পোশাক রপ্তানিতে উৎসে কর ০.৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব
আগামী পাঁচ বছরের জন্য তৈরি পোশাক রপ্তানির বিপরীতে প্রযোজ্য উৎসে করহার ১ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ০.৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে পোশাক খাতের দুই সংগঠন
অর্থনৈতিক রিপোর্টার ঃ বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে কর্পোরেট ট্যাক্স ফাঁকি ঠেকানো জরুরি। জটিল বিধি ও আইনের ফাঁক-ফোকরের সুযোগ নিয়ে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বড় অংকের কর দেয়ার দায়ভার সুকৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে জিডিপির তুলনায় প্রয়োজনীয় কর আদায়ে পিছিয়ে পড়ছে দেশ। জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় বাড়াতে পারছে না সরকার। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অ্যাকশন এইডের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। গতকাল রাজধানীর গুলশানে একটি হোটেলে ‘সমৃদ্ধির পথে অগ্রযাত্রা: দায়িত্বপূর্ণ কর্পোরেট কর ব্যবস্থা’ নিয়ে বাংলাদেশে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত কর বিষয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা বলেন, পুরোনো আইন-নীতি, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তি এবং স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার অভাবে বাংলাদেশে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কর দেয়ার ভাল প্রবণতা তৈরি হয়নি। যে কারণে বাংলাদেশ এখনো মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১১ ভাগের বেশি কর আদায় করতে পারছে না। যেটা হওয়া উচিৎ জিডিপির ১৬ ভাগ। একশন এইড ইন্টারন্যাশনাল, ক্রিশ্চিয়ান এইড এবং অক্সফাম-এর করা প্রতিবেদনটি মূলত: দায়িত্বপূর্ণ কর ব্যবস্থাপনা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অর্থায়ন এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কর দেয়ার মানসিকতা ও করণীয় নিয়ে করা হয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বাংলাদেশে এখনো শিশু মৃত্যুর হার ৩৩ শতাংশ। এখনো বাংলাদেশে একজন শিশু গড়ে মাত্র ৫ দশমিক ১ বছর স্কুলে যায়। মাধ্যমিক শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে মাত্র ৩৭ দশকি ৮ ভাগ মানুষ। বাংলাদেশে এখনো লিঙ্গভিত্তিক সমতা অর্জিত হয়নি। পুরুষদের তুলনায় নারীরা অনেকাংশেই কম স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়। নারীর মাথাপিছু জাতীয় প্রকৃত আয় পুররুষদের অর্ধেকের কিছুটা বেশি এবং শ্রমক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ৫৭ শতাংশ যেখানে পুরুষের ৮৪ শতাংশ। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় এসব বিষয় সমাধান করতে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে। আর এজন্য অর্থায়ন সবচাইতে প্রয়োজনীয় বিষয়।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর করের আওতা বাড়ানো গেলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যর মত মৌলিক বিষয়ে সামাজিক বিনিয়োগ বাড়ানো যাবে।একই সঙ্গে আয়ের সুযোগের অভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকার তুলনামূলকভাবে কর্পোরেট আয়করের উপর বেশি নির্ভর করে। আইএমএফ-এর ভাষ্যমতে, এটা রাজস্বের প্রায় ১৬ শতাংশ। যদিও উন্নত দেশগুলোতে কর্পোরেট আয়কর ৮ শতাংশের কিছু বেশি।
অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রতিবেদনের একাংশ তুলে ধরে অ্যাকশন এইড ইন্টারন্যাশনালের এডভোকেসি এডভাইজার ইয়ান লিভিংস্টন বলেন, নাগরিক সুবিধা বাড়াতে করের আওতা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে নতুন নিয়মনীতি প্রয়োজন। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর প্রদানে আরো দায়বদ্ধ হতে হবে।
অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল ব্যবসা এক দেশে। তারা বাংলাদেশে এসে ব্যবসা করে। তার আয় নিয়ে যায় তার মূল প্রতিষ্ঠানের দেশে- এই কথা বলে যে, তারা আয়ের কর অন্য দেশে দিচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলো।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য কর্পোরেট ট্যাক্স ফাঁকি ঠেকানো দরকার। আর এই কারণেই প্রতিবেদনটি সরকার পরিচালিত একটি আন্তর্জাতিক কর ব্যবস্থার সংস্কারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। জটিল বিধি ও আইনের ফাঁক-ফোকরের সুযোগ নিয়ে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো কর ফাকি দিচ্ছে। ত্রæটিপূর্ণ এই ব্যবস্থার আমূল সংশোধন করা জরুরি। বিষয়টি অভ্যন্তরীণভাবে একটি দেশের সরকারকে যেমন করতে হবে, তেমনিভাবে আন্তর্জাতিকভাবেও এটির পুনর্বিন্যাস দরকার।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে অবস্থিত ডেনমার্ক দূতাবাসের কাউন্সিলর পিটার বগ জেনসেন বলেন, বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচাইতে কম কর প্রদানকারী দেশ। বাংলাদেশের কাতারে থাকা কেনিয়া, সিয়েরা লিয়নেও বাংলাদেশের তুলনায় বেশি কর আদায় হয়। কারণ, এখানে মানুষ বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। এখানে আইন, নীতি দুর্বল। আর এই সুযোগ নেয় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। কম কর আদায় হয় বিধায় শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মত বিষয়ে কম খেয়াল দিতে পারে সরকার।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন, আমাদের ট্যাক্স জিডিপি অনুপাত ১১ ভাগ। কিন্তু হওয়া উচিত ১৬ ভাগ। আমাদের দেশে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান যে কর দেয়া উচিৎ তা দেয় না। ফলে এ দেশের আয় চলে যায় অন্য দেশে। এ জন্য আমাদের ট্যাক্স ন্যায্যতা তৈরি করতে হবে। যুগোপযোগী করতে হবে কর আইন। আমরা এখনো ১৯২৪ সালের আয়কর আইন দিয়ে চলছি। অধিকাংশ আইনই পুরোনো। যার ফাঁক-ফোকর দিয়ে সবাই বেড়িয়ে যায়। দেশের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বলি আর এসডিজি বলি, দেশীয় আর্থায়ন লাগবেই। যে জন্য অর্থায়ন বাড়াতে হবে।
অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান বলেন, আমরা গরীব দেশ ছিলাম বিধায় বিদেশি বড় প্রতিষ্ঠান, কোম্পানিগুলোকে এদেশে বিনিয়োগ করার জন্য ডেকে নিয়ে আসতে হয়েছে। তাদেরকে তাই সুযোগ সুবিধা দিতে হয়েছে। একই সঙ্গে ওই প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক চতুর ছিল। তাই তারা কর সুবিধা নিচ্ছে। এটা বাস্তবতা, মেনে নিতে হবে। কারণ, প্রতিষ্ঠানগুলোক সুবিধা দিতে অনেক দেশ বসে আছে। তবে ফাঁক ফোকর খুঁজে বের করতে আমরা কাজ করছি। আমরা চাই সবাইকে নিয়ে উন্নয়ন করতে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘সমৃদ্ধির পথে অগ্রযাত্রা: দায়িত্বপূর্ণ কর্পোরেট কর ব্যবস্থা’ নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন একশন এইড বাংলাদেশের পরিচালক আসগর আলী সাবরি। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর ফাঁকি ঠেকতে ৮টি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। যার মধ্যে রয়েছে সুষ্ঠু কর পরিকল্পনার চর্চা, জনগণের প্রতি স্বচ্ছতা, কর্তৃপক্ষের কাজে জবাবদিহিতা, কর আরোপ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন, সুষ্ঠু কর ব্যবস্থাপনা ও অনুশাসন, কর নীতির পর্যালোচনা, কর সম্পর্কিত প্রভাবন এবং কর প্রণোদনা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।