Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

‘রাজনীতিকদের লজ্জা এবং---’

প্রকাশের সময় : ৩ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার : বিবেক-বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষমাত্রই লজ্জাবোধ করতে পারেন। বিবেকহীনদের অবস্থা ভিন্ন। প্রবাদে আছে ‘এক কান কাটা বিবেকবানরা হাঁটেন রাস্তার পাশ দিয়ে/ আর দু’কান কাটা লজ্জাহীনরা হাঁটেন রাস্তার মাঝ দিয়ে।’ ‘লজ্জা’ সমাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত শব্দ। মানুষের মধ্যে লজ্জা-শরম থাকলে সমাজের অনিয়ম, দুর্নীতি, অনৈতিকতা, মিথ্যাবাদিতা কম হয়। বিবেকবানরা লজ্জাবোধ থেকেও অনেক ভাল কাজ করেন।
বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন ’৯০ দশকের প্রথম দিকে ‘লজ্জা’ নামের একটি চটিবই লিখে দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করেছিলেন। দেশের আলেম সমাজ ইসলামবিদ্বেষী নারীবাদী ওই লেখিকার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোয় তাকে দেশ ছাড়তে হয়। আলেম সমাজের সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষ ছাড়াও আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী দলগুলো ‘সাহিত্য নামের ওই নষ্টামীর’ বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তসলিমা নাসরিন নারীর সম-অধিকার দাবি করে বলেছিলেন, ‘পুরুষরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্র¯্রাব করলে মেয়েদেরও সেটা করতে দিতে হবে।’ দেশের নারীরা এজন্য তাকে ধিক্কার দিয়েছে। ‘লজ্জা’ শব্দটা তখন থেকে প্রিন্ট মিডিয়ায় বেশি মুদ্রিত হয়। আমাদের দেশের রাজনীতিকদের মধ্যে একটি প্রবণতা দেখা যায়Ñতাদের অনেকেই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে দিনরাত মিথ্যার বেসাতি করছেন। টিভির টকশো থেকে শুরু করে সভা-সমাবেশে একই অবস্থা। নেতা জানেন, তিনি সঠিক বলছেন না, তারপরও নির্দ্বিধায় মিথ্যা বলে যাচ্ছেন। দেশের মানুষ এটা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আর সকালে এক কথা, বিকেলে অন্য কথা এবং নিজ দলের স্বার্থে জনগণের সামনে একের পর এক মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ডাল-ভাতের মতো।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চরম ভরাডুবি হওয়ায় ‘লজ্জা’র হাত থেকে বাঁচতেই বিএনপি এখন সরে দাঁড়াতে চাইছে।’ চমৎকার কথা বলেছেন জনাব হানিফ। তার কথা সত্যি হলে দেশের আমজনতা বুঝবে আমাদের রাজনীতিকদের মধ্যে লজ্জা-শরম আছে। আসলেই কি আমাদের রাজনীতিকদের লজ্জা-শরম আছে? মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করা এদেশের মানুষ অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন। ভোটে হারুক-জিতুক নির্বাচনকে মানুষ মনে করে উৎসব। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা যে কথাই বলুক, যে প্রতিশ্রুতি দিক না কেন রাজনীতি সচেতন মানুষ নিজেদের মতো করে বুঝে নেন; মূল্যায়ন করেন। গ্রামগঞ্জে, ক্ষেতে কাজ করা ক্ষেতমজুর, কৃষক, শ্রমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সবার ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। প্রশ্ন হলো আসলেই কি বিএনপি লজ্জা থেকে বাঁচতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে? মাহবুব-উল আলম হানিফ ও তার সহকর্মী ডা. দীপু মনি দাবি করেছেন, দুই দফায় অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়েছে। তাদের এ সচিত্র বক্তব্য টিভি মিডিয়ার মাধ্যমে দেশের মানুষ শুনেছে। পত্রপত্রিকায় পড়েছে। প্রশ্ন হলো তারা কি সত্য কথা বলেছেন? নির্বাচন কি সত্যিই নিরপেক্ষ হয়েছে? সাধারণ মানুষ কি পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিতে পেরেছেন নির্দ্বিধায়?
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন আহমদ স্বীকার করেছেন নির্বাচনে সহিংসতা হয়েছে। অনিময়ের কারণে তাদের অর্জন ম্লান হয়েছে। নিউ এইজ পত্রিকার সম্পাদক নুরুল কবির টকশোতে বলেছেন, ইউনিয়ন পরিষদে আমি কোনো নির্বাচন দেখিনি; যা হয়েছে তা ভোট নয়। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ ভোটের দিন কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে এসে বলেছেন, ভোটের আগের রাতেই চেয়ারম্যান ভোট হয়ে যায়, দিনে মাত্র মেম্বারদের জন্য ভোট হয়। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, এমন নির্বাচন হচ্ছে যে ইসি নড়েও না চড়েও না। সিইসিকে গোলাপী হিসেবে অবিহিত করে তিনি বলেন, ‘একটা কিছু কর গোলাপী একটা কিছু কও।’ টিভি মিডিয়ায় ইউপি নির্বাচনের যে চিত্র প্রকাশ পেয়েছে তা গণতন্ত্রের ওপর শেষ পেরেক হিসেবে অবিহিত করেছেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন নিয়ে হাজারো মানুষ নানা কথাবার্তা বলছেন। তাহলে কার লজ্জা হওয়া উচিত? হু-া-গো-ার নির্বাচনের পরও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি করা ব্যক্তিদের লজ্জা পাওয়া উচিত, না বিএনপির? আর বিএনপির নেতারাই বা কেমন? ইউপি নির্বাচনে শতকরা ১১ ভাগ ভোট পাওয়ার পরও কি ঘুমিয়েই কাটাবেন?
বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮শ কোটি টাকা চুরির পর সাবেক মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ওই টাকা চুরির পিছনে বিএনপি-জামায়াত জড়িত এমন অভিযোগ তুলে বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হ্যাকিংয়ের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের হাত রয়েছে। এ বক্তব্যের কয়েকদিন পর ব্রাসেলসে বোমা হামলায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। সারাবিশ্বে শুরু হয় তোলপাড়। ড. হাছান মাহমুদ অভিযোগ করে বললেন, ব্যাসেলস বোমা হামলা ঘটিয়েছে বিএনপি-জামায়াত। হায় আল্লাহ! হাজার হাজার মাইল দূরে ব্রাজেলসে গিয়ে বিএনপি-জামায়াত বোমা হামলা করেছে, এ কথা কি কেউ বিশ্বাস করবে? রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ধারাবাহিক মিথ্যা বলা কি লজ্জার বিষয় নয়? কয়েকদিন আগে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (দক্ষিণ) মেয়র সাঈদ খোকন ঘোষণা দিলেন ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে পুরান ঢাকার ময়লা পরিষ্কার করবেন। ঘোষণার পর ইতোমধ্যেই ৪ দিন পার হয়ে গেছে। পুরান ঢাকায় ময়লা যেখানে ছিল সেখানেই রয়েছে। এই মিথ্যা ঘোষণা দেয়া কি লজ্জার বিষয় নয়? ঢাকার দুই মেয়র দাবি করেন তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত। আসলে জনগণ কি তাদের ভোট দেয়ার সুযোগ পেয়েছে? নাকি জনগণের ভোট নিজেরাই দিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন? জনগণের ভোট নিজেরা দেয়া কি লজ্জার বিষয় নয়?
আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ দেশের প্রায় সব দলের নেতারা নিজেদের দেশপ্রেমিক হিসেবে দাবি করে থাকেন। অথচ ভারতের ওপর নির্ভরশীল নেপালের নেতারা যে সাহস দেখান, তার হাজার ভাগের এক ভাগও দেখাতে পারেন না। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার কথা বলেন। কিন্তু সীমান্তে যখন বাংলাদেশীদের গুলি করে হত্যা করা হয় তখন কয়টি দল থেকে প্রতিবাদ করা হয়? কোনো কোনো দল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ‘সমতা, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার’ কি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা আছে কারো মধ্যে? দেশের জাতীয় স্বার্থ তথা তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা না দেয়ায় কৃষির সর্বনাশ হচ্ছে। অথচ দিল্লির চোখ রাঙানির ভয়ে প্রতিবাদ করার সাহস দেখান না। এটা লজ্জার নয়? টিপাইমুখে বাঁধ দিয়ে সিলেটসহ বাংলাদেশের বৃহৎ একটি অঞ্চলকে পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে ফেলা হচ্ছে। দেশপ্রেমের দাবি করেন অথচ এর প্রতিবাদ না করা কি লজ্জার বিষয় নয়? ড. আতিউর রহমান গভর্নর থাকার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮শ কোটি টাকা চুরি হলো। অথচ দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাকে ‘মহামানব’ বানানোর মিশন নিয়ে নেমেছেন? দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ব্যক্তি নিজ আদর্শের অনুসারী হওয়ায় ‘মহামানব’ বানানোর চেষ্টা কি লজ্জার কাজ নয়?
সারাদেশে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রচারণা শুরুর পর থেকে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এবং থানা পুলিশ একতাবদ্ধ হয়ে ধানের শীষের প্রার্থী ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের ভয়ভীতি দেখানো, কর্মীদের গ্রেফতার এবং প্রতিপক্ষের পরিবারকে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। প্রতিপক্ষকে ভয়ভীতি দেখানো গণতন্ত্রের জন্য অহংকারের না লজ্জার? আবার যাকে অবৈধ সরকার বলে মুখের ব্যথা তুলছেন তাদের অধীনে নির্বাচন করা কি লজ্জার নয়? ‘লজ্জা, শরম, ভয় Ñ রাজনীতিকদের কি এসব থাকা উচিত নয়!’



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ‘রাজনীতিকদের লজ্জা এবং---’
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