Inqilab Logo

রোববার, ২৩ জুন ২০২৪, ০৯ আষাঢ় ১৪৩১, ১৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

শাহজালালে নিরাপত্তা বাড়লেও থেমে নেই যাত্রী হয়রানি

প্রকাশের সময় : ৫ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বাড়েনি যাত্রী সেবার মান। আগে লাগেজ পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমানবন্দরে যাত্রীদের অপেক্ষা করতে হত। এখনো সেই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি মেলেনি যাত্রীদের। এখন নতুন করে যাত্রীদের ভোগান্তি আরো বেড়েছে। বিদেশগামী যাত্রীদের বিমানবন্দরের দোতলায় প্রবেশ পথে দীর্ঘ সময় লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। নিরাপত্তা তল্লাশির নামে যাত্রীদের এ ভোগান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে প্রতিদিন। গত কয়েক দিন সরেজমিনে পরিদর্শনকালে এ দুর্ভোগের চিত্র দেখা গেছে। ভোক্তভোগী যাত্রীরা বলছেন, আগে দীর্ঘপথ জার্নি করে বিদেশ থেকে আসার পর লাগেজের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হত। এখন এর সাথে আরো নতুন উপসর্গযুক্ত হয়েছে। গতকাল বিমানবন্দরের দোতালায় দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষমান যাত্রীদের সাথে কথা বলে এসব অভিযোগ পাওয়া যায়। তাঁরা বলছেন, শুধু লাগেজ পেতে এবং প্রবেশ পথেই নয়, ইমিগ্রেশনেও যাত্রীদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। কিছু কর্মকর্তার নির্দয় আচরণে সর্বস্তররের যাত্রীরা দিশাহারা। ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিদেশে কর্মরত বৈধ শ্রমিকরাও চরম হয়রানি থেকে রেহাই পাচ্ছে না। স্বল্পশিক্ষিত যাত্রীদের নানা প্রশ্ন করে তাদের পাসপোর্ট আটকে রেখে টাকা আদায় যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করতে যাত্রীদের দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।
কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দির আবুল কালাম এর সাথে গতকাল কথা হয় বিমানবন্দরে। তিনি কুয়েতে চাকরি করেন। প্রায় দুই বছর পর গতকাল দেশে ফিরেছেন। আলাপ কালে আবুল কালাম বলেন, যাত্রী হয়রানি আর ভোগান্তির আর এক নাম হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। অত্যাধুনিক তথ্য প্রযুক্তির এ যুগেও ইমিগ্রেশনের নামে ওই বিমানবন্দরে এক জন যাত্রীকে ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট থেকে দেড় ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ইমিগ্রেশনের জন্য। পৃথিবীর সব দেশের বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশেন সম্পন্ন করতে লাগে মাত্র ৩০ থেকে ৫০ সেকেন্ড। কিন্তু শাহজালালে ঘটছে তার উল্টোটা।
অন্যদিকে ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, কাউন্টার বাড়ানোর জায়গা নেই। মাত্র ২২টি ইমিগ্রেশন কাউন্টার। পিকআওয়ারে যখন ৫/৬টি বিমান স্বল্প সময়ের মধ্যে অবতরণ করে তখন যাত্রীদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয়।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, মন্ত্রিসভা থেকে শুরু করে বিমানবন্দর-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার বিভাগীয় বৈঠকেও যাত্রী হয়রানি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে, সিদ্ধান্ত হচ্ছে হয়রানি বন্ধের। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। যাত্রী হয়রানি থামানো যাচ্ছে না কোনোভাবেই। বরং দিন দিন হয়রানির মাত্রা বেড়েই চলেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেখানে বিদেশের শ্রমবাজারে সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে হাড়ভাঙা পরিশ্রমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে আসছেন প্রবাসীরা, সেখানে ইমিগ্রেশনের হাতে তাদের নিয়মিত হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।
