Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রশ্নবিদ্ধ তৃণমূলের গণতন্ত্র

প্রকাশের সময় : ২ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৩৬ পিএম, ১ এপ্রিল, ২০১৬

আজিবুল হক পার্থ : জনগণের ভোটে স্থানীয় সরকার তথা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে সংঘাত-সংঘর্ষ। মানুষ মরছে, রক্ত ঝরছে। প্রথম দফা ভোটের চেয়ে দ্বিতীয় দফায় ভোটে প্রাণহানি ঘটেছে বেশি। ভোটের আগের রাতেই গোপনে ব্যালটবাক্স ভর্তি করার খবর ফাঁস হওয়ায় সংঘাত, রক্তপাত ও প্রাণহানিতে দেশী-বিদেশীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। দেশের স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ছাড়াও ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও এই নির্বাচন নামের ‘প্রহসন’ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। নির্বাচন কমিশনকে অথর্ব বলেও তিরস্কার করা হচ্ছে। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে প্রাণহানি ও রক্তপাত নিয়ে ঢাকায় কর্মরত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া স্টিফেন্স ব্লুম বার্নিকাট বলেছেন, নির্বাচনের নামে এমন সংঘাত-সহিংসতা মেনে নেয়া যায় না। সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, ইউপি নির্বাচনে জনগণের ভোটের অধিকারের গণতন্ত্রে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, যখন দেখি নির্বাচনটা হচ্ছে, এর মধ্যে আজকেও ৯ জন মানুষ মারা গেছে। এটাতে তুমি-আমি চক্ষু বুজে রাখতে পারি না। আমাদের নির্বাচন কমিশন লড়েও না, চড়েও না। একটা কিছু কর গোলাপি, একটা কিছু কর। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. অধ্যাপক তোফায়েল আহমদ বলেছেন, নির্বাচনের আগের রাতে চেয়ারম্যানের ভোট রাতেই হয়ে যায়। ফলে রক্ত ঝরছে। আগের রাতে সিল মারা, দখল, জালভোট ও জোর করে কেন্দ্র দখল করে ভোট এবং ফলাফল ঘোষণার পরও দেশের বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনী সহিংসতা চলছেই। চরম অনিয়মের হওয়া এই ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ভোট পেয়েছে ৭০ শতাংশ এবং বিএনপির প্রার্থীরা ১১ শতাংশ ভোট পেয়েছে।
তৃণমূলের এই জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সময় ঘরে ঘরে সংঘর্ষের ঘটনা দৃশ্যমান হচ্ছে। ভোটের পরেও চলছে ভোট নিয়ে সংঘর্ষ। এতে করে সামাজিক কলহ বাড়ছে। প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে তৃণমূলের গণতন্ত্র। সেইসাথে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অযোগ্য নেতৃত্বের কারণে সব পক্ষই ইসির প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। অনিয়ম-সহিংসতা অতীতের যে কোনো রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এতে করে সুষ্ঠু ভোটের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে বলে বিশিষ্টজনদের অভিমত। এই পথ থেকে বেরিয়ে আসাও এখন কষ্টকর বলে তারা মনে করেন। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচন থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। ফলে নির্বাচনী ব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেক পড়ছে বলেও অনেকেই মনে করছেন।
ইউপি নির্বাচনের প্রথম ধাপের সহিংসতার পরে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ায় সহিংসতা বাড়ছে। এতে করে ২য় ধাপে ভোট-পরবর্তী সহিংসতা ঘটেই চলেছে। ভোটের দিনে ৯ জন নিহতের পরের দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে ৫ শতাধিক আহত হয়েছে। গ্রামগঞ্জের এই ভোটে একদিকে যেমন ভাইয়ে ভাইয়ে সংঘাত বাধছে, তেমনি কালো টাকা ও পেশিশক্তির জোরে ক্ষমতাসীন হচ্ছে কিছু ব্যক্তি। ফলে স্থানীয় সরকারের বিস্তীর্ণ এই স্তর ধ্বংসের মুখে পড়ছে।
ভোটের সহিংতায় বাদ পড়েনি নারী, শিশুসহ নিরীহ পথচারী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। ভোটের দিনে সারা দেশে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে ৯ জন নিহত হয়েছে। বৃহস্পতিবার ঢাকার কেরানীগঞ্জে শিশুসহ ২ জন, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে ৩, যশোর সদরের চাঁচড়ায় এক মুড়ি বিক্রেতা, জামালপুর জেলার শ্যামপুরে দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে একজন, মাদারীপুর সদর উপজেলায় ভোট গণনার সময় ব্যালট পেপার ছিনতাই করে পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে একজন এবং মানিকগঞ্জে এক নারী নিহত হয়েছে। গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছে ৫ শতাধিক।
