পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার : ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর/ রাস্তায় এলো বান/ সবাই এখন বাসায় গিয়ে/ ইলিশ খিচুড়ি খান।’ ছড়াকারের এই ছড়ার বাস্তবতা একসময় দেশে থাকলেও ‘ইলিশ খিচুড়ি’ এখন সীমিত আয়ের মানুষের জন্য স্বপ্ন। পহেলা বৈশাখে পান্তার সঙ্গে ইলিশ যোগ হওয়ার পর থেকে ইলিশ হয়ে গেছে ‘সোনার হরিণ’।
গত এক মাস থেকে রাজধানী ঢাকায় ইলিশের বাজারে আগুন লেগেছে। ৮ হাজার টাকা মাইনের চাকুরে এক জোড়া ইলিশ ১০ হাজার টাকা দিয়ে কেমন করে কিনবে সে বিতর্ক অবান্তর। পত্রিকায় খবর বের হয়েছে বরগুনার পাথরঘাটায় এক কেজি ৩শ গ্রাম ওজনের একটি ইলিশ বিক্রি হয়েছে এক লাখ ১৬ হাজার টাকায়। অতএব মাছ হিসেবে ইলিশের অহংকার থাকতেই পারে। আসুন না বৈশাখ উপলক্ষে ইলিশের আত্মজীবনী পড়ি!
আমার নাম ইলিশ। না আমি গুলিস্তান টু মাওয়া ঘাট রুটের যানবাহন নই। আমি লোনা পানির মাছ। এদেশে জাতীয় মাছের মর্যাদা পেয়েছি। লোনা পানিতে বসবাস হলেও বংশ বিস্তারের জন্য প্রতিবছর নির্ধারিত সময়ে পদ্মা-মেঘনায় আসি। ডিম পাড়ার জন্য মিঠে পানিতে এলেও ফেরার পথে জেলেদের জালে আটকে পড়ি। কেউ কেউ আমাকে আদর করে ‘রুপালি ইলিশ’, কেউ ‘মাছের রাজা’ নামে ডাকে।
আমার মর্যাদা এমন উচ্চতায় উঠেছে যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পর্যন্ত আমার উচ্চতায় উঠতে ‘মাছের রাজা ইলিশ, দেশের রাজা পুলিশ’ উক্তি করেন। তা নিয়ে যে কত হৈচৈ হলো! রসনাবিলাসীদের জিহ্বায় তৃপ্তি দিলেও ২০ বছর আগেও আমার এত কদর ছিল না। ঢাকার কিছু বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিসেবী ও সম্পদশালী প্রগতিশীল মানুষ কয়েক বছর থেকে পহেলা বৈশাখে গরিবের পান্তার সঙ্গে আমার নাম জুড়িয়ে দেয়ায় আমি এখন মহা সম্মানিত রাজা। আমাকে ছোঁবে এমন সাধ্য গরিবের নেই।
পহেলা বৈশাখের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। অথচ এখন রাজধানী ঢাকার মানুষের আমাকে ছাড়া পহেলা বৈশাখ উৎযাপন হয় না। সেজন্য আমাকে নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের মধ্যে লুকোচুরির অন্ত নেই। এতে আমি আহতবোধ করি। কিন্তু আমার করার কী আছে? আমি জানি আমাকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের দাদা-দিদিদের আগ্রহের শেষ নেই। যে নদীতে আমি বংশ বিস্তার করি, ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে সেই পদ্মার পানি আটকে দিয়েছে ১৯৭২ সালে ভারত। সেই ভারত নাকি এদেশের রাজনীতিকদের বন্ধু। বলুন পানি না থাকলে আমি কীভাবে বেঁচে থাকি আর কীভাবে বংশ বিস্তার করি? অথচ দাদা-দিদিরা আমার জন্য অস্থির!
