইউনাইটেড মালয়িজ ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন’ (ইউএমএনও) বা বারিসান ন্যাশনাল (বিএন)। ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই জোট মালয়েশিয়া শাসন করেছে। বারই এ জোট প্রথম পরাজয়ের শিকার হল। মাহাথির মোহাম্মদও এই জোটের অংশ ছিলেন। ক্ষমতায়ও এসেছিলেন, ছিলেন সবচেয়ে বেশি সময় ধরে।
বিশ্লেষকরা বলেন, মালয়েশিয়ার ভোটের এই ফলাফল অনেকটা দক্ষিণ-প‚র্ব এশিয়ায় একটি রাজনৈতিক ভ‚মিকম্পের মতো, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে এক পক্ষের শাসনের প্রবণতা রয়েছে এবং সা¤প্রতিক বছরগুলোতে এই প্রবণতা আরো বেশি কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে মোড় নিয়েছে।
এদিকে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরপরই মাহাথিরের উৎফুল্ল সমর্থকেরা কুয়ালালামপুরের রাস্তায় নেমে আসেন। ৩ কোটি ১০ লাখ মানুষের এই দেশটির জনগণকে ঐতিহাসিক এই বিজয়টি উদযাপন করতে জাতীয় পতাকা হাতে রাস্তায় গাড়ি বহর নিয়ে উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
খবরে বলা হয়, বেশিরভাগ মানুষই ধারণা করেছিল প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক আরেক মেয়াদের জন্য আবার জয়ী হবেন। কিন্তু তা হয়নি। কারণ ম‚লত অর্থনীতি। জীবনধারণের ব্যয় মালয়েশিয়ায় অত্যধিক বেড়ে গেছে এবং জিনিসপত্র ও বিভিন্ন সেবার ওপর সরকার নতুন নতুন কর আরোপ করেছে- যা কখনই জনপ্রিয় নয়।
মাহাথির মোহাম্মদের উত্থান
একুশ বছর বয়সে রাজনীতি শুরু করেন মাহাথির মোহাম্মদ। তখন তিনি তার সাবেক দল ইউএমনওতে যোগ দেন। যদিও পরবর্তী সাত বছর একজন চিকিৎসক হিসেবে তিনি প্র্যাকটিস অব্যাহত রাখেন।
১৯৬৪ সালে তিনি কেদাহ প্রদেশ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৬৯ সালে তিনি সেই আসনটি হারান ,আর দল থেকেও বহিষ্কৃত হন, কারণ তখনকার প্রধানমন্ত্রী টেঙ্কু আবদুল রহমানের সমালোচনা করে তিনি একটি প্রকাশ্য চিঠি লিখেছিলেন। এটি দলের তরুণদের তার পক্ষে টেনে নিয়ে আসে এবং তাকে পুনরায় দলে ফেরত নেয়া হয়। ১৯৭৪ সালে তিনি পুনরায় নির্বাচিত হন এবং শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পান। পরের চার বছরের মধ্যে তিনি ইউএমএনও দলের উপ নেতা নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে তিনি প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তার শাসনামলে মালয়েশিয়া দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। যদিও তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কিছু অভিযোগ আছে, কিন্তু অর্থনৈতিক সাফল্য তাকে মালয়েশিয়ায় অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তোলে। তিনি মুসলিম উম্মাহর সপক্ষে কথা বলেছেন এবং এ ব্যাপারে পাশ্চাত্যের কঠোর সমালোচক ছিলেন।
২০০৩ সালে তিনি পদত্যাগ করেন। অবসরের সময় তিনি বলেন, আমি অসন্তুষ্ট...কারণ সফল হওয়ার জন্য আমি যেসব অর্জন করতে চেয়েছিলাম, তার সামান্যই অর্জন করতে পেরেছি।
পরে তারই এক সময়ের শিষ্য, যার কাছে তিনিই ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন, সেই নাজিব রাজাকের দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে অবসর জীবন থেকে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হন মাহাথির। ২০১৬ সালে বারিসান অ্যালায়েন্স ত্যাগ করে আলাদা দল গঠন করেন তিনি। পরে তিনি বিরোধীদের নিয়ে জোট গঠন করেন। গত জানুয়ারিতে তিনি জাতীয় সির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার ঘোষণা দেন।

 



 

Show all comments
  • নেসার উদ্দিন ১১ মে, ২০১৮, ৩:০৩ এএম says : 0
    জনগণের ভোটে প্রধানমন্ত্রী হয়ে মাহাথিরের এই ফিরে আসা বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর নেতাদের জন্য শিক্ষনীয় উদাহরণ।
    Total Reply(0) Reply
  • পাবেল ১১ মে, ২০১৮, ৩:০৪ এএম says : 0
    এসব দেখে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে
    Total Reply(0) Reply
  • রফিকুল ইসলাম ১১ মে, ২০১৮, ৩:০৫ এএম says : 0
    এজন্যই মালয়েশিয়া অনেক এগিয়ে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