Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিরপেক্ষ মিডিয়া প্রচন্ড চাপে

মৃত্যুদন্ডের রায়ে বাংলাদেশ তৃতীয় : অ্যামনেস্টির উদ্বেগ প্রকাশ

প্রকাশের সময় : ৭ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৪৮ পিএম, ৬ এপ্রিল, ২০১৬

ইনকিলাব ডেস্ক : বাংলাদেশে নিরপেক্ষ মিডিয়া প্রচন্ড চাপে রয়েছে। মুক্ত মত প্রকাশের ক্ষেত্রকে করা হয়েছে সীমাবদ্ধ। বিরোধী দলের শত শত সমর্থককে গ্রেফতার করা হয়েছে। ৪০ জনেরও বেশি মানুষকে গুম করা হয়েছে। বিদেশি নাগরিকদের ওপর হামলা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে ইতালির একজন এনজিওকর্মী ও এক জাপানিকে। হামলা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগার ও প্রকাশকদের ওপর। এতে কমপক্ষে ৫ জন নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিষ্ঠান অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
২০১৫ সালে ঘটে যাওয়া ঘটনার ওপর ভিত্তি করে ওই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এতে উঠে এসেছে সিলেটের শিশু শামিউল ইসলাম রাজন হত্যা প্রসঙ্গও। বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরকারবিরোধী আন্দোলন চালায়। সেই সময় কয়েক ডজন প্রাণ হারায়। আহত হন অনেকে। বিএনপির সিনিয়র সদস্যদের গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে অগ্নিসংযোগের অভিযোগ এনেছে পুলিশ। এর মধ্যে রয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাকে জেল থেকে মুক্তি দেয়ার কয়েক সপ্তাহ বা মাস পর পর বছরজুড়েই বার বার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মুক্তি দেয়ার আগে বিরোধী দলের কয়েক শত নেতাকর্মীকে দিনের পর দিন বা মাসের পর মাস আটক রাখা হয়। তাদের কারো কারো বিরুদ্ধে অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়েছে। অ্যামনেস্টি আরও বলেছে, বিদেশি কয়েকজন নাগরিকও হামলার শিকার হয়েছেন অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের হাতে। ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১৮ নভেম্বরের মধ্যে ইতালির একজন এনজিওকর্মী সিজার তাবেলা ও জাপানি নাগরিক হোশি কুনিওকে হত্যা করা হয়। বন্দুক হামলা থেকে বেঁচে গিয়েছেন ইতালির একজন ডাক্তার। চুরির অভিযোগে জুলাই মাসে ১৩ বছর বয়সী বালক শামিউল ইসলাম রাজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় সিলেটে। এতে পথশিশুদের দুর্ভোগ উপেক্ষা করার জন্য ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি হয়। এর পর পরই এ হত্যাকা- তদন্তের নির্দেশ দেয় সরকার। বছর শেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে বিচারের আওতায় ছিলেন কমপক্ষে ১৬ জন। মত প্রকাশের স্বাধীনতা অংশে বলা হয়েছে, সরকারের সমালোচনা করে এমন নিরপেক্ষ মিডিয়া রয়েছে প্রচ- চাপের মুখে। নভেম্বরে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সুপারিশ করে জাতীয় সংসদের সমালোচনা করার জন্য, দুর্নীতিবিরোধী এনজিও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের নিবন্ধন বাতিল করা উচিত। বিচার সুষ্ঠু হয়নি বলে সমালোচনা করেছিলেন সুশীল সমাজের এমন ৪৯ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ঢাকার একটি আদালত আদালত অবমাননার অভিযোগ এনেছেন। নভেম্বরে সরকার সামাজিক যোগাযোগ মিডিয়া ও অন্যান্য যোগাযোগ মিডিয়া বন্ধ করে দেয়। এটা মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করে দেয়া বলে মন্তব্য করেছে অ্যামনেস্টি। এতে আরও বলা হয়, গত বছর নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ মত প্রকাশের কারণে বগারদের ওপর হামলা চালায় কট্টরপন্থী