Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চট্টগ্রামে প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজি ধরা পড়ে না অস্ত্রধারীরা

পুলিশ নীরব : জনমনে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ৩১ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:০৩ পিএম, ৩০ মার্চ, ২০১৮

নগরীর শেরশাহ এলাকায় হঠাৎ তান্ডব। রাতের নীরবতা ভেঙ্গে গোলাগুলি, ককটেলবাজি। দুই পক্ষের হামলা-পাল্টা হামলায় ভাঙচুর হয় ২০টির মতো গাড়ি, দুই আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িসহ ১৫টি বাড়ির দরজা জানালা। বৃহস্পতিবার রাতের এই ঘটনায় গতকাল (শুক্রবার) বিকেল পর্যন্ত কোন অস্ত্রধারী গ্রেফতার হয়নি। উদ্ধার হয়নি কোন আগ্নেয়াস্ত্র। বায়েজিদ বোস্তামী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম ইনকিলাবকে বলেন, কোন পক্ষই মামলা করেনি, যাদের বাড়ি-ঘর ভাঙচুর হয়েছে তারাও থানায় আসেননি। পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেনি। নগরীর গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে উপ-নির্বাচনে বৃহস্পতিবার দুপুরে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে প্রকাশ্যে মহড়া দেয় পাঁচ যুবক। র‌্যাব-পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর উপস্থিতিতে সেখানে দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলিও হয়। সংঘর্ষের পর রাস্তায় পড়ে থাকে তাজা গুলি আর বন্দুকের খোসা। অস্ত্রধারী ওই যুবকদের ছবি মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে, ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। এতকিছুর পরও ওই অস্ত্রধারীরা ধরা পড়েনি, কোন অস্ত্রও উদ্ধার হয়নি। গতকাল সন্ধ্যায় বন্দর থানার ওসি ময়নুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, আমিও মিডিয়ায় তাদের ছবি দেখেছি, তবে তাদের কেউ এখনও গ্রেফতার হয়নি। অস্ত্রের মহড়া কিংবা দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় কেউ থানায় মামলাও করেনি। শেরশাহ আর গোসাইলডাঙ্গার এ দু’টি ঘটনার মতো বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে প্রতিনিয়তই ঘটছে প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজি। সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে, নিজেদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে। তবে তারা ধরা পড়ছে না। খুনোখুনি এমন কি পুলিশের উপর হামলার ঘটনায়ও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে অস্ত্রধারীরা। তাদের অস্ত্রভান্ডারে পুলিশের হাত পড়ছে না। এসব অস্ত্রবাজরা সরকারি দলের ক্যাডার মাস্তান হওয়ায় ভুক্তভোগীরা মামলা করার সাহস পাচ্ছে না। পুলিশও সবকিছু দেখে শুনে নীবর থাকছে। এতে করে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর আতঙ্ক বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে নিরাপত্তাহীনতা। র‌্যাব-পুলিশের নিয়মিত অভিযানে প্রায় দেশি-বিদেশী অস্ত্র ধরা পড়ছে। গত ১৫ মাসে র‌্যাব-৭ চট্টগ্রামের অভিযানে ৪১৩টি দেশি-বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্র এবং পাঁচ হাজার ৬৫৭ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার হয়েছে। তবে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া আর অস্ত্রবাজি যারা করছে তাদের গ্রেফতারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর তেমন আগ্রহ দেখা যায় না।
শেরশাহ এলাকার সংঘর্ষ প্রসঙ্গে পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, সরকারি দলের দুই গ্রæপের মধ্যে এ সংঘর্ষ হয়। দলীয় কোন্দলে খুন যুবলীগ নেতা মেহদী হাসান বাদল হত্যা মামলার আসামী সাদ্দাম সম্প্রতি কারাগার থেকে মুক্তি পায়। তার নেতৃত্বে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জেরে এ ঘটনা ঘটে। দুই পক্ষই এলাকায় শো-ডাউন করে। এক পর্যায়ে তারা বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়। রাত সাড়ে আটটা থেকে সোয়া নয়টা পর্যন্ত দুই পক্ষ ব্যাপক গোলাগুলি ও ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। এসময় শেরশাহ সাংবাদিক হাউজিং সোসাইটি ও আশপাশের বেশ কয়েকটি বাড়িতে ইটপাটকেল ছুঁড়ে দরজা জানালা ভাঙচুর করা হয়। ভাঙচুর হয় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমানের বাড়ির দরজা জানালাও।
হামলাকারীরা ওই এলাকায় সড়কে সিসিটিভিও ভাঙচুর করে। গোসাইলডাঙ্গায় যারা অস্ত্রের মহড়া দিয়ে বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে তারাও সরকারি দলের ক্যাডার এবং আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর সমর্থক। স্থানীয়রা বলছেন, অস্ত্রধারীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে গুলি করে। ১৫ থেকে ২০ রাউন্ড গোলাগুলি হয় সেখানে। ককটেল বিস্ফোরণও হয় সমানতালে। পুলিশ এসে ধাওয়া দিয়ে দুই পক্ষকে সরিয়ে য়ে। তবে কাউকে গ্রেফতারের চেষ্টা করেনি। স্থানীয়রা জানান, ভোটের আগের রাতেই তাদের অস্ত্রশস্ত্রসহ এলাকায় অবস্থান করতে দেখা যায়।
