Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দক্ষিণাঞ্চলের টেলিযোগাযোগ ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন-বিতরণ বিপর্যয়ের কবলে

প্রকাশের সময় : ৪ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নাছিম উল আলম : সরকারী তিনটি নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলদের উদাসীনতা ও অবহেলায় দক্ষিণাঞ্চলের টেলিযোগাযোগ এবং বিদ্যুৎ সরবারহ, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা চরম বিপর্যয়ের কবলে। ক্রমাগত গ্রাহক হারিয়ে রাষ্ট্রীয় টেলিযোগাযোগ কোম্পানী-বিটিসিএল’এর জবনিকাপাত ঘটতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। সরকারী একমাত্র সেলফোন কোম্পানী টেলিটক-এর প্রতিও সাধারণ মানুষের আস্থা তলানীতে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা নিয়ে গঠিত ‘ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী-ওজোপাডিকো’র সেবার ধাক্কায় অতিষ্ঠ দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় দেড় লাক্ষাধিক বিদ্যুৎ গ্রাহক। এসব গ্রাহকের বিকল্প ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ সংগ্রহের কোন পথ না থাকায় তারা অনেকটাই জিম্মি ওজোপাডিকো’র কথিত সেবার কাছে।
এক সময়ে অধুনালুপ্ত টিএন্ডটি বোর্ডের একটি ল্যান্ড ফোনের জন্য সাধারণ মানুষ আমলা, জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যন্ত ছুটলেও এখন বরিশাল টেলিযোগাযোগ অঞ্চলের ৬টি জেলার ৪২টি উপজেলার প্রায় ৪৩ হাজার ধারণ ক্ষমতার ৪৫টি টেলিফোন এক্সচেঞ্জ গ্রাহক রয়েছে ১৪ হাজারেরও কম। বিদ্যমান এসব গ্রাহকেরও অনেকেই তাদের ল্যন্ডফোন থেকে কোন কল করেন না। সাম্প্রতিককালে এসব টেলিফোন এক্সেঞ্জে ঘন ঘন কারিগরি ত্রুটির কারনে আউট গোয়িং ও ইনকামিং কল করা নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ছেন গ্রাহকগণ। এমনকি দেশব্যপী ভূগর্ভস্থ অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্কের আওতায় আনার পরে ঐসব ক্যাবল ঘন ঘন কাটা পড়ায় বিড়ম্বনা বহু গুণে বেড়েছে। বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী ও রংপুরসহ ফরিদপুর অঞ্চলের ৩৭টি জেলার যেকোন স্থানে ক্যাবল কাটা পড়লেই সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের সাথে সারা দেশের টেলিযোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর এ বিড়ম্বনা এখন মাসে ৮ থেকে ১০বার পর্যন্ত ঘটলেও তা থেকে উত্তরণের কোন পদক্ষেপ নেই। অতি সম্প্রতি বরিশালের ৩টি ডিজিটাল এক্সঞ্জেই নানা কারিগরি ত্রুটির কারণে সেল ফোনসহ এনডব্লিউডি কল করা নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ছেন গ্রাহকগণ। বরিশাল মহানগরীর ৩টি টেলিফোন এক্সচেঞ্জে ধারণ ক্ষমতা প্রায় ১২ হাজার হলেও এখন কাগজপত্রে গ্রাহক সংখ্যা ৬হাজারেরও কম। বিদ্যমান এসব গ্রাহকের অনেকেই আবার তাদের ল্যান্ডফোন থেকে কোন আউট গোয়িং কল করেন না। বরিশাল মহানগরীর এ ৩টি এক্সচেঞ্জ-এর সাথে সংযুক্ত ভূগর্ভস্থ ক্যাবলের বেশীরভাগই অকার্যকর হয়ে গেছে অনেক আগে। এমনকি