পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার : ‘পৃথিবীটা ঘোরে না আমি বলি ঘোরে না ঘুরছে মানুষ’। ঢাকার এক বাংলা সিনেমায় মাতাল নায়কের এই চটকদার গান যেন সত্যি হয়ে দেখা দিচ্ছে। পৃথিবী নয় বরং মানুষ ঘুরছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটলেও আমরা লেখাপড়া না জানা সেই আদিম টিপসই (আঙুল ছাপ) যুগে ফিরে যাচ্ছি। এখন আর শিক্ষিত সমাজে বাহারী সিগনেচারে বিশ্বাস নেই। শিক্ষা যেন সুকুমার রায়ের ‘ষোল আনাই মিছে’ ছড়ার বাবু ও মাঝির কথোপকথনের মতোই। তুমি যতই বিদ্বান হও নিরক্ষর মানুষের মতোই তোমার আঙুলের ছাপ একমাত্র তোমার শনাক্তকরণ চিহ্ন। স্বাক্ষরে বিশ্বাস নেই; ফিরছি আঙুলের ছাপেই। শুধু মোবাইল সিম নিবন্ধনে নয়; অনেক অফিসে আঙুলের ছাপের মাধ্যমে কর্মচারীর হাজিরা গণনা করা হয়। অথচ স্বাক্ষরজ্ঞান হয়ে সই দিতে না পারার অপরাধে গ্রামের ভাগ্যবিড়ম্বিত গরীব নিরক্ষর অশিক্ষিত মানুষগুলোকে কতভাবেই না অপদস্থ করেছি।
শিক্ষাই জাতির মেরুদ-। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি ততবেশি উন্নত ও সমৃদ্ধ। এটা ঋষি-মনীষীদের কথা। যার জন্য শত বছর ধরে নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য কত কি না করছি। দেশে ‘টিপসই দেয়া মানুষ’ রাখবো না এমন শ্লোগানও দিয়েছে। আঙ্গুলের ছাপ দেয়া মানুষকে ঘৃণা করেছি। নিরক্ষরতা কী; বাংলাদেশে নিরক্ষরতার হার; নিরক্ষরতার স্বরূপ; নিরক্ষরতার কারণ; নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে অভিযান; নিরক্ষরতা দূরীকরণের উপায় কতকিছু ছাত্র জীবনে মুখস্থ করেছি। সর্বোপরি শিক্ষার সরঞ্জামের অভাব, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, সরকারের প্রত্যক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির অভাবের ফলে দেশের একটি বিরাট অংশ নিরক্ষর থেকে যাচ্ছে; এ নিয়ে ক্ষমতাসীনদের গালাগাল করেছি। সবকিছু আঙুলের ছাপের প্রতি ঘৃণা থেকে। দস্তখত দিতে না পারায় গ্রামের যারা শুধু টিপসইয়ের উপর নির্ভরশীল ছিলেন তাদের কতই না তুচ্ছজ্ঞান করেছি। অথচ আজ ২০১৬ সালে আবার সেই টিপসই হয়ে গেল রাষ্ট্রের কাছে ‘সবার চেয়ে দামি শিক্ষা’! মানুষের শনাক্তকরণে দস্তখত অকেজো আঙুলের ছাপই একমাত্র ভরসা!
