Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দেশে ধর্ষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে বাড়ছে গণপরিবহনে যৌন হয়রানি

মানবাধিকার কর্মীদের অভিযোগ-

| প্রকাশের সময় : ২৬ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : দেশে ধর্ষণের ভয়াবহ আকার ধারন করছে। বিশেষ করে শিশু ধর্ষণ ও গণপরিবহনে যৌন হয়রানির মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেই চলেছে। এ ব্যপারে পুলিশেরও গা-ছাড়া ভাব। খোদ রাজধানীতে যাত্রীবাহি বাসে ঘটছে যৌন হয়রানি। উত্তরা বিশ্বদ্যিালয়ের এক ছাত্রীকে বাড্ডা এলাকায় এবং মোহাম্মদপুরের দুই ছাত্রীকে ঢাকা মহানগরীর সবুজবাগ থানা এলাকায় বাসে ধর্ষণৈর চেষ্টা চালায় দুবৃত্তরা। এসব ঘটনায় অপরাধীরা গ্রেফতার হলেও বিচারে দীর্ঘসুত্রতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠছে ধর্ষণকারীরা।
মানবাধিকার সংগঠনের সুত্র মতে,চলতি বছরের জানুয়ারী ফেব্রæয়ারি,মার্চ ও এপ্রিল মাসের ২৩ তারিখ পর্যন্ত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ১১৯জন নারী গণপরিবহণে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সারা দেশে গত ১৫ মাসে গণপরিবহনে ১২১ নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, গত ১৩ মাসে বাস চালক- হেলপার ও তাদের সহযোগীরা ১৯টি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ৩৭টি ধর্ষণ ও ১৪টি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটিয়েছে। এসব ঘটনায় ৭৫ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, এ ধরনের ঘটনা ঘটলেই পুলিশ বলে তদন্ত করা হবে। প্রভাবশালী এবং রাজনীতিবিদের দ্বারা অনেক সময় প্রভাবিত হয় পুলিশ।ফলে ভিকটিমরা ন্যায় বিচার পাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই ঘুষ খেয়ে পুলিশ ধর্ষকদের ছেড়ে দেয় বলে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা যাচ্ছে না।
এলিনা খান আরো বলেন,সামাজিক অস্থিরতা, অপসংস্কৃতি, আকাশ সংস্কৃতি, অশ্লীলতা, ঘুষ, দুর্নীতিসহ নানা কারণে দিনে দিনে সামাজিক অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছে। পাশাপাশি অশ্লীলতার আগ্রাসনে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের অভাব ও সামাজিক অবক্ষয়ে ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে চরম নৈতিক অবক্ষয়, আকাশ সংস্কৃতি, মাদকের বিস্তার, বিচার প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ এই তিন মাসে ১৭৬টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। জানুয়ারি ও ফেব্রæয়ারি মাসে ৫৫টি করে এবং মার্চ মাসে ৬৬টি শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। প্রতি মাসে গড়ে ৫৫টির বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। তিন মাসে ধর্ষণের শিকার ১৭৬টি শিশুর মধ্যে ২০টি শিশুই গণধর্ষণের শিকার হয়। আটজন প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। তিন মাসে ২৫ শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় এবং তিনটি শিশু ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ২১টি শিশুকে।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, দেশে ধর্ষণ নামের নির্মমতা দিন দিন মহামারি আকার ধারণ করছে। শুধু নারীরাই নয়, শিশুরাও এ বর্বরতা থেকে রেহায় পাচ্ছেনা। ধর্ষণ কিংবা গণধর্ষণই শেষ নয়, ধর্ষণের পর নৃশংসভাবে খুন করা হচ্ছে। দেশে গত কয়েক বছর ধরে যেন ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর খুনের উৎসব চলছে।
শিশু অধিকার নিয়ে কর্মরত ২৬৯টি সংগঠনের জোট বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুস সহিদ মাহমুদ বলেন, দেশের শিশুদের পরিস্থিতি খুব খারাপ। ধর্ষণসহ বিভিন্ন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলছে। দিন দিন বাড়ছে। বেশির ভাগ ঘটনার বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, বিচার হলেও রায় কার্যকর হচ্ছে না।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১২ সালে দেশে ধর্ষণের ঘটনা তালিকাভুক্ত হয়েছিলো ৯৩টি। ২০১৭ সালে সেই সংখ্যা গিয়ে দাড়ায় এক হাজারেরও বেশীতে। তাই মানবাধিকার কর্মী ও সমাজকর্মীরা মনে করেন, ধর্ষকদের শাস্তি নিশ্চিত করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা উচিত।