প্রথমে আমার সম্পর্কে কিছু ধারণা দেই। আমার বৈজ্ঞানিক নাম (ঞবহঁধষড়ংধ রষরংযধ)। খাদ্য হিসেবে আমি শুধু বাংলাদেশ নই সারাবিশ্বে সমাদৃত। বাংলাদেশ আমাকে জাতীয় মাছের মর্যাদা দিলেও ভারতের বিভিন্ন এলাকা, যেমনÑপশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা, আসামেও মানুষের খাবারের মেন্যুতে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এদেশে কেউ ইলিশ, গ্রামগঞ্জের মানুষ ইল্শা বলে ডাকলেও ভারতের আসামে ইলেশ, তেলেগু ভাষায় পোলাসা (চঁষধংধ ড়ৎ চড়ষধংধ), পাকিস্তানের সিন্ধি ভাষায় চধষষঁ গধপযযর, ওড়িষ্যা ভাষায় ওষরংযরর, গুজরাটে মোদেন (স্ত্রী)/পালভা (পুরুষ) নামে ডাকে।
গ্রীষ্মম-লীয় মাছ হিসেবে শুধু সুস্বাদু নই, অর্থনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লোনা পানি তথা বঙ্গোপসাগরের ব-দ্বীপাঞ্চল, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদীর মোহনার হাওর থেকে প্রতি বছর আমার স্বজাতিরা ডিম পড়তে এলে জালে ধরা পড়ে। দুঃখের কথা হলো আমরা নদীতে ডিম দেই, ডিম ফুটে গেলে এবং বাচ্চা বড় হলে (জাটকা) সাগরে ফিরে যাই। সাগরে ফিরে যাওয়ার পথে জেলেরা আমাদের ধরে। এতে আমাদের দুঃখ নেই। সৃষ্টিকর্তা হয়তো আমাদের জন্মের বিধিলিপিতে এটাই লিখেছেন। কিন্তু আমাদের বাচ্চাদের (জাটকা) ধরে মণকে মণ, টনকে টন বিক্রি করা হয় চোরাই পথে। বাচ্চাদের এভাবে মারলে কার না খারাপ লাগে? ওদের কি বড় হওয়ার অধিকার নেই? জাটকা বড় হলে তোমাদের লাভ নয় কি? এদেশের মানুষ এটুকু বোঝেন না? আমরা লবণাক্ত পানি বা সামুদ্রিক মাছ। বংশবিস্তারের জন্য বছরে প্রায় ১২০০ কিমি দূরত্ব অতিক্রম করে এই অঞ্চলের নদীতে পাড়ি দেই। বাংলাদেশের পদ্মা (গঙ্গার কিছু অংশ), মেঘনা (ব্রহ্মপুত্রের কিছু অংশ) এবং ভারতের রূপনারায়ণ, গঙ্গা, গোদাবরী নদীতেও যাই। পাকিস্তানের সিন্ধু নদীর পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সেদিকে এখন যাওয়া হয় না। আমাদের যখন তেমন গুরুত্ব ছিল না, তখন সাধারণ মানুষ নানা পদে আমাদের রান্না করে খেত। এখন পহেলা বৈশাখে ঢাকার রমনার বটমূল ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পান্তার সঙ্গে আমাদের খেলেও উঁচুতলায় আমাদের নানা পদ্ধতিতে রেঁধে খাবার টেবিলে পরিবেশন করা হয়। যেমনÑইলিশ পোলাও, অরেঞ্জ ইলিশ, সরষে ইলিশ, মায়ানে ভাজা ইলিশ, কোপ্তা কারি, ভাতে ভাপা, লেবু ইলিশ, আস্ত বেকড, ইলিশ কাসুন্দি, পাতুরি, কাটা গলানো ইলিশ, টকমিষ্টি, স্মোকড ইলিশ, ইলিশ কোরমা, ইলশে কাবাব, দই ইলশে, নোনা ইলশে ভুনা, মালাইকারী, ইলশে আনারস, আস্ত ইলশে রোস্ট, ইলশে ভিন্দালু, লবণে বেকড ইলশে ইত্যাদি ইত্যাদি। ইলিশের ডিম যে কত মজাদার খাবার তা বাংলাদেশের মানুষমাত্রই জানেন।
শিল্পী গেয়েছেন, ‘মানুষ মানুষের জন্য/ জীবন জীবনের জন্য...।’ আমরা তো বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়া নিয়ে শুধু হানাহানি দেখছি। রাজনৈতিক হানাহানি; ইউনিয়ন পরিষদ ভোটেও রক্তারক্তি। মানুষকে ‘মানুষের জন্য দেখছি না’, বরং আমাদের জন্মই মানুষের জন্য। আমরা ভাগ্যবান এটা ঠিক। কিন্তু ধনী-গরিব সবার জন্যই আমাদের জন্ম। দুঃখজনক হলো পহেলা বৈশাখে আমাদের ব্যবহার অধিক এবং টাকাওয়ালারা চাহিদা বাড়ানোয় গরিবরা আমাদের দিকে হাত বাড়াতেই পারছে না। শুনেছি আমাদের আঁশ ও নাড়িভুঁড়িও বিক্রি হয়। ঢাকার ধনীরা আগে পহেলা বৈশাখে আমাদের তেমন গুরুত্ব দিতেন না। সারা বছর আমরা সাধারণ মানুষের ঘরে রসনায় তৃপ্তি