Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চীনকে ডিএসই’র কৌশলগত বিনিয়োগকারী নির্ধারণ : অর্থনীতিতে যোগ হবে নতুন মাত্রা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৬ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

 নানা জল্পনা-কল্পনার পর অবশেষে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কৌশলগত অংশীদার হিসেবে চীনকেই বেছে নেয়া হয়েছে। গত বৃহষ্পতিবার শর্ত সাপেক্ষে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) চীনের সেনজেন ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের সমন্বয়ে গঠিত জোট কনসোর্টিয়ামকে ডিএসইর শেয়ার কেনার অনুমোদন দেওয়া হয়। এরফলে ডিএসইর শেয়ার ভারত না চীন পাবে, এ সংক্রান্ত পাঁচ মাসের বিতর্কের অবসান ঘটলো। এর আগে গত সোমবার বিশেষ সাধারণ সভায় ডিএসইর সদস্যরা চীনের পক্ষে সর্ব সম্মতি দিয়েছিল। ডিএসই’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেএএম মাজেদুর রহমান বলেছেন, বিএসইসি থেকে চ‚ড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া গেছে। শিগগিরই চীনের সঙ্গে চুক্তি সই হবে। প্রাথমিকভাবে চুক্তির জন্য ১৪ মে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। 

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ডিএসই সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারের ইতিহাসে এই চুক্তি হবে বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি চমকপ্রদ ঘটনা। এ সুযোগকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারলে শুধু পুঁজিবাজার নয়, দেশের পুরো অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হবে। বিশ্ব দরবারে ভাবমূর্তি উজ্জল হবে, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে আর বাজারে আসবে পরিপক্কতা। তবে খুব দ্রæত এর সফলতা পাওয়া যাবে না। এর জন্য কিছু সময় অপেক্ষা করতে বলে মনে করেন তারা। শাকিল রিজভী স্টক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও ডিএসই’র সাবেক পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, এই চুক্তি শুধু পুঁজিবাজার নয়, দেশের সমগ্র অর্থনীতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। এর পেছনে যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেন, চীনের এই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সাথে যুক্ত হওয়ার পর বিশ্ববাজারে ডিএসইএর পরিচিতি বাড়বে। কারণ বর্তমান বিশ্বের শক্তিশালী অর্থনৈতিক দেশগুলোর মধ্যে চীন অন্যতম। এর ফলে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে। এছাড়া পুঁজিাবাজারকে আরো আধুনিকায়নে চীন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করবে। এই জোট সম্পৃক্ত হলে দেশের হারানোর কিছু নেই মন্তব্য করে শাকিল রিজভী বলেন, এতে কোনো ক্ষতি নেই। কারণ তারা আমাদের সম্পদ নিয়ে যাবে না। শেয়ার অনুযায়ী লভ্যাংশ পাবে।
এর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের ও বিদেশিদের আস্থা বাড়বে উল্লেখ করে শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর আবু আহমেদ বলেন, কৌশলগত অংশীদার হওয়ার সুযোগ চীনকে দেওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। বাজারে পণ্যের বৈচিত্র্য আসবে। দেশের অনেক কোম্পানি বাজারে যুক্ত হতে আগ্রহী হবে। বিদেশি কোম্পানিও এতে অন্তর্ভুক্ত হবে।
তিনি বলেন, এই চুক্তির মাধ্যমে বিশ্বকে একটা সংবাদ দেয়া যে, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশ চীন অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অতএব তোমরাও এখানে বিনিয়োগ করতে আসো। অর্থাৎ বড় দেশ বিনিয়োগ করলে ছোটরাও উৎসাহ পায়। এই পদক্ষেপ নেয়ায় সরকারকে সাধুবাদ জানিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সত্য বলতে কি, বর্তমানে চীন বিশ্বে অর্থনীতির দিক থেকে প্রভাব খাটাতে চাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী তাদের বিনিয়োগ বাড়াতে চায়। কোনো একটা দেশের অর্থনৈতিক কেন্দ্র বলতে পুঁজিবাজারকেই বুঝানো হয়। তাই এখানে যেহেতু চীন বিনিয়োগ করছে অন্যখাতেও করবে।
