Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গভীর রাতে বিকট শব্দ : আতঙ্কে ঘুম ভাঙে নগরবাসীর

প্রকাশের সময় : ২৪ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম ঃ গভীর রাতে হঠাৎ বিস্ফোরণের বিকট শব্দ। আতঙ্কে ঘুম ভাঙে নগরবাসীর। বিকট শব্দ কোথা থেকে আসছে তা জানার চেষ্টা থাকে অনেকের। পরিচিতজনদের মধ্যে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে জানার চেষ্টা করেন কেউ কেউ। হয়তো পাশেই কোনো কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ে বা কোনো অনুষ্ঠান চলছে। সবার পক্ষে সেই খবর জানাও সম্ভব হয় না। বাকী রাত আতঙ্কে নির্ঘুম কেটে যায়। রাজধানীর প্রতিটি এলাকাতেই এই সমস্যা বিদ্যমান।
বিয়ে বা অন্যকোনো অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গভীরা রাতে পটকারুপি বোমা ফোটানো হয় নিছক আনন্দ বা মজা করার জন্য। সেই মজা কতো মানুষের ঘুম হারাম করে, কতো মানুষের বুকের ব্যাথাকে জাগিয়ে দেয়-তার খবর কেউ রাখে না। রাতভর বিষয়টি নিয়ে ভাবনা কাউকে কাউকে প্রতিবাদী করে তোলে। দিনের ব্যস্ততায় সে প্রতিবাদ হারিয়ে যায়। রাজধানীর পুরান ঢাকার শাখারীবাজার ও ঠাটারীবাজারে বিকট ‘শব্দ’ সৃষ্টিকারী এসব পটকা বা বোমা এবং এগুলো তৈরীর সরঞ্জাম কিনতে পাওয়া যায়। ভারত থেকে আনা রকেট বোমা এখন উচ্চ শব্দের জন্য বেশি বিক্রি হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। শাখারীবাজারে বিয়ে এবং ঠাটারীবাজারে হার্ডওয়ার সামগ্রীর আড়ালে এসব শক্তিশালী ‘বোমা’ বিক্রি হচ্ছে দেদারছে।
পুলিশ জানায়, ডিএমপির প্রতিটি থানা এলাকায় রাত ১১টার পর উচ্চস্বরে গান বাজনা, মাইক বাজানো, পটকা ফোটানো আইনত নিষিদ্ধ। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. আজিজুর রহমান বলেন, এটা অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার। মধ্যরাতে হঠাৎ করে বিকট শব্দ হলে মানুষ আতঙ্কিত হবে এটাই স্বাভাবিক। এতে মানুষ ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে নিজেকে অনিরাপদ মনে করে। মানুষের মনে তখন নানা উদ্বেগ ও আশংকা ভর করে। দু:শ্চিন্তায় অনেকেই সারারাত ঘুমাতে পারে না। এভাবে কয়েকদিন চললে যে কোনো মানুষ অসুস্থ হয়ে যেতে পারে।
আলাপকালে ডিএমপির এক থানার ওসি জানান, গত শুক্রবার গভীর রাতে তাকে একজন ম্যাজিস্ট্রেট ফোন করে উচ্চশব্দে বাজা এক মাইক নিয়ে অভিযোগ করেন। সাথে সাথে সেখানে পুলিশ পাঠিয়ে মাইকটি জব্দ করা হয়। রামপুরা এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী মোশাররফ হোসেন জানান, কয়েকদিন আগেও গভীর রাতে বিকট শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। পাশের ভবনে তার এক আত্মীয়কে ফোন করে তিনি জানার চেষ্টা করেন শব্দটি কোথা থেকে আসছে। ওই আত্মীয় তাকে জানান, হাতিরঝিলের দিক থেকে শব্দটি আসছে বলে তার মনে হচ্ছে। এসময় বিটিভি ভবনের কাছের পরিচিত একজন তাকে ফোন করে একই বিষয় জানতে চান। মধ্যরাতে তিনজন মিলে মোবাইল ফোনে কথা বলে তিন রকমের ধারণা পোষণ করেন। এগুলো হলো, হয়তো র‌্যাবের সাথে কোন সন্ত্রাসী গ্রুপের গোলাগুলির এক পর্যায়ে ‘ক্রসফায়ার’ এর ঘটনা ঘটেছে। দখলদারিত্ব নিয়ে কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপ বিবাদে লিপ্ত হয়েছে অথবা কোনো ছিনতাইকারী গ্রুপকে ধাওয়া করেছে টহলরত পুলিশ।
গত বৃহস্পতিবার রাত তিনটার দিকে কদমতলী থানার দনিয়া এলাকায় হঠাৎ করে এরকম বিকট শব্দে ঘুম ভাঙ্গে গোয়ালবাড়ী মোড়সহ দক্ষিণ দনিয়ার শত শত মানুষের। এসময় শিশুদের কান্নাও শোনা যায়। কি হচ্ছে তা জানার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় অনেকেই। প্রায় আধা ঘন্টা ধরে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ চলতেই থাকে। এক পর্যায়ে খবর পেয়ে পুলিশ এসে এক বাড়িতে হানা দিলে সব বন্ধ হয়ে যায়। জানতে চাইলে কদমতলী থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী বলেন, গভীর রাতে গান বাজনা, মাইক বাজানো বা পটকা ফোটানো আইনত নিষিদ্ধ। এজন্য আমরা কোনো অনুমতি দেই না। তারপরেও শীত এলেই এগুলো বেড়ে যায়। খবর পেলে তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে পুলিশ পাঠিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করি।