গতকাল ভোটপরবর্তী সহিংসতায় মাদারীপুরে ৭ জন গুলিবিদ্ধ ও অর্ধশত আহত হয়েছে। মহেশপুরে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর আ.লীগের হামলায় অন্তত ২০ জন আহত হয়েছে। মাগুরায় নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতায় আহত ৪ আহত হয়েছে। আশুগঞ্জে নির্বাচনপরবর্তী সংঘর্ষে আহত হয়েছে শতাধিক। পাবনায় পরাজিত ২ ইউপি সদস্যর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছে ২০ জন। মানিকগঞ্জে আ’লীগ প্রার্থীর ৫ এজেন্টের বাড়িতে বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকরা হামলা চালিয়েছে।
ভোটপরবর্তী সহিংস এই ঘটনা প্রথম ধাপে ঘটেনি। এবারেই এই ভয়াবহতা আগামীর অশনি সংকেত বলে অনেকেই মনে করছেন। এই অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের দেওয়া দায়সাড়া বক্তব্যে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশেষ্টজনরা। অনেকেই মনে করেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যের কারণেই সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এসব সহিংসতার দায়ে তাকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবি জানিয়েছেন অনেকেই।
পরপর দুই ধাপের নির্বাচনে প্রায় ৪০ জনের প্রাণহানি এবং ৫ হাজারের মতো মানুষ আহত হওয়ার ঘটনায় পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগ শুরু হয়েছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। আগামীতে নির্বাচন আয়োজনকে যেমন দুরূহ হিসাবে দেখছেন, তেমনি এসব নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা স্থানীয় সরকার তথা দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে চরম দুর্গতি আসবে বলে অনেকেই মন্তব্য করছেন।
ইউপির ২য় ধাপের নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের ৬৩৯টি ইউনিয়ন পরিষদে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে কেন্দ্র দখল, জালভোট প্রদান, ব্যালট ছিনতাই, সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনায় এ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দেশটি। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া স্টিফেন্স ব্লুম বার্নিকাট যুক্তরাষ্ট্রের এ উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, চেয়ারম্যান প্রতীকের ভোট আগের দিন রাতেই হয়েছে। পরের দিন শুধুমাত্র মেম্বার পদে ভোট হয়েছে। এতে করে নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংসের পথে যাচ্ছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনের প্রধান মানদ-ের কোনোটিই পরিপালন হয়নি এ নির্বাচনে। এতকাল মনোনয়ন বাণিজ্য ছিল ওপরের তলায়, এবারের নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য তৃণমূলে ছড়িয়ে গিয়েছে। এবারের নির্বাচনে সহিংসতার ধরনও ভিন্ন। আগে নির্বাচনের দিনে সহিংসতা ঘটত, কিন্তু এবার দীর্ঘমেয়াদি সহিংসতা দেখা দিয়েছে।
চলমান পরিস্থিতিতে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি বলেন, ইসি ইচ্ছা করলে নির্বাচন বাতিলও করতে পারে, গ্রহণও করতে পারে। যে কারও চাকরি খেতে পারে। কিন্তু এ কেমন কমিশন, লড়েও না, চড়েও না। আগায়ও না পিছায়ও না। একটা কিছু কর, গোলাপি একটা কিছু কর।
তিনি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে গতকালও ৯ জন মারা গেল। এখানে তুমি-আমি চক্ষু বুজে রাখতে পারি না। যখন এর মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকদেরও আত্মাহুতি দিতে হচ্ছে, এদের তো রক্ষা আমাদের নির্বাচন কমিশন করতে পারে না। এই রকম নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতা দিয়ে তো আমরা আসি নাই।
ভোটে সহিংসতাতে নির্বাচনী ব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেক মারা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন সিপিবির সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক কমরেড সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ।
এক বিবৃতিতে সিপিবি নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘জ্বি হুজুর’ মার্কা অথর্ব নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে কেবল সরকারের দলীয় নির্দেশ পালন করা। ৫ জানুয়ারির প্রার্থী ও ভোটারবিহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কফিনে ঢোকানো হয়েছিল। আর এবারের সহিংসতা আর ভোট ডাকাতির ইউপি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কি সরকার নির্বাচনী ব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেকটি মারতে চাচ্ছে?
