Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দুর্ব্যবহারের শিকার শিশুরা বড় হয়ে অনুরূপ আচরণই করে

শিশুদের মানসিক অসুস্থতার জন্য জিন দায়ী নয়

প্রকাশের সময় : ১ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : ব্রিটেনের নেতৃস্থানীয় প্রজনন বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ রবার্ট প্লোমিন ডিএনএ’র এমন কোন সুনির্দিষ্ট রূপ খুঁজে পাননি যা আমাদের মনস্তত্ত্বের ভিন্নতায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে। দরিদ্র লোকজনের দারিদ্র্যের কারণ কি তার নিকৃষ্ট জিনসমূহ? এই ধারণা জনপ্রিয় বিশেষ করে শাসক অভিজাত শ্রেণীর সদস্যদের মধ্যে এটা খুবই জনপ্রিয়। তারা এমনটিই ভাবতে পছন্দ করেন যে জেনেটিক শ্রেষ্ঠত্বের জন্যই তাদের এই উচ্চ অবস্থান। কিন্তু সুযোগ সুবিধার প্রাচুর্যের কারণেই যে তারা অন্যদের চেয়ে ভালো অবস্থানে এই সত্যটা তারা স্বীকার করতে চান না। সাধারণভাবে দরিদ্র লোকদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক স্বল্পতা ও মানসিক অসুস্থতার হার বেশী। জিনবিজ্ঞানীরা মনে করেন, উভয় ক্ষেত্রেই জিনসমূহ একটি বড় ভূমিকা পালন করে। তবে তারা যদি ঠিক  হয়ে থাকেন তাহলে একটি দৃঢ় যুক্তি রয়েছে যা এটাই ইঙ্গিত দেয় যে নিকৃষ্ট জিনসমষ্টির তলানিতে দরিদ্রদের ডুবে যাওয়ার কারণ নিকৃষ্ট ডিএনএ।
তথ্যগুলো এখন আর সমর্থনযোগ্য না হলেও হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টের তথ্যের আলোকে নেতৃস্থানীয় মনোবিজ্ঞানী কেন রিচার্ডসন সম্প্রতি মনস্তত্ত্ব পেশার ম্যাগাজিন হাউজে বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন। এর বিপরীতে অগুরুত্বপূর্ণ জিনসমূহের প্রভাব যদি আমরা সঠিকভাবে পরিবর্তন করতে পারি তাহলে আমরা তাদের লেখাপড়ার অনীহা ও লো-একাডেমিক পারফরমেন্স কার্যতো দূর করতে পারি। তাদের মানসিক অসুস্থতাও দূর করতে পারি। এর মাধ্যমে মানুষের অপরাধ প্রবণতা ও মাদকের অপব্যবহারের মতো নানা সমস্যাও কমিয়ে আনা যেতে পারে।
১৬ বছর আগে এই প্রজেক্টের ফলাফল প্রকশিত হওয়ার পর থেকে এমন সব জিন আবিষ্কৃত হয়েছে মানুষের উচ্চতা ও ওজনের মতো শারীরিক বৈশিষ্ট্যে যেগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। তাই আপনি এখন মনস্তত্ত্ব গঠনে একই রকম প্রত্যাশা করতে পারেন। তবে ব্রিটেনের নেতৃস্থানীয়  প্রজনন বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ লন্ডনের কিংস কলেজের গবেষক রবার্ট পোলিন কোন সুনির্দিষ্ট রূপের ডিএনএ খুঁজে পাননি আমাদের মনস্তত্ত্বের ভিন্নতায় যার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। বিজ্ঞানীরা এটাকে হারিয়ে যাওয়া উত্তরাধিকার বলছেন। তবে এটা ধারণা করার জোরাল ভিত্তি রয়েছে উত্তরাধিকার প্রকৃতঅর্থে নিরুদ্দিষ্ট হয়ে যায়নি। বরং এর অস্তিত্ব বিদ্যমান নয়।
