পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
শফিউল আলম ও আসলাম পারভেজ : সার্বিক অব্যবস্থাপনার শিকার হালদার রুই কাতলা মাছের ডিম-রেণু। সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতি আর গা-ছাড়া ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে পদে পদে। এ কারণে সংগৃহীত বিপুল পরিমাণ ডিম থেকে রেণু ফোটার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার ঠিক এই মুহূর্তে আংশিক মারা পড়ছে।
গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে গত শুক্রবার সকাল পর্যন্ত হালদা নদীর বুকে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশ (কার্প জাতীয়) মা-মাছ দলে দলে রেকর্ড পরিমাণে ডিম ছাড়ে। নানামুখী অব্যবস্থাপনার কারণে মাছের ডিম রেণুতে পরিণত হওয়ার আগেই কিছু কিছু সরকারি হ্যাচারিতে মারা যেতে দেখে ডিম সংগ্রহকারী জেলেরা মাথায় হাত দিয়েছেন। সরেজমিন অনুসন্ধানকালে সরকারি উদ্যোগে সিমেন্টের তৈরি হ্যাচারিগুলোতে ময়লা-আবর্জনা, পানিতে দূষণ, অপরিচ্ছন্নতা ও বিভিন্ন অনিয়ম চোখে পড়েছে। মৎস্য বিভাগের উদ্যোগে স্থানীয়ভাবে গঠিত হ্যাচারি ব্যবস্থাপনা কমিটির ছিল চরম অবহেলা।
এবার এতো বেশি হারে মা-মাছ ডিম ছাড়বে এরজন্য পর্যাপ্ত পূর্ব-প্রস্তুতি এবং কোনো রকমের সমন্বয়ই ছিল না। এ অবস্থায় গতকাল (শনিবার) পর্যন্ত অন্তত ৫শ’ থেকে সাড়ে ৫শ’ কেজি ডিম-রেণু মরে গেছে। হালদার রেণু গতবছর প্রতিকেজি এক লাখ টাকা দরে বিক্রি হয়। সেই রেণু থেকে পোনা, এরপর পরিপূর্ণ দুই আড়াই কেজি ওজনের (এক বছরে) প্রতিটি রুই কাতলা মাছের মূল্য হিসাব করলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক। এহেন অব্যবস্থাপনা ও অবহেলা অব্যাহত থাকলে সামনের কয়েকদিনে আরও ডিম-রেণুর অপমৃত্যু ঘটতে পারে। কেননা প্রকৃতির আপন নিয়মে ডিম থেকে ৯৬ ঘণ্টা পর রেণু ফোটার পুরো সময়ই স্পর্শকাতর। অপরিচ্ছন্ন ও দূষিত পানি ছাড়াও ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের কারণে ডিম-রেণু মারা যেতে পারে।
তবে এরমধ্যেও সুখবর হচ্ছে, হালদা পাড়ের জেলেদের সুদূর অতীতের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় যুগোপযোগী এবং উন্নততর ব্যবস্থাপনায় নদীর ধারে মাটির গর্ত তৈরি করা হয়েছিল আগেই। সেসব গর্তে হালদার প্রবাহিত স্বাভাবিক পানির সাহায্যে ‘আদি কায়দায়’ একশ’টি ছোট ছোট জলাধার বা বিশেষ কুয়া তৈরি করা হয়। সেখানে সংরক্ষিত ডিম থেকে রেণু ফোটার যে প্রক্রিয়া প্রাকৃতিক নিয়মের ধারায় চলছে তাতে কোনো ডিম বা রেণু মারা যাচ্ছে না। ফলে জেলে ও গবেষকদের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে কাজে লাগানো এ ধরনের প্রযুক্তিই লাগসই ও টেকসই প্রমাণিত হচ্ছে। বন্দরনগরীর অদূরে হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলা সংলগ্ন হালদার পাড়ে ডিম থেকে রেণু ফোটানোর উৎসবে মেতেছে জেলেরা। মাটির কুয়াগুলোতে কখন রেণু বিকশিত হবে রাত-দিন নিরলস খেটে সেই অপেক্ষায় আছে তারা।
দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র মিঠাপানির মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীতে মৌসুমের শুরুতেই এবার ১০ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশ মা-মাছের অন্তত ২২ হাজার ৬৮০ কেজি ডিম সংগৃহীত হয়েছে। ডিম রেণু ও পোনা তথা মৎস্যবীজে পরিণত হয়ে প্রায় সারাদেশে পৌঁছে গিয়ে উৎপাদিত হবে কয়েক হাজার কোটি টাকার মাছ। গত দুই দশকের মধ্যে ২০০১ সালেই হালদায় সর্বোচ্চ ৪৭ হাজার ৭শ’ কেজি ডিম সংগৃহীত হয়। গতকাল সরেজমিনে দেখা গেল, গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার নদীর সংগৃহীত ডিম সরকারি হ্যাচারি ও পুরনো পদ্ধতিতে মাটির কুয়া ও হ্যাচারির কুয়াগুলোতে রেণু ফোটানোর কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে ডিম আহরনকারীরা। মদুনাঘাট হ্যাচারি, শাহ মাদারি হ্যাচারি ও মাছুয়া ঘোনা তিনটি সরকারি হ্যাচারিসহ বিভিন্ন এলাকায় রেণু ফোটানোর উৎসব চলছে। তবে অব্যবস্থাপনা ও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির অভাবে অনেক ডিম রেণুতে পরিণত হওয়ার আগেই অপমৃত্যু ঘটেছে। এরজন্য ডিম সংগ্রহকারীরা মৎস্য ও হ্যাচারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক গাফিলতির অভিযোগ করেছেন। তারা বলেন, দীর্ঘদিনের অযতœ অবহেলা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পাকা হ্যাচারির কুয়াগুলো দূষিত হয়ে যায়। এমনকি পশু-পাখির বিষ্টা ছড়িয়ে থাকে। এক কুয়া থেকে অন্য কুয়ায় পানি চলাচলের কারণে ডিম সংগ্রহকারীরা চরম বিপাকে পড়েছে। হ্যাচারিতে ডিম থেকে রেণু ফুটানোর কাজে ব্যবহৃত পানি তোলার মেশিন অচল। বালতি ভরে নদী থেকে বহু কষ্টে পানি এনে কুয়ার পানি বদলাতে হচ্ছে।
গড়দুয়ারার মাছুয়াগোনা মৎস্য হ্যাচারির ডিম সংগ্রহকারী ওসমান গনি জানান, ১৬ বালতি পানিসহ ডিম সংগ্রহ করে তার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মাত্র একটি কুয়া। মাত্রাতিরিক্ত ডিম রাখাতে গিয়ে নষ্ট বা মরে যাচ্ছে। তার প্রায় ৫ কেজি ডিম নষ্ট হয়েছে। যার মূল্য ৩ লাখ টাকা। এ হ্যাচারির মোট ৩৯টি কুয়ার মধ্যে ২০টিই অকেজো। কেননা ডিম ছাড়ার আগে সংস্কার হয়নি। তাছাড়া পানির চরম সংকট। একই হ্যাচারির ডিম সংগ্রহকারী আবদুল মালেক জানান, তার ৮ বালতি পানিসহ ডিমের মধ্যে প্রায় ২ কেজি নষ্ট হয়ে গেছে। মদুনাঘাট হ্যাচারির ডিম সংগ্রহকারী আনোয়ার হোসেন জানান, হ্যাচারির সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অবহেলায় তার বেশ কিছু ডিম নষ্ট হয়েছে। এখানে পরিচ্ছন্ন পানি নেই। টিউবেওয়েল অকেজো। ৩১টি প্লাস্টিক ও পাকা কুয়ার মধ্যে ৭টি অকেজো। মধ্যম মার্দাশার শাহ-মাদারি হ্যাচারির ডিম সংগ্রহকারী সুমন জানান, পরিস্কার পানির অভাব এবং কুয়াগুলোতে ফাটল ধরেছে। এ কারণে ডিম সংরক্ষণ নিয়ে বিপাকে আছি। মাছুয়াঘোনা, মদুনাঘাট ও শাহ-মাদারি হাচারির ৪০টি কুয়া নষ্ট। ডিম সংগ্রহকারীরা জানান, উপজেলা মৎস্য অফিসার ও হ্যাচারির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকতাদের অবহেলার কারণে কুয়াগুলো নষ্ট। সেখানে ডিম রাখতে গিয়েই অপমৃত্যু ঘটছে।