তারা বলেন, প্রথম দফার ইউপি নির্বাচনের পর সহিংসতা প্রতিরোধে সামান্যতম ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়নি। ফলে দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে সহিংসতা ও প্রাণহানি আরো বেড়েছে। এখন চলছে নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতা। দুই দফা নির্বাচনে এই ব্যাপক প্রাণহানি ও সহিংসতার দায় সরকার ও নির্বাচন কমিশন কিছুতেই এড়াতে পারে না। জনগণের সকল গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিতে সরকার তার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। জনগণের ভোটাধিকার হরণ করতে নির্বাচন কমিশনকে দলীয় আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে সরকার।
চলমান অবস্থা নির্বচান বয়কটের পথে যাচ্ছে বিএনপি। বৃহস্পবার কমিশনে গিয়ে দলটির যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান বলেছেন আগে ধাপ দেখার পরে সিদ্ধান্ত। গতকাল দলের ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেছেন, এ অথর্ব নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আমাদের দলীয় প্রতীককে অসম্মান করা হচ্ছে। পরবর্তী ধাপের নির্বাচনগুলোকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করা উচিত।
শাহ মোয়াজ্জেম বলেন, রকিবের (সিইসি রকিব উদ্দিন আহমেদ) বিচার বাংলার মাটিতে হবেই। তুই রকিব কি ভাবছিস, শেখ হাসিনা কি চিরকাল থাকবেন? দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ইউপি নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশ মৃত্যুপরীতে পরিণত হয়েছে। হত্যাকা-ের দায়ভার ইসি এড়াতে পারে না দাবি করে তিনি বলেন, নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে নির্বাচন কমিশনারের ক্ষমতা বেশি থাকে। তাই এই সংকটের সমাধানও নির্বাচন কমিশনকেই করতে হবে।
এদিকে দ্বিতীয় ধাপের ভোটে ৭৬ শতাংশ ভোট পড়েছে। এতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পেয়েছে কমপক্ষে ৭০ দশমিক ৪০ শতাংশ ভোট আর বিএনপি পেয়েছে ১১ শতাংশ ভোট। শুক্রবার ৬৩৯টির মধ্যে ৫৫০টি ইউপির ফলাফল উল্লেখ করা হয়েছে। ছাড়াও বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের ৩৩ ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থী। কেন্দ্র স্থগিতের কারণে ৯টি ইউপিতে ফের নির্বাচন করতে হবে।
এদিকে ৫৪১টি ইউপির মধ্যে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ৩৭২টি আসন। আর বিএনপি ৫৮টি, জাতীয় পার্টি ৩টি এবং জাতীয় পার্টি-জেপি পেয়েছে ২টি আসন। এছাড়া ১০৫টি আসন পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। অবশিষ্ট আসনগুলো অন্যান্য ১৩টি দল পেয়েছে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রশ্নবিদ্ধ তৃণমূলের গণতন্ত্র
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