গ্রুপগুলো। ফেব্রুয়ারিতে অভিজিত রায়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা রক্ষা পান। আগস্টে তিন বগার ওয়াশিকুর রহমান, নিলয় নীল ও অনন্ত বিজয় দাসকে হত্যা করা হয়। অক্টোবরে ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যের এক প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দিপনকে হত্যা করা হয়। এ হামলায় রক্ষা পান দু’ধর্মনিরপেক্ষ লেখক। অ্যামনেস্টি বলছে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে লেখা প্রকাশের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকার ব্লগার ও প্রকাশকদের অভিযুক্ত করেছেন।
গুম প্রসঙ্গে অ্যামনেস্টি তার রিপোর্টে বলেছে, সাদা পোশাকে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কয়েক ডজন মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে। পরে তারা কোথায় সে বিষয়ে তারা কিছু জানে না বলে দাবি করেছে। জাতীয় পত্রিকাগুলোর ওপর এক জরিপ চালিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র ইঙ্গিত দিয়েছে, কমপক্ষে ৪৩ জনকে গুম করা হয়েছে জানুয়ারী থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে। এর মধ্যে রয়েছেন দু’জন নারী। গুম হওয়া ৪৩ জনের মধ্যে পরে ৬ জনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তুলে নেয়ার পর ছেড়ে দেয়া হয়েছে ৪ জনকে। ৫ জনকে পাওয়া গেছে পুলিশি নিরাপত্তায়। বাকি ২৮ জন কোথায় বা তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা জানা যায়নি।
অ্যামনেস্টি তার রিপোর্টে বলছে, পুলিশি হেফাজতে থাকা অবস্থায় নির্যাতন ও অশোভন আচরণ করা হয় ব্যাপকভাবে। নির্যাতনের অভিযোগ তদন্ত হয়েছে এমন ঘটনা বিরল।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, সরকার জানুয়ারীতে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। তাতে যেসব মানুষ পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করতে চান তাদের জন্য ভীষণ কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। ওদিকে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ওমেন লইয়ার্স এসোসিয়েশনের মতে, জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে ২৪০টিরও বেশি ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে। মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধর্ষণ বেড়ে গেছে। কিন্তু অভিযুক্তদের শাস্তি পাওয়ার ঘটনা খুবই কম। এর কারণ, যথাযথ সময়ের অভাব ও কার্যকর তদন্তের অভাব। ধর্ষণের হাত থেকে যারা রক্ষা পেয়েছেন তাদেরকে প্রমাণ করতে হয় যে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের ওপর শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে। পাশাপাশি তাদেরকে শারীরিক পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়।
ওই রিপোর্টে মৃত্যুদ-ের অংশে বলা হয়েছে, গত বছর কমপক্ষে ১৯৮ জনের বিরুদ্ধে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদ- ঘোষণা করা হয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ২০১৫ সালে গত ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদ- কার্যকর হতে দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অ্যামনেস্টি মনে করে, মুত্যুদ-ে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। ২০১৫ সালে সারা বিশ্বে কার্যকর হওয়া মৃত্যুদ- নিয়ে সংস্থাটির। প্রতিবেদনে জানানো হয়, বিগত বছরে মৃত্যুদ- বৃদ্ধির হার ছিল উদ্বেগজনক, কেননা, গত ২৫ বছরের মধ্যে সে বছরই সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে। বাংলাদেশে ২০১৫ সালে মৃত্যুদ-ের রায় দেয়া হয়েছে ১৯৭টি। যা বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রেখেছে দেশটিকে। আর মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে চারটি।