ডিম সংগ্রহকারী মৃদুল জলদাশ জানান, আমরা রেণু ফোটাতে হ্যাচারিগুলো অল্পদিন ব্যবহার করি। সরকার আমাদের কাছ থেকে ৫ শতাংশ হারে টাকা নেয়। এরপরও এই হ্যাচারির কোন উন্নতি হয়নি। এদিকে আগামী সোমবার-মঙ্গলবার নাগাদ রেণু বিক্রি শুরু হবে জানিয়ে ডিম সংগ্রহকারী আনোয়ার বলেন, প্রতিকেজি রেণুর মূল্য এবার এক লাখ টাকায় উঠতে পারে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলা হতে রেণু ক্রেতারা আসতে শুরু করে হালদা পাড়ে ক্রেতা-বিক্রেতারা ভিড় করছেন। হালদার রেণু খুব তাড়াতাড়ি বড় হয় বলে চাহিদাও বেশি।
সংগৃহীত ডিম থেকে রেণু ফোটানোর ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার ব্যাপারে জানতে চাইলে হাটহাজারী উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা কাজী আবুল কালাম বলেন, বিগত বছরগুলোর চেয়ে এবার হালদা নদীতে মা-মাছ অতিরিক্ত ডিম ছেড়েছে। ডিম সংগ্রহকারীরাও পর্যাপ্ত ডিম সংগ্রহ করেছে। তাই হ্যাচারীর কুয়ার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। নষ্ট কুয়াগুলো আমরা খুব তাড়াতাড়ি মেরামত করে দেবো। পরিস্কার পানির জন্য আমরা দ্রæত ব্যবস্থা নিচ্ছি।
ডিম থেকে মৎস্য-রেণু ফোটার এ মুহূর্তে সার্বিক অব্যবস্থাপনার বিষয়ে আলাপকালে হালদা ও কর্ণফুলী নদী বিশেষজ্ঞ, হালদা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরীয়া গতকাল ইনকিলাবকে জানান, গোটা প্রক্রিয়াটি প্রাকৃতিক ও স্পর্শকাতর। মা-মাছেরা ডিম ছাড়ার ১৮ ঘণ্টা পর রেণু ফোটা ধীরে ধীরে শুরু হয়। সরকারি হ্যাচারিগুলো দীর্ঘদিন অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় ছিল। চুন দিয়ে পরিস্কার ও দূষণমুক্ত করা হয়নি। ৭টি হ্যাচারিতে ৫০ থেকে ৬০টি করে কুয়া রয়েছে। পূর্ব-প্রস্তুতিরও অভাব ছিল। তবে স্থানীয় অভিজ্ঞ জেলেদের সমন্বয়ে আমরা উদ্বুদ্ধ করে গড়দুয়ারা এলাকায় ৪০ জন উদ্যোক্তাকে সঙ্গে নিয়ে একশ’টি মাটির তৈরি গর্ত বা কুয়া করেছি হালদার কিনারেই। সেখানে হালদার স্বাভাবিক পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এই পুরনো পদ্ধতিকে যুগোপযোগী করার ফলে তা লাগসই হয়েছে। খরচও খুব কম। সেখানে কোনো ডিম বা রেণু নষ্ট হয়নি। এতে করে খুশি জেলেরা। ড. কিবরীয়া সুপারিশ করেন, হালদায় ডিম ছাড়ার মওসুম ভবিষ্যতে এপ্রিল মাসের ১৫/২০ দিন আগেই পাকা কুয়াগুলোর পানিতে চুন দিয়ে দূষণমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন করা, সমন্বয় ও মাটির পুরনো গর্ত বা কুয়ার প্রচলন বৃদ্ধিসহ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার তাগিদ দেন। অন্যথায় হালদার আহরিত ডিম নষ্ট বা মারা যাওয়া মানে জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষতি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।