ডিএনএ’র বিভিন্ন রূপসমূহ এখনো আবিষ্কার না হলেও অব্যশই এর অর্থ এই নয় যে এগুলো লালন করা যাবেনা। উদাহরণ হিসেবে আমরা এটা নিশ্চিত জানি যে, মায়ের জরায়ুতে যা ঘটে সন্তানের শৈশবে তার একটি বড় প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে শিশুর মনোযোগ ঘাটতির সমস্যা বা অস্বাভাবিক আচরণে গর্ভস্থকালীন সময়ের একটা প্রভাব রয়েছে। এটাও পরিষ্কার যে অনেক প্রতিবন্ধী (অটিস্টিক) শিশু মস্তিষ্কের অস্বাভাবিকতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে থাকে। তাই আপনার সন্তান অংকে খুব খারাপ হলে এটা জেনে রাখুন যে এটা তাদের জেনেটিক নিয়তি নয়। তাদের উন্নতির সম্ভাবনা বাড়ানো যেতে পারে। উত্তরাধিকর প্রকৃত অর্থে নিরুদ্দিষ্ট নয় বরং এটার অস্তিত্ব বিদ্যমান নয় এই ধারণার জোরালো যুক্তি রয়েছে।
অংক শিক্ষার সামর্থ্য নির্দিষ্ট নয় এর উপর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশুর উপর একটি সর্বোত্তম গবেষণা চালানো হয়। এ নিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। দুই বছর পর দেখা যায় তাদের অংকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। গবেষণায় দেখা যায় প্রথম দিকে বেশীর ভাগই শিশুই মনে করতো যে তাদের অংকের সামর্থ্য নির্দিষ্ট। অথচ এ ক্ষেত্রে তাদের অনেক উন্নতি হয়েছে। আবার পিতামাতা ও শিক্ষকরা মনে করেন যে শিশুদের সামর্থ্য নমনীয় যা পরিচর্যার মাধ্যমে উন্নতি ঘটানো যেতে পারে।
ফিনল্যান্ডে যেমন দেখা গেছে, যদি এটা মনে করা হয় যে প্রতিটি শিশুর ভালো করার সামর্থ্য-সম্ভাবনা রয়েছে এবং তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যদি সঠিক সম্পদ-উপকরণ যোগানো হয় তাহলে দেখবেন শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মানে তারা ভালো করছে। সিঙ্গাপুরের পদ্ধতি অনুসরণ ছাড়াই ফিনল্যান্ডে এই ফলাফল অর্জিত হয়েছে। সিঙ্গাপুরের পদ্ধতি হলো কিছুটা বলপূর্বক এবং কম বয়সেই শিশুর উপর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী পড়াশোনা চাপিয়ে দেয়া।
মানসিক অসুস্থতার শিকার লোকদের ক্ষেত্রেও অনুরূপ প্রমাণ রয়েছে। যদি তাদের ক্ষেত্রে এটা ভাবা হয় যে তাদের অনিরাময়যোগ্য জেনেটিক সমস্যা রয়েছে তাহলে তা একেবারেই ভুল। তাদের পরিবার বা পরিচর্যাকারীরা যদি এটা ভাবে তাহলে তাদের সম্ভাবনা আসলেই ভালো নয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে কয়েকটি প্রজন্ম অতিক্রমের পরও তাদের যে সমস্যা তা জিনগত নয় বরং লালন-পালনের ধরনের কারণে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, যেসব শিশু দুর্ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে বড় হয় পরবর্তীতে তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশ দুর্ব্যবহার সম্পন্ন পিতামাতা হয়ে উঠেন।
তবে পিতা-মাতাকে নিজেদের অপরাধী মনে করা উচিত নয়। বরং এ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টারত তাদের শিশুদের সাহায্য করা উচিত। তাদের এটা ভাবা উচিত কেন তাদের পিতা-মাতা বা দাদাদাদিরা তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করতেন। এ ধরনের দুর্ব্যহার তাদের শিশুকালে কি সমস্যা সৃষ্টি করতো ঠা-াভাবে সেগুলো তাদের ভাবা উচিত। এটা ভেবে যদি তাদের ধ্যান-ধারণা পরিবর্তন করেন তাহলে বংশ পরম্পরায় দুর্ব্যবহারের যে বৃত্ত তা আমরা ভাঙতে পারি। জেনেটিক ভাবনায় ডুবে থাকলে তা থেকে পরিত্রাণের কোন আশা নেই।