এদিকে বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় তিন ধরনের কর্মপরিকল্পনা দিয়েছে যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্ট (ডিটি)। তারপরেও বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় উল্লেযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। আগের মতোই লাগেজ পার্টি, দালাল, চোর-বাটপারদের আখড়া হয়েছে বিমানবন্দর চত্বর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানবন্দরের এক নিরাপত্তা কর্মী বলেন, পরিস্থিতি আগের চাইতে কিছুটা উন্নত হয়েছে। তবে যুক্তরাজ্য যেভাবে চাইছে সেরকম পরিবর্তন হয়নি। ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান বোর্ডিং ও ইমিগ্রেশন অর্থাৎ টার্মিনালের ভেতরের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভালো করছে। সেখানকার নিরাপত্তা কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেবে। পুরো পরিবর্তন আনতে কিছুটা সময় লাগবে। বিমানবন্দরের বাইরের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে অপর এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, অন্য দেশের বিমানবন্দরে কাউকে রিসিভ বা বিদায় জানাতে একজনের বেশি কেউ আসে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অচেনা না হলে কেউ বিমানবন্দরেও যায় না। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখানে একজন বিদেশ গেলে বা বিদেশ থেকে আসলে তার সঙ্গে অন্তত ৫-৬ জন সঙ্গী থাকে। এজন্য ভিড় সামলাতেও বেগ পেতে হয়। যেখানে সেখানে পার্কিং করা হয়। ওই কর্মকর্তা বলেন, বিমানবন্দর ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের ক্ষেত্রে আসলে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় মেশিনপত্র ও দক্ষ জনবল নেই।
এদিকে রেডলাইন এয়ারপোর্টের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই দোতলার ক্যানপিতে বিশাল জটলা দেখা যায়। ব্যাগেজের নিরাপত্তা তল্লাশি করতে বিমানযাত্রীদের কারও কারও ঘণ্টা খানেক লেগে যায়। ফলে যারা কম সময় নিয়ে এয়ারপোর্টে আসেন তাদের অনেককেই ঝামেলায় পড়তে হয়।
বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, গত ২১ মার্চ শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে ব্রিটিশ কোম্পানি রেডলাইন এভিয়েশন সিকিউরিটি লিমিটেড। তাদের ২৯ জন কর্মী এরই মধ্যে নিরাপত্তা দেখভালের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্ট- এর স্বল্প মেয়াদি পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, দায়িত্ব নেয়ার প্রথম দিন থেকেই ঠিকাদারদের তত্ত্বাবধান ও তল্লাশি-কর্মীদের প্রশিক্ষণ শুরু করেছে। যাতে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রশিক্ষিত কর্মীরা প্রয়োজনীয় মাত্রায় সক্ষমতা অর্জন করে। এতে করে ঢাকা থেকে ভ্রমণকারী সব যাত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই রেডলাইন শাহজালাল বিমানবন্দরের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ৩১ মার্চ পর্যন্ত প্রায় ৩০ জন কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। নিরাপত্তার দুর্বল দিকগুলো মূল্যায়নে চিহ্নিত দুর্বল জায়গাগুলোতে বিশেষ নজর দেয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ যাত্রীদের ব্যাগ তল্লাশির মান বজায় রাখা। বিমান যাত্রী প্রবেশের পথে ও মূল তল্লাশি পয়েন্টে ইটিডি’র কার্যকরী ব্যবহার করার কথা বলা হযেছে। এ জন্য তল্লাশি পয়েন্টে সঠিক কর্মী সরবরাহ এবং হোল্ড ব্যাগেজ তল্লাশি ও পাহারার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বিমানবন্দরের র‌্যাম্প এরিয়াসহ সব বিমানের কার্যকর পাহারা ও নিয়ন্ত্রিত প্রবেশাধিকারের দিকে খেয়াল রাখতে প্রয়োজনে কর্মীদের তল্লাশি, কার্গো তল্লাশি ও পাহারা দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কার্গো রাখার স্থানে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ ও কার্গো কর্মীদের তত্ত্বাবধান এবং ফ্লাইটে সরবরাহ করা জিনিসপত্র ঠিকভাবে তল্লাশি ও সুরক্ষার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ২১ মার্চ থেকে ব্রিটিশ কোম্পানি রেডলাইন এভিয়েশন দায়িত্ব নিলেও এখনও নিরাপত্তা ঘাটতি রয়ে গেছে। এয়ারপোর্টে সরজমিনে গিয়ে নিরাপত্তা ঘাটতি চোখে পড়েছে। এয়ারপোর্টের ভেতরে মাইকিং ছাড়া অন্য কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি চোখে পড়েনি। এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বলছে, সিভিল এভিয়েশনের টেকনিক্যাল জনবলকে এখন ট্রেনিং দিচ্ছে রেডলাইন।