২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ব্যাপক ধসের পর বাজারে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও স্টেকহোল্ডারদের আধিপত্য কমাতে উদ্যোগ নেয় সরকার। এরপর ব্যবস্থাপনা থেকে মালিকানা আলাদা করতে ‘ডিমিউচ্যুয়ালাইশেন অ্যাক্ট-২০১৩’ আইন প্রণয়ন করা হয়। আইন অনুযায়ী, স্টক এক্সচেঞ্জের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়াতে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারদের জন্য ২৫ শতাংশ শেয়ার বরাদ্দের ব্যবস্থা রাখা হয়।
সেই অনুযায়ী, দুই-তিন মাসে আগে এই শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেয় ডিএসই। পরে তা কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করে প্রস্তাবনা দেয় চীন ও ভারত। ভারতের ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের (এনএসই) নেতৃত্বাধীন ফ্রন্টিয়ার বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল এসোসিয়েশন অব সিকিউরিটিজ ডিলারস অটোমোটেড কোটেশন (নাসডাক) কনসোর্টিয়াম শেয়ার কিনতে আগ্রহ দেখায়।
ভারতের এনএসই জোট প্রতিটি শেয়ার ১৫ টাকা দরে কেনার প্রস্তাব করে। আর ৩ শতাংশ শেয়ার কেনার প্রস্তাব করে একই জোটের অংশীদার প্রতিষ্ঠান ফ্রন্টিয়ার বাংলাদেশ। বিডিং মূল্যের দিক দিয়ে এনএসই ও নাসডাক পিছিয়ে থাকলেও পরিষদের ২টি পদ চেয়েছে তারা। কিন্তু চীনের সেনজেন ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ জোটের একটি পরিচালক পদ চেয়েছে। এসব প্রস্তাব যাচাই করতে গত ২২ ফেব্রæয়ারি বিএসইসি’র নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ আহমেদকে আহŸায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি তাদের প্রতিবেদনে চীন ও ভারত জোটের বিভিন্ন অযৌক্তিক শর্ত বিশ্লেষণ করে। যেমন, চীনা জোট যুক্তরাজ্যের আইন অনুযায়ী চুক্তি করার শর্ত দিয়েছিল। এছাড়া কোনো বিবাদ দেখা দিলে তা যুক্তরাজ্যে আন্তর্জাতিক আরবিটেশন অনুযায়ী সমাধান এবং নতুন কৌশলগত বিনিয়োগকারী অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে কনসোর্টিয়ামের লিখিত অনুমোদনেরও শর্ত দেয় জোটটি; যা বাংলাদেশের আইনের পরিপন্থী।
জোটগুলোর দেয়া এসব প্রস্তাব যাচাই-বাচাই করে অবশেষে চীনের কনসোর্টিয়াম এক্সচেঞ্জকে অনুমোদন দিয়ে তা বিএসইকে জানায় ডিএসই। এরপর বৃহস্পতিবার বিএসইসি চীনা কনসোর্টিয়ামকে ডিএসইএর শেয়ার কেনার অনুমতি দেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ডিএসইর বøকড একাউন্টে রক্ষিত ২৫ শতাংশ বা ৪৫ কোটি ৯ লাখ ৪৪ হাজার ১২৫টি সাধারণ শেয়ার কিনবে কনসোর্টিয়াম। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতিটি শেয়ার ২১ টাকা দামে কিনবে জোটটি। যার মোট অর্থমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৯৯০ কোটি টাকা। এছাড়া কারিগরি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে ৩০০ কোটি টাকার (৩ কোটি ৭১ মার্কিন ডলার) বেশি ব্যয় করবে বলে প্রতিশ্রæতি দেয় প্রতিষ্ঠানটি।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের উপস্থিতিতে আগামী ১৪ মে রাজধানীর লা-মেরিডিয়ান হোটেলে শেয়ার বিক্রির এই চুক্তি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। তবে চীনা কনসোর্টিয়াম ও ডিএসইর মধ্যে সব দিক থেকেই বিস্তর পার্থক্য রয়েছে।
বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চীনা কনসোর্টিয়াম থেকে ডিএসই’র বয়স বেশি হলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। ডিএসই প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৪ সালে আর সাংহাই ও শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ হয় ১৯৯০ সালে। ডিএসইতে পাঁচটি পণ্য থাকলেও নিয়মিত কেনা-বেচা হয় ২টির। কনসোটিয়ামের রয়েছে ১১টি করে পণ্য। এর মধ্যে সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান হলো ১১ হাজার ৪৫৫টি এবং শেনজেনে রয়েছে ৭ হাজার ১০০টি প্রতিষ্ঠান। আর ডিএসইতে আছে মাত্র ৫৬৭টি।
মার্কেট ক্যাপিটালের দিক থেকে কয়েকগুণ এগিয়ে সাংহাই ও সেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ। ডিএসইর মার্কেট ক্যাপিটাল ৪৩ দমমিক ৮০ ইউএসডি। আর সাংহাই ও শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের যথাক্রমে ৫৪৩৮ দশমিক ২৪ ও ৩৪৫৮ দশমিক ১৪ ইউএসডি।###



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অর্থনীতি

৩ জানুয়ারি, ২০২৩
২১ নভেম্বর, ২০২২
১৭ নভেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