মেটাতাম। বাজারে আমাদের প্রচুর ছড়াছড়ি ছিল; দামও ছিল সাধারণ মানুষের নাগালে। নব্বই দশকেও চাহিদা না থাকায় আমাদের পচে-গলে বিক্রেতাদের ঘরে বরফে মাথা গুঁজে থাকতে হতো। তখন আমাদের রুপালি ইলিশ নামে ডাকলেও চিংড়িকে ডাকা হতো সাদা সোনা নামে। অথচ অনেকেই বলেন, চিংড়ি নাকি মাছের প্রজাতি নয়। ওই চিংড়ি আর রূপচান্দা মাছের দাম ছিল সবচেয়ে বেশি। ওরা ধনীদের ঘরে যাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করুক; আমাদের তাতে কিছু আসে-যায় না। আমরা কম দামের গরিবের ঘরে যেতে পারি, সেটাই জন্মের সার্থকতা। কিন্তু কয়েক বছর ধরে পহেলা বৈশাখে আমার গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় অসাধু ব্যবসায়ী ও কালোব্যবসায়ীরা গোপনে সারা বছর আমাদের বরফের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। ফলে সাধারণ মানুষ আমাদের নাগাল পায় না। অতঃপর পহেলা বৈশাখের কয়েকদিন আগে ধীরে ধীরে আমাদের বাজারে হাজির করা হয়; আর আকাশছোঁয়া দামে বিক্রি করে। যাদের হাতে অর্থ থাকে তারা আমাদের কিনে ঘরে নিয়ে যায়। রাষ্ট্রের সম্পদ লুণ্ঠনকারী, দুর্নীতিবাজ, সাধারণ অর্থশালীরা ছাড়াও নেতানেত্রীরা ডজন ডজন কিনে নিজেরা খান, নেতাকর্মীদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। আত্মীয়-স্বজনের বাসায় পাঠিয়ে দেন ঝুড়িভরে। যারা সীমিত ও অল্প আয়ের মানুষ তারা আমাদের দিকে তাকাতে সাহস পায় না। সাধারণ বাজারে আমাদের মূল্য ৫শ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হলেও বৈশাখে এমনো ইলিশ রয়েছে তারা ৪০ হাজার ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি হন।
পত্রিকায় খবর বের হয়েছে, বরগুনায় পাথরঘাটায় প্রকাশ্যে এক কেজি ৩শ গ্রাম ওজনের একটি ইলিশ এক লাখ ১৬ হাজার টাকা বিক্রি হয়েছে। তাহলে একশ গ্রাম ইলিশের দাম পড়ে ৯ হাজার একশ টাকা। একশ গ্রাম ইলিশের দামের চেয়ে এদেশে অনেকেই কম মাসিক বেতনে চাকরি করেন। যিনি ওই ইলিশ কিনেছেন তিনি হয়তো মানবজাতির সবচেয়ে সৌভাগ্যবান। থাকো বাবা বেঁচে থাকো! পহেলা বৈশাখে আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পাওয়ায় আমার স্বজাতিদের অবস্থা হয়েছে যেন ঢাকার পাঁচতারা হোটেলের মতো, যেখানে সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতে পারেন না। সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্টের মতো, সেখানে অর্থের অভাবে গরিব মানুষ ন্যায়বিচার চাইতে যেতে পারেন না। ঢাকা ক্লাবের মতো, যেখানে সাধারণ গরিব লুঙ্গিপরা মানুষ প্রবেশ করতে পারেন না। আমরা তো দেখেছি ফরহাদ মজহারের মতো বিখ্যাত তাত্ত্বিক গবেষককে লুঙ্গি পরার কারণে ঢাকা ক্লাবের গেটে অপদস্ত করে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কয়েক বছর আগেও ছোট আকারের ইলিশ এক কেজি ৭শ’ টাকা, মাঝারি ইলিশ ৯শ’ থেকে এক হাজার টাকা, আর এক কেজির বেশি ইলিশ দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকায় বিক্রি হতো। এখন সেই আমরা এত উচ্চতায় উঠেছি যে গরিবরা ইচ্ছা করলেও আমাদের গায়ে হাত দিতে পারবে না। শহুরে কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘তোমাকে আসতেই হবে হে স্বাধীনতা।’ এখন আমাদের উল্টো করে বলতে হচ্ছে, ‘তোমার না এলেই নয় কি হে বৈশাখ?/ তুমি এলে ধনীরা আমাদের নিয়ে টানাটানি করে,/ গরিবরা আমাকে খেতে পায় না,/ অতএব তুমি কি না এলেই নয়?’
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।