গভীর বা মধ্যরাতে এরকম বিকট শব্দের কথা জানিয়েছেন উত্তরা, বাড্ডা, খিলগাঁও, মোহাম্মদপুর, বাসাবো, গোপীবাগ, মীরহাজিরবাগ, রায়েরবাগ, জিগাতলা, নিউপল্টন, মিরপুর ১০নং সেকশন, পল্লবী বেনারশী পল্লী এলাকার বাসিন্দারা। তাদের বক্তব্য মতে, গভীর রাতে বিকট শব্দে প্রায়ই তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। গুলী নাকি বোমা, র‌্যাব নাকি পুলিশ, ডাকাত নাকি সন্ত্রাসী-এসব প্রশ্ন মনে ভর করে নির্ঘুম রাত কেটে যায় অনেকের। এসময় শিশু বা বৃদ্ধদের ঘুম ভাঙলে বেশি অসুবিধায় পড়তে হয়। হৃদরোগে আক্রান্তরা পড়েন মহাবিপাকে। হারুন অর রশিদ নামে মিরপুর এলাকার এক স্কুলশিক্ষক বলেন, বেশ কয়েকবার এরকম পরিস্থিতিতে পড়ে রাতভর ভেবেছি এটার একটা সুরাহা হওয়া উচিত। পুলিশের কাছে অভিযোগ করবো। প্রয়োজনে ডিসি সাহেবের কাছে যাবো। নির্ঘুম রাত কাটানোর পর দেরিতে ঘুম থেকে জেগে দিনের ব্যস্ততায় সেটা আর হয়ে ওঠেনি।
হাত বাড়ালেই বোমা ও বোমা তৈরীর সরঞ্জাম
পুরান ঢাকার শাখারীবাজার ও ঠাটারীবাজারে টাকা দিলেই পাওয়া যায় বিকট শব্দ সৃষ্টিকারী পটকা বা বোমা। এ ছাড়া বোমা তৈরীর সরঞ্জামও মেলে অনায়াসে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শাখারীবাজারে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়ের অনুষ্ঠানের সরঞ্জামাদি বিক্রির আড়ালে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ভারত থেকে আনা শক্তিশালী পটকা বা বোমার জমজমাট ব্যবসা করে যাচ্ছে। তবে ক্রেতাভেদে এসব বিক্রি করা হয়। ক্রেতার পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে তারা পটকা বা বোমা আছে বলে মুখ খোলে না। শক্তিশালী পটকা বা বোমার পরিভাষা হলো ‘রাঙ’। অন্যদিকে, ঠাটারীবাজারেও হার্ডওয়ার সামগ্রীর আড়ালে ভারতীয় পটকা বা বোমার ব্যবসা চলছে। সূত্র জানায়, ঠাটারীবাজারের হার্ডওয়ারের কয়েকটি দোকানে শক্তিশালী পটকা এবং পটকা তৈরীর সরঞ্জাম বিক্রি হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, তারা বোমা, ফানুস বোমা, চকলেট বোমা, ঝরনা বোমা, রকেট বোমা ইত্যাদি। উচ্চ শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে বলে এখন ‘রকেট বোমা’র কদর বেশি। প্রতি পিস দু’শ টাকা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ শাখারীবাজার এলাকা থেকে এর আগে বেশ কয়েকবার বোমা তৈরীর সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে। সূত্র জানায়, অধিক মুনাফার লোভে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী শিল্পায়নের জন্য আমদানিকৃত সালফার ও পটাশিয়াম তুলে দিচ্ছে বোমা কারিগরদের হাতে। বোমা তৈরির এসব কাঁচামাল নিয়ে সন্ত্রাসীরা তৈরী করছে বোমা, গ্রেনেড, ককটেল, চকলেট বোমাসহ আতশবাজি। গভীর রাতে কোনো অনুষ্ঠানে এসব ফুটিয়ে মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। মনোবিজ্ঞানী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. আজিজুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, গভীর রাতের কোনো বিকট শব্দ সৃষ্টি করার আগে আমাদের ভেবে দেখা উচিত এতে কারও অসুবিধা হবে কি না। অন্য মানুষের সুবিধা-অসুবিধা, ভালো-মন্দ চিন্তা করে কাজ করলে এ সমস্যাই শুধু সমাধান হবে না, এতে করে আমাদের পুরো সমাজটাই সুন্দর হবে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গভীর রাতে বিকট শব্দ : আতঙ্কে ঘুম ভাঙে নগরবাসীর
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