গাজীপুরের বাসিন্দা দুবাই ফেরত মামুনের ভাই রাজনের সাথে বিমানবন্দরের বাইরে গতকাল কথা হয় বিমানবন্দরে। আলাপকালে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, শুধু ইমিগ্রেশন নয়, লাগেজ পেতেও যাত্রীদের বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে। কারপার্কিংয়ের অবস্থা আরো জটিল। বিমানবন্দরের সামনে ও কার পার্কিংয়ের স্থানে সারাদিন ট্যাক্সি ক্যাব ও দালালদের যানবাহনে ভর্তি থাকে। ফলে যাত্রীদের যানবাহন নিয়েও নানা সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। এটাই বিমানবন্দরের প্রতিদিনের চিত্র। এ নিয়ে যাত্রীদের অন্তহীন অভিযোগের পরেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। যাত্রীরা বলছেন, দীর্ঘ বিমান ভ্রমণের পর শাহজালার বিমানবন্দরে অবতরণের পর ইমিগ্রেশন আর লাগেজ পেতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
সরেজমিন গত দু’দিন দেখা গেছে, শাহজালাল বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে শত শত যাত্রী দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রায় এক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে বের হন মুন্সীগঞ্জের মামুন মিয়া এবং কেরানীগঞ্জের আবু তাহের। তারা জানান, এমিরেটস এয়ারে দুবাই থেকে শাহজালাল বিমানবন্দরে আসেন সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে। ইমিগ্রেশন শেষ করতে প্রায় ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট এবং লাগেজ পেতে আরো দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। তারা জানান, কয়েকটি কাউন্টার ফাঁকা। কোন ইমিগ্রেশন অফিসার নেই। যে কয়টিতে কর্মকর্তারা আছেন, তারাও ততটা দক্ষ নন। আবার কেউ কেউ কাউন্টার ছেড়ে অন্য কাজে বের হয়ে যান। ইমিগ্রেশনে বিনা কারণে অবান্তর প্রশ্ন করে সময় ব্যয় করেন। এমনিতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত। তারপর আবার নানা প্রশ্ন। সব কিছু পাসপোর্টেই আছে। আবু তাহের জানান, লাগেজের জন্য প্রায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। লাগেজ কত নম্বর বেল্টে দেয়া হবে এ ব্যাপারে কোন নির্দেশনা দেয়া হয়নি প্রথমে। পরে লোকজনের কাছে জিজ্ঞাসা করে বেল্টের কাছে গিয়ে অপেক্ষা করতে করতে আরো ক্লান্ত হয়ে পড়ি। এ অভিযোগ শুধু মামুন আর আবু তাহেরের নয়। এধরনের শত শত অভিযোগ পাওয়া গেছে। কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা নুরুল আমিন জানান, গতকাল বিকাল ৫টা ৩০ মিনিটে এমিরেটস এয়ারের একটি ফ্লাইটে তিনি দুবাই থেকে ঢাকায় এসে অবতরণ করেন। পরে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে প্রায় ৪৫ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন। তিনি আরো জানান, লাগেজ পেতে ১ ঘণ্টা ২৩ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়েছে।
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইমিগ্রেশনের একজন কর্মকর্তা জানান, আন্তর্জাতিক যাত্রীদের জন্য ২৫টি আগমনী এবং ৩৬টি বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টার রয়েছে। পিকওয়ারে যে পরিমাণ যাত্রী থাকেন তাদের সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়। ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, স্থানের অভাব তাই বারবার বলার পরেও কর্তৃপক্ষ ইমিগ্রেশনের জন্য কাউন্টার বাড়াতে পারছে না। যদি তৃতীয় টার্মিনাল ভবন দ্রুত করা হয় তা হলে এ সমস্য কমে আসবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শাহজালালে নিরাপত্তা বাড়লেও থেমে নেই যাত্রী হয়রানি
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