শিশুদের মানসিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করতে হবে। বিজ্ঞান আমাদের প্রবৃত্তিকেই সমর্থন করে। পিতা-মাতার ভালোবাসা ও খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুদের লালন-পালনের মধ্যদিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপক উন্নয়ন হয়। অনুরূপভাবে দুর্ব্যবহার ও সামাজিক সুবিধার বঞ্চনা প্রায়ই মানসিক অসুস্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যেসব ব্যক্তি পাঁচ বা ততোধিক ধরণের দুর্ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পরে তাদের মধ্যে ১৯৩ গুন অনুরূপ দুর্ব্যবহারের  লক্ষণ দেখা যেতে পারে। আর যারা এই সমস্যার সম্মুখীন হয়নি তাদের মধ্যে পরে এই সমস্যা দেখা যায়না। অন্যান্য মানসিক অসুস্থতায়ও অনুরূপ ফল পাওয়া গেছে। গবেষণায় দেখা যায়, শিশুদের প্রথম অবস্থায় বিশেষ কর ৯ থেকে ১০ বছরের শিশুরা যদি দুর্ব্যবহারের শিকার হয় তাহলে ১৮ বছর বয়স নাগাদ তাদের মধ্যে মানসিক অসুস্থতা দেখা দেয়। এর বিপরীতে বাস্তবে দেখা যায় ২০১১ সাল নাগাদ ১১৫টি জেনেটিক গবেষণা পরিচালনা করা হয়। এসব গবেষণায় এর মধ্যে কোন সম্পর্কের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তারপর থেকে বুদ্ধিবৃত্তি ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আরো অনেক গবেষণা চালানো হয় কিন্তু ফলাফল একই রকম।
পিতা-মাতার অনবরত নেতিবাচক আচরণগুলো কেমন করে তাদের উত্তরসূরিদের উপর প্রভাব ফেলে তা অনুধাবনের জন্য পিতা-মাতাকে শিক্ষিত করে তোলার প্রয়োজন রয়েছে। বিশ্বের পঞ্চম সমৃদ্ধ সমাজ হিসেবে ব্রিটেন এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সমর্থন যোগানোর চেষ্টা করতে পারে। দৃষ্টান্ত হিসেবে অস্ট্রিয়ার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই দেশটি কাজ থেকে ছুটি নিয়ে নিজের সন্তানদের লালন পালনে বেশী সময় দিতে ইচ্ছুক এমন পিতা-মাতাদের অনেকদিন ধরে ব্যাপক আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে।
শিশুদের অবস্থার উন্নয়নে আমাদের আকাক্সক্ষা নিয়ে রাজনীতিকরা প্রায়ই খেলা করছেন। এ ক্ষেত্রে যদি আমরা কেবল বাস্তব নিরাপত্তার একটি মৌলিক স্তর অর্জন দেখতে পাই তাহলে সেটা হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা আমাদের ভৌত সম্পদ, স্টক ও অথবা শেয়ারের চেয়ে বেশী মূল্যবান। ভালোবাসা ও খেলাধুলার আনন্দদায়ক পরিবেশের মধ্যদিয়ে আমাদের নতুন প্রজন্মকে লালন করা অন্যান্য ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন বা সম্পদ অর্জনের চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দুর্ব্যবহারের শিকার শিশুরা বড় হয়ে অনুরূপ আচরণই করে
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