বিভিন্ন দেশের প্রকাশ করা তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে সারা বিশ্বে মোট ১৬০০টি মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে, ২০১৪ সালের চেয়ে যা শতকরা ৫০ ভাগ বেশি। ২০১৫ সালে মৃত্যুদ- কার্যকর করা দেশের সংখ্যাও বেড়েছে। বিশ্বের মোট ৯৪ দেশের আইনে এখনো সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-। এর মধ্যে ২০১৫ সালে মৃত্যুদ- দিয়েছে ২৫টি দেশ। ২০১৪ সালে মৃত্যুদ- দেয়া দেশের সংখ্যা ছিল ২২।
আগের বছর মৃত্যুদ- দেয়নি এমন ছয়টি দেশও ২০১৫ সালে এ তালিকায় নাম লিখিয়েছে। এক্ষেত্রে আফ্রিকার দেশ শাদ-এর কথা আলাদাভাবেই অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কারণ, দেশটি গত এক দশকে একটিও মৃত্যুদ- কার্যকর না করলেও বিগত বছর এই দ- দিয়ে কেড়ে নিয়েছে ১০ জনের প্রাণ। সব মিলিয়ে সামষ্টিকভাবে মৃত্যুদ- বৃদ্ধি এবং এর পাশাপাশি কিছু দেশে নতুন করে এ প্রবণতা দেখা দেয়ায় অ্যামনেস্টি উদ্বিগ্ন। আন্তর্জাতিক এ মানবাধিকার সংস্থার মৃত্যুদ- বিষয়ক বিশেষজ্ঞ চিয়ারা সাংগিওরগিও বলেন, ‘(মৃত্যুদ-ের) এই নাটকীয় বৃদ্ধিতে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। মৃত্যুদ- কার্যকরের বৈশ্বিক প্রকৃত চিত্রটা নিশ্চয়ই আরো ভয়াবহ।’
অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে চীনসহ কিছু দেশের মৃত্যুদ-ের হিসেব আসেনি। চীনে প্রতি বছর সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদ- কার্যকর হয় বলে ধারণা করা হলেও সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। ‘রাষ্ট্রীয় গোপনীয় বিষয়’ হিসেবে বিবেচনা করে মৃত্যুদ- বিষয়ক সব তথ্য গোপন রাখে চীন।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদ- কার্যকর করেছে ইরান, পাকিস্তান ও সউদী আরব সারা বিশ্বের মোট মৃত্যুদ-ের ৯০ ভাগই হয়েছে এই তিন দেশে। এ বছর ৩২০ জনের মৃত্যুদ- কার্যকর করেছে পাকিস্তান। ইরান ওই এক বছরে এক হাজারের মতো মৃত্যুদ- কার্যকর করেছে। তবে এই তিন দেশের মধ্যে মৃত্যুদ- বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি সউদী আরবে। আগের বছরের তুলনায় ২০১৫ সালে শতকরা ৭৬ ভাগ মৃত্যুদ- বেড়েছে দেশটিতে।
অ্যামনেস্টি জানিয়েছে, সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ করার হাতিয়ার হিসেবে মৃত্যুদ-কে বেছে নিয়েছে অনেক দেশ। তবে চিয়ারা সাংগিওরগিও-র মতে, ‘সন্ত্রাস বন্ধ করার উপায় কখনোই মৃত্যুদ- নয়। কর্তৃপক্ষ যদি সত্যিই বোমা হামলা এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী কর্মকা- বন্ধ করতে চায়, তাহলে সন্ত্রাসবাদ এবং উগ্রবাদের মূল কারণগুলোর দিকে মনযোগ দিতে হবে।’ ২০১৫ সালে মৃত্যুদ- বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও প্রতিবেদনে কয়েকটি আশা জাগানিয়া তথ্যও দিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিবেদনে জানানো হয়, এখনো বিশ্বের ৯৪টি দেশে মৃত্যুদ-ের বিধান থাকলেও এর চেয়ে বেশি দেশ এই দ- থেকে সরে এসেছে। ১০২টি দেশে এখন আর মৃত্যুদ- নেই। তাছাড়া সাব-সাহারান আফ্রিকা অঞ্চলে মৃত্যুদ-ের হার কমেছে। সে অঞ্চলের কয়েকটি দেশ মৃত্যুদ- বন্ধ করার কথাও ভাবছে। সবার আগে বলতে হয় জিম্বাবোয়ের কথা। দেশটি গত দশ বছরে একটিও মৃত্যুদ- দেয়নি। সূত্র: বিবিসি, ডয়চে ভেলে, শীর্ষ নিউজ

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নিরপেক্ষ মিডিয়া প্রচন্ড চাপে
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