সিটি করপোরেশনের রাস্তা সম্প্রসারণের কারণেও বেশীরভাগ ক্যাবলের অবস্থান খুঁজে পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়েছে। ফলে কোন কারণে এসব ক্যাবলে ত্রুটি দেখা দিলে তা আর মেরামতেরও কোন সুযোগ নেই। ফলে গোটা নগরীতে সমায়িক ব্যবস্থায় ঝুলন্ত ক্যাবল টেনে অনেকটা ‘কোরামিন ব্যবস্থাপনা’য় টেলিফোন ব্যবস্থা সচল রাখা হয়েছে। এসব ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিটিসিএল-এর দায়িত্বশীল মহল পরিস্থিতি উত্তরণের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন।
এদিকে দক্ষিণাঞ্চলে একই পরিস্থতি রাষ্ট্রীয় সেল ফোন কোম্পানী টেলিটক-এরও। লাগাতর বিড়ম্বনার কারণে ফরিদপুর ও বরিশাল অঞ্চলের ১১টি জেলার দেড় লাখ টেলিটক গ্রাহকের অনেকেই এখন আর এ সেল ফোন ব্যবহার করেন না। দুর্বল নেটওয়ার্কসহ আয়ুষ্কাল হারানো রক্ষণাবেক্ষণহীন বিটিএসগুলো থেকে গ্রাহকগণ এখন আর কোন ভাল সার্ভিস পাচ্ছেন না। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আয়ুষ্কাল হারানো বিটিএসগুলো দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় স্থাপনের ফলে গ্রাহকদের দুর্ভোগ বেড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি খোদ বরিশাল মহানগরীতে পর্যন্ত টেলিটক-এর টুÑজি সার্ভিস এখন দিন-রাতের বেশীরভাগ সময়ই বন্ধ থাকছে। বিটিএসএর আশে পাশের গ্রাহকগণ পর্যন্ত নেটওয়ার্কের অভাবে কথা বলতে ও শুনতে বিড়ম্বনায় পড়েন। সরকারী এ সেলফোন কোম্পানীর থ্রি-জি সেবার মান তুলনামূলকভাবে ভাল হলেও তা এখনো শুধুমাত্র জেলা সদরগুলোতে বিদ্যমান।
টেলিটক-এর সীমাহীন সীমাবদ্ধতার কারণে সরকারী এ সেলফোন কোম্পানীর গ্রাহক বাড়ছে না বলেও অভিযোগ সাধারণ মানুষের। এসব ব্যাপারে বরিশালে টেলিটক-এর দায়িত্বশীল মহলে আলাপ করা হলেও সেখান থেকেও ‘সব কিছু ভালভাবে চলছে এবং পরিস্থিতি উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ’এর কথা বলা হয়। তবে গত এক বছরে দক্ষিণাঞ্চলে টেলিটক-এর সেবার মান ক্রম হ্রাসমান বলে অভিযোগ সাধারণ গ্রাহকদের।
ভাল সেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পিডিবি’র আওতায় ওজোপাডিকো গঠন করা হলেও দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের উদাসীনতা, অবহেলা সাথে সরকারী দলের শ্রমিক সংগঠনের আওতাভুক্ত দুটি ইউনিয়নের কারণে সে লক্ষ্যে পৌঁছান যায়নি। বরং গ্রাহকদের বিড়ম্বনা ক্রমশ বাড়ছে। সময়মত ১১ কেভি লাইনসহ .০৪ বিতরণ লাইন এবং ১১/.০৪ ট্রান্সফর্মারসমূহের রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে খোদ বরিশাল মহানগরীতে পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিভ্রাট এখন চরমে। আকাশে মেঘ জমলেই এ নগরীতে বিদ্যুৎ সরবারহ ও বিতরণ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত সত্য। ২৫ কিলোমিটার বেগে বাতাস শুরু হলে বরিশাল মহানগরী অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। এসব সমস্যার পেছনে কর্তৃপক্ষ নগরীতে অত্যধিক গাছপালার অবস্থানকে দায়ী করলেও তা সঠিক নয়। মূলত সঞ্চালন, সরবরাহ ও বিতরণ লাইনসমূহসহ ট্রান্সফমারগুলো সময়মত রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। সামান্য বজ্রপাতেই ৩৩ কেভি ও ১১ কেভি লাইনসমূহের ইনসুলেটর বিনষ্ট যাচ্ছে। একটি ১১/.