গত বছর নগরীর দক্ষিণ নালাপাড়ায় নগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাসকে পিটিয়ে হত্যার পর দুই দফায় ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে আনন্দ প্রকাশ করে খুনিরা। ওই ঘটনায় গ্রেফতার দুই যুবলীগ কর্মী কারা ফাঁকা গুলি ছুঁড়েছে এবং সেখানে কয়টি অস্ত্র ছিল পুলিশের কাছে তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে। তবে এখনও সে অস্ত্রধারীরা ধরা পড়েনি। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ চেকপোস্টে গুলি করে কয়েকজন কিশোর। কয়েকদিনের অভিযানে অস্ত্রটি উদ্ধার হলেও অস্ত্রের মালিক যুবলীগ ক্যাডারকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ। সিআরবিতে রেলের টেন্ডারবাজি নিয়ে আলোচিত জোড়া খুনের ঘটনায় ব্যবহার হয় একাধিক ভারী অস্ত্র। দুই দফা তদন্তে মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হলেও ওই অস্ত্রের হদিস পায়নি পুলিশ।
নগরীর জামালখানে কলেজিয়েট স্কুল ছাত্র খুন, তিন পোলের মাথায় সিটি কলেজ ছাত্রলীগ নেতা খুন এবং কদমতলীতে যুবদল নেতা হারুন চৌধুরী খুনের ঘটনায় ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়নি। ছাত্রলীগ যুবলীগের কলহ বিরোধে মহানগরী এবং জেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিয়তই প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজির ঘটনা ঘটছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘাত সংঘর্ষে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপের কর্মীরা। এক মাস আগে হলে তল্লাশি চালিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হলেও ওই ঘটনায় পুলিশ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেউই মামলা করেনি। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দলীয় কোন্দলে নগরীতে সংঘটিত কোন হত্যাকান্ডের ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। তবে আলোচিত সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যায় ব্যবহৃত দু’টি অস্ত্রই উদ্ধার করেছে পুলিশ। মিতু হত্যা মামলার তদন্ত শেষ না হলেও অস্ত্রসহ গ্রেফতার দুইজনের বিচারের রায় হয়ে গেছে।
গেল ইউপি নির্বাচনে হাটহাজারীর একটি ভোটকেন্দ্রে প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে অস্ত্রসহ ধরা পড়েন মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি। ভোটকেন্দ্রে দায়িত্বরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অস্ত্রসহ তাকে ধরে পুলিশে দেন। কয়েক মাস কারাভোগের পর মুক্তি পান ছাত্রলীগ নেতা রনি। বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারও চলছে। কথা কাটাকাটির জের ধরে নগরীর স্টেডিয়াম পাড়ার অফিসার্স ক্লাবে এক যুবলীগ নেতার পায়ে গুলি করেন উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মনজরুল আলম মনজু। প্রথমে তাকে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়া হলেও পরে ছাড়া পান তিনি। তার আগে হেফাজতের নাস্তিক বিরোধী আন্দোলন চলাকালে নগরীর লালখান বাজারে প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে হেফাজত কর্মীদের ধাওয়া করে সমালোচিত হন আওয়ামী লীগ নেতা দিদারুল আলম মাসুম। মিডিয়ায় অস্ত্রধারী দিদারের ছবি প্রকাশিত হলেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
কেউ মামলা না করায় পুলিশ অস্ত্রধারীদের গ্রেফতার করেনি এমন অজুহাত সঠিক নয় মন্তব্য করে চট্টগ্রামের সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট কফিল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমলযোগ্য কোন অপরাধের জন্য থানায় মামলা করার প্রয়োজন নেই। পুলিশ নিজেই অপরাধ আমলে নিয়ে ঘটনার তদন্ত করতে পারে। নগরীর শেরশাহ এবং গোসাইলডাঙ্গায় সংঘটিত দু’টি ঘটনা থানা থেকে মাত্র কয়েকশ গজ দূরে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুলিশের উচিত ছিল তাৎক্ষণিক ঘটনা আমলে নিয়ে অস্ত্রধারীদের গ্রেফতার এবং তদন্ত শুরু করা। কিন্তু পুলিশ তা করেনি। এতে করে সাধারণ মানুষের মধ্যে পুলিশ বাহিনী তথা দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা সম্পর্কে আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে। সাধারণ মানুষ মনে করছে আইন স্বাভাবিক গতিতে চলছে না। এ ধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি কারও জন্যই কল্যাণকর নয়। খুনের ঘটনায় ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র ধরা না পড়ায় মামলার তদন্ত দুর্বল হচ্ছে। এতে করে ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নিহতের স্বজনেরা। বিভিন্ন মামলায় আসামী হয়েও বৈধ অস্ত্রের মালিক হওয়া এবং বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার ঘটনা নজিরবিহীন বলে মন্তব্য করেন তিনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