বিশিষ্ট সমাজকর্মী ড. জোবাইদা নাসরিন বলেন, ধর্ষণের মামলাগুলোর বিচার যদি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে করা হতো এবং মামলাগুলোর যদি মেয়াদ বেধে দেয়া হতো তবে এগুলো কিছু কমতো বলে মনে হয়।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১২ সালে ৮৬ জন, ২০১৩ সালে ১৭৯ জন, ২০১৪ সালে ১৯৯ জন, ২০১৫ সালে ৫২১ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ৬৮৬টি শিশু ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ইভ টিজিং, যৌন হয়রানীসহ বিভিন্ন ধরনের যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে। ২০১৫ সালে সারা দেশে ৭২৭টি শিশু যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছিল। তবে তাদের জরিপ অনুসারে ২০১৫ সাল থেকেই শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন ও নিপীড়ন আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৪তে সর্বমোট ২২৪টি শিশু যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছিল। নারী ও শিশু মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের হিসাব অনুযায়ী, দেশে ২০১৬ সালে এক হাজারেরও বেশি নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। সংগঠনটি নারীর ওপর নির্যাতনের এমন নির্মম ও নিষ্ঠুর ধরনকে উদ্বেগজনক বলে বর্ণনা করেছে।
সারাদেশে অসংখ্য নারী প্রতিদিন পেশাগত কাজে কিংবা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে গণপরিবহনে চলাচল করছে। সমাজের নিন্ম আয়ের মানুষেরাই সাধারণত গণপরিবহন ব্যবহার করে। যারা মূলত গতিশীল রাখছে উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির চাকা। খোদ ঢাকায় শুধুমাত্র পোশাকখাতেই নিয়োজিত রয়েছে, দশ লক্ষেরও অধিক নারী কর্মী।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদে সংরক্ষিত ১৪টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে ২০১৭ সালের এপ্রিলে ৮৫ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে। মার্চ মাসে এ সংখ্যা ছিল ৮৮। ফেব্রæয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে মোট ৭৯। এরমধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৩, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে চার জনকে। এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১৬ জনকে। যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৩। জানুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে মোট ৭৬। এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৪, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪ জনকে। এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১২ জনকে। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে এ পর্যন্ত মোট ৩২৮ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। নারী নির্যাতনের চিত্র দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। বরং নির্যাতনের মাত্রায় যোগ হয়েছে নতুন কৌশল।
মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু ধর্ষকদের শাস্তির দাবি জানিয়ে বলেন, মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের অভাব ও সামাজিক অবক্ষয়ে ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। যারা অপরাধী তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে। অপরাধী একজন ব্যক্তি, কাজেই সে যতই শক্তিশালী হোক না কেন তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
তিনি বলেন,নির্যাতনের শিকার নারী প্রায়ই অভিযোগ করতে চায় না। কারণ তারা পুনরায় নির্যাতনের শিকার হয়। তাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও ছেড়ে দেয়ার ভয় দেখানো হয়। এই সংস্কৃৃতি থেকে বের হতে হলে সাইবার ক্রাইমের বিরুদ্ধে যে আইন হয়েছে তার যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া পরিবার থেকে সন্তানকে যেন যথাযথ মূল্যবোধ দিয়ে বড় করা হয় সে আহŸানও তিনি সকল অভিভাবকের প্রতি রাখেন।
আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভারসাম্যহীনতা, আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়া এবং অভিভাবকের অসচেতনতা শিশু ধর্ষণ বৃদ্ধির বড় কারণ। প্রতিরোধে দরকার দ্রæত বিচার এবং অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