০৪ ট্রান্সফমারের ফিউজ পুড়ে গেলে তা পরিবর্তন করতে পুরো ফিডার বন্ধ করতে হয়। একেকেটি ফিডারে ২০-২৫টি ট্রান্সফরমার রয়েছে। যার বেশীরভাগই ওভারলোড হয়ে আছে। ফলে দৈনিক গড়ে ৫টি ট্রান্সফরমারের ফিউজ পুড়ে গেলে লোডশেডিং ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের বাইরেও অতিরিক্ত ৫ বার ঐসব ফিডার বন্ধ করতে হয়। এর সাথে রয়েছে পিজিসিবি’র কেন্দ্রীয় লোড ডেসপাস সেন্টার থেকে দূর নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় বিভিন্ন ৩৩ কেভি ফিডার বন্ধ করে দেয়ার বিষয়টিও।
বরিশাল মহানগরীর হাতেম আলী কলেজ ফিডারটি গত মাস খানেক যাবতই প্রতিদিন সকাল ১০টার পরে বন্ধ করে নানা কাজ করা হচ্ছে। কিন্তু আকাশে মেঘ জমলে সবার আগে এ ফিডারেই ত্রুটি দেখা দেয়। এছাড়াও মহানগরীর রূপাতলী ৩৩/১১কেভী মূল সাব-স্টেশন থেকে কাশিপুর ও পলাশপুর ৩৩/১১ কেভী সাব-স্টেশনমুখী সঞ্চালন লাইন দুটিতেও গোলযোগসহ নানা ত্রুটি এখন নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বছর তিনেক আগে দপদপিয়া ৩৩কেভী সাব-স্টেশন থেকে পলাশপুরমুখী একটি বিকল্প ৩৩কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ কাজ শুরু হলেও মাঝ পথে ঝড়ের কারণে তার ছিঁড়ে যাবার পরে সে কাজ অদ্যাবধি শেষ হয়নি। ফলে দীর্ঘদিনের পুরোনো ৩৩ কেভি লাইনটি সামান্য ঝড়ে বিপর্যস্ত হলে এনগরীর বিশাল এলাকায় বিদ্যুৎ সরবারহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একই পারিস্থিতি রূপাতলীÑকাশীপুর সঞ্চালন লাইনটিসহ পুরো সাব-স্টেশনটিরও। ওজোপাডিকে দক্ষিণাঞ্চলের বিদ্যুৎ বিতরণ ও সরবরাহের দায়িত্ব গ্রহণের পরে এ অঞ্চলের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা পুনর্বাসন ও আধুনিকায়নে যে সব প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে তা নিয়েও রয়েছে অনেক অভিযোগ। নিম্নমানের বিদ্যুৎ সরঞ্জাম সংগ্রহসহ ঠিকাদার ও কতিপয় প্রকৌশলীর যোগসাজশে এসব প্রকল্পে অর্থ ব্যয় হলেও তার সুফল গ্রাহকদের কাছে পৌঁছেনি। বরং গোটা দক্ষিণাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণ ও সরবরাহ ব্যবস্থা ক্রমশ নাজুক আকার ধারণ করছে। ফলে দেশে বিদ্যুৎ-এর উৎপাদন বাড়লেও তার সুফল দক্ষিণাঞ্চলের আমজনতার ঘরে পৌঁছেনি এখনো। এসব বিষয়ে ওজোপাডিকো’র দায়িত্বশীল মহল থেকেও নানা সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে তা থেকে উত্তরণে নানা কর্মসূচীর কথা বলা হয়েছে। তবে ঠিক কত দিন বা বছরে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিদ্যুৎ বিতরণ ও সরবরাহ ব্যবস্থা নির্বিঘœ হবে তা বলতে পারেন নি কেউ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দক্ষিণাঞ্চলের টেলিযোগাযোগ ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন-বিতরণ বিপর্যয়ের কবলে
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