পৃথিবীতে যখন কেনাবেচা, দলিল-দস্তাবেজের প্রচলন শুরু হয়েছে তখনই প্রচলন হয় টিপসই। তখন সাক্ষরতা তথা পড়ালেখার ক্ষমতা মানুষের ছিল না। যখন থেকে বেচাকেনায় শুরু হয় তখন থেকেই টিপসইয়ে হয় দলিল। শিক্ষাদীক্ষা শুরু হওয়ার পর দস্তখত আসে। রেজিষ্ট্রি অফিসে এখনো আঙুলের ছাপের প্রচলন বহাল আছে। তবে এই ৪৪ বছরে বহুবার নিরক্ষরতা দূরীকরণের প্রকল্পের মাধ্যমে আঙুলের ছাপ দেয়া থেকে মানুষকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছি; সামান্য শিক্ষা নিয়ে দস্তখত দেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছি। এখন দস্তখতের চেয়ে আঙুলের ছাপই বেশি গ্রহণযোগ্য হওয়ায় আবার ফিরে যাচ্ছি টিপসই-এ।
ইতিহাসে জানা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশে আর্যদের সময় শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত হয় এবং শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গকে সমাজে অত্যন্ত সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হয়। তখন শিক্ষালাভের সুযোগ কেবল বিশিষ্ট ও সম্ভ্রান্ত শ্রেণির পরিবারের ছিল একচ্ছত্র অধিকার। মুসলিম আমলেও একই অবস্থা বিরাজমান ছিল। ব্রিটিশ আমলে পাশ্চাত্য শিক্ষা দেশের যুবশক্তিকে গণশিক্ষার ব্যাপারে সচেতন করে। ঔপনিবেশিক যুগে ১৯০০ সালে ব্রিটিশ ভারতে সাক্ষরতার হার ছিল ৫.৬% এবং ৪০ বছর পরে ১৯৪০ সালে হয় ১৩.৯%। ১৯৪১ সালে অবিভক্ত বাংলায় সাক্ষরতার হার ছিল ১৬.১%। ১৯৪০ সালে গণসাক্ষরতার প্রতি জোর দেয়া হলে বাংলায় সাক্ষরতা আন্দোলন ‘শিখি একজন, শেখাই অন্য জনে’ ধ্বনি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। শিক্ষার জন্য নৈশ বিদ্যালয়, পল্লী পুনর্গঠনে কর্মচারী নিযুক্ত করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সে কর্মসূচির অবলুপ্তি ঘটে। পাকিস্তান আমলে একটি ১৯৫১ সালে ও ১৯৬১ সালে দুটি আদমশুমারি হয়। যেকোন ভাষার সুস্পষ্ট ছাপা অক্ষর পাঠে সক্ষম জনগণই প্রথম আদমশুমারিতে ‘সাক্ষর’ হিসেবে শ্রেণিভুক্ত হয়। এ সংজ্ঞায় মোট লোকসংখ্যার ২১.১% সাক্ষর ছিল। ১৯৬১ সালের আদমশুমারিতে সাক্ষর হিসেবে বিবেচিত হয় মোট জনসংখ্যার ১৭.৬% বাংলাদেশে ১৯৭৪, ১৯৮১, ১৯৯১, ২০০১ এবং ২০১১ সালে মোট ৫টি আদমশুমারি হয়। এ ছাড়া সাক্ষরতা অভিযান হয় দফায় দফায়। আঙুলের ছাপকে ঘৃণা করা এবং সাক্ষরজ্ঞানের মাধ্যমে দস্তখতকে উৎসাহিত করতে নানা ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। অথচ এখন সেই আদিযুগের সেই আঙুলের ছাপই বিজ্ঞানের সাফল্যের যুগের মানুষকে চেনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
আশির দশকের শুরুতে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবহারিক পরীক্ষায় নিরক্ষর দূরীকরণের জন্য পৃথক নম্বর দেয়া হতো। গ্রামগঞ্জে বয়স্কা শিক্ষা কেন্দ্র খুলেও রাতের বয়স্ক ব্যক্তিদের শিক্ষা দেয়া হতো। গ্রাম-গঞ্জে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায় যে, ক্ষেতমজুর, কৃষক, শ্রমিকদের মধ্যে যারা সই করার মতো শিক্ষা নেয়ার সুযোগ নেননি তারা নানাভাবে বিড়ম্বনায় পড়েছেন। বিশেষ করে নিরক্ষর গ্রাম সৃষ্টি ছিল গৌরবের ব্যাপার। এখনো সেটা আছে। কিন্তু যারা অ, আ, ক, খ বর্ণমালা না শেখায় টিপসইয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন তারা নিজের সই না শেখার সমাজে লজ্জাবোধ করতেন। যারা সই দিতে পারতেন তাদের মধ্যে একটা গর্ববোধ ছিল। সেটাই বাস্তবতা এবং স্বাভাবিক। অথচ এখন সিম নিবন্ধনে শিক্ষার মাধ্যমে শেখা দস্তখত যেন গুরুত্বহীন হয়ে গেছে। এখন সেই অগৌরবের লজ্জাবোধের টিপসই হয়ে উঠেছে শনাক্তকরণ চিহ্ন। বাবা হাতের আঙুল তুমি বেঁচে থাকো! কারণ, তুমিই একমাত্র আমার শনাক্তের ভরসা। কয়েক বছর আগে বিটিভিতে একটি বিজ্ঞাপন প্রচার হতো-‘যতই মাথা চুলকাও/ তোমার রাজা বাঁচাতে পারবে না’। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধনের তোড়জোড় দেখে বলতে ইচ্ছে করছে ‘যতই শিক্ষিত হও তোমার আঙুলের ছাপ ছাড়া চলবে না।’
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।