পোশাক রপ্তানিতে উৎসে কর ০.৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব
আগামী পাঁচ বছরের জন্য তৈরি পোশাক রপ্তানির বিপরীতে প্রযোজ্য উৎসে করহার ১ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ০.৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে পোশাক খাতের দুই সংগঠন
সরকার আদম আলী, নরসিংদী থেকে : আমন ধান কাটার মৌসুম শেষ হয়েছে গত পৌষ মাসে। চাষী ধান কেটে ঘরে তুলেছে। কৃষকের গোলায় এখনো খোরাকী রয়েছে। এরপরও নরসিংদীসহ দেশের বাজারসমূহে চালের দাম কমছে না। গত ৩ উৎপাদন মৌসুমে ৭ বার চালের দাম বেড়ে বর্তমানে স্থিতাবস্থায় রয়েছে। কিছুতেই দাম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে না। সরকার চালের বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক ক্রয় ক্ষমতার ভিতরে আসছে না চালের মূল্য। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধ শতাব্দীকালেও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে না। চালের মূল্য নিয়ে ভোক্তা সাধারণের মধ্যে চলছে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড়।
ধান গাছের ভেজিটেটিভ গ্রোথ বা ডিগপাতার বৃদ্ধি দেখে বাম্পার ফলনের অতিশয় আত্মতৃপ্তি ও অতি প্রচার, ধানের চাষাবাদ ও ফলনের পিছনে সূ² পর্যবেক্ষণের অভাব, কৃষকদের অসচেনতা, বিকল্প ফলন বা ধানের চিটার হারের ওপর জরীপ না থাকা, বিদ্যুৎ বিভাগ ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, সেচ, সার ও কীটনাশক প্রয়োগে কৃষকদের হেয়ালীপনা, কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কৃষকদের মধ্যে সঠিক যোগাযোগের অভাব, উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান নির্ধারিত সময়সীমার ভিতর চাষাবাদে ব্যর্থতা, অপরিকল্পিতভাবে অতিরিক্ত পানির ব্যবহার এবং সর্বোপরি মজুদদার, মুনাফাখোর চাল সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
ফলে কাগজেপত্রে বাম্পার ফলনের কথা বলা হলেও বছরের পর বছর ধরে ধানের উৎপাদন ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। আর এ উৎপাদন ঘাটতির কারণে বার বার চালের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতি মৌসুমেই দেখা দিচ্ছে চালের সংকট। উৎপাদন ঘাটতির মওকা বুঝে চাল সিন্ডিকেটের সদস্যরা বছরের পর বছর ধরে ইচ্ছেমতো চালের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
বেসরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে মোট কমবেশী ২ কোটি ৭৯ লাখ ৩৩ হাজার ৮৭০ মেট্রিক টন খাদ্যের চাহিদা রয়েছে। এ চাহিদা কেন্দ্র করেই দেশের ধান উৎপাদন ব্যবস্থা আবর্তিত হচ্ছে। ধান চাষাবাদের জমি রয়েছে ১,১১,২৫,৩০২ হেক্টর। মোট খাদ্য চাহিদা কেন্দ্র করে উল্লেখিত পরিমাণ জমি থেকে এ পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন করতে হয়। ধান চাষাবাদের জন্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সস্টিটিউট (ব্রি) ও বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচার এসোসিয়েশন (বিনা)’র উদ্ভাবিত বোরো আউশ ও আমন মৌসুমে উচ্চ ফলনশীল ও হাইব্রিড ধানের ভ্যারাইটির সংখ্যা কমবেশী ৯১ টি। এসব ভ্যারাইটির মধ্যে নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ভ্যারাইটির ধান চাষাবাদ হয়ে থাকে। এর মধ্যে বোরো মৌসুমে সবচেয়ে বেশী আবাদ হয় ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ ভ্যারাইটি। আউশ মৌসুমে চাষাবাদ হয় বিআর ২, ২৬, ৪৩ ও ৪৮ ইত্যাদি ভ্যারাইটি। আমন মৌসুমে চাষাবাদ হয় ব্রি-১১, ব্রি-৪৯ ইত্যাদি। এছাড়া রয়েছে কয়েকটি হাইব্রিড ভ্যারাইটি ও স্থানীয় জাতের কিছু ধান চাষাবাদ হয়। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এসব ভ্যারাইটির চাষাবাদে যে নির্ধারিত পঞ্জি দিয়েছে তা অনুযায়ী ভ্যারাইটিগুলো চাষাবাদ করার কথা থাকলেও চাষীরা কিছুতেই এ পঞ্জি অনুসরণ করে ধান চাষাবাদ করতে পারছে না। ফলে ভ্যারাইটির সর্বোচ্চ ফলনও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। অথচ বছরের পর বছর ধরে আবাদকৃত মোট জমি ও ভ্যারাইটির সর্বোচ্চ ফলন হিসেব করে দেশের খাদ্য চাহিদা ও উৎপাদন নিরুপন করা হচ্ছে। আর এখানেই রয়ে যাচ্ছে শুভংকরের ফাঁকি। ব্রি-২৮ ভ্যারাইটিতে উদ্ভাবন করা হয় ১৯৯৪ সালে। এর ব্যাপ্তিকাল নির্ধারণ করা হয় ১৪০ দিন। হেক্টর প্রতি সর্বোচ্চ ফলন ধরা হয় ৫ থেকে ৬ মেট্রিক টন। পাশাপাশি ব্রি-২৯ ভ্যারাইটিও উদ্ভাবন করা হয় ১৯৯৪ সালে। এর ব্যাপ্তিকাল ধরা হয় ১৬০ দিন। ফলন ২৮ ভ্যারাইটির সমপরিমাণ। এই ভ্যারাইটি দুটি চাষীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এর ভাত ভালো হয় বলে চাষী এই ভ্যারাইটি দুটি ব্যাপকভাবে চাষাবাদ করে থাকে। দেশে উৎপাদিত চালের সিংহভাগই হচ্ছে ২৮ ও ২৯ ভ্যারাইটির চাল। কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে ধান বায়ুপরাগী বলে কয়েক বছরেই ভ্যারাইটিগুলো পলিনেটেড হয়ে যায়। অর্থাৎ অন্যান্য ভ্যারাইটির ধানের সাথে সংমিশ্রণে সংকরায়িত হয়ে যায়। ২৪ বছর পূর্বে উদ্ভাবিত ২৮ ও ২৯ ধানের ফলন পঞ্জিতে উল্লেখিত পর্যায়ে আর নেই। এই ভ্যারাইটি দুটো পলিনেটেড হয়ে ফলন প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে জানিয়েছে চাষীরা। অর্থাৎ হেক্টর প্রতি ৬ টনের স্থলে বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে ৩ থেকে সাড়ে ৩ টন। চাষীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে বিঘা প্রতি যেখানে ফলন হবার কথা ২৫ থেকে ৩০ মণ সেখানে বিঘা প্রতি ১৫ মণ ফলন পেয়েই চাষীরা বেশ খুশী। অর্থাৎ সাধারণ চাষী যারা উৎপাদিত ধান দিয়ে বছরের খোরাক চালায় তারা ফলনের হিসেব করে না। বছরের খাবার পেলেই তারা খুশী। যার ফলে এই ভ্যারাইটি দুটোর ফলন নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। এখন ফলন কম হওয়ার কারণ নিয়েও কেউ চিন্তা করছে না। পঞ্জি অনুযায়ী ২৮ ও ২৯ ভ্যারাইটির দুটি বীজতলায় তৈরী ধানের চারা বয়স এক মাস হলে ক্ষেতে নিয়ে রোপন করতে হয়। কিন্তু দেখা গেছে কোন কৃষকই বীজতলা থেকে ২ আড়াই মাসের পূর্বে চারা নিয়ে জমিতে রোপন করতে পারেনা। এখানে বীজতলায়ই ধানের চারার বয়স কেটে যায় ৬০-৭০ দিন। ১৬০ দিনের মধ্যে যদি বীজতলায় কেটে যায় ৬০ দিন তবে জমিতে বয়স পায় মাত্র ১০০ দিন। এই ৬০ দিনে ধানের গ্রোথ বা টিলিং হতে কেটে যায় আরো ৬০ দিন। ফলে এসব চারায় টিলিং হয় কম, ধানের ছড়া হয় ছোট। উৎপাদন বা ফলন স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়। এছাড়া জমিতে পানির ব্যবহার নিয়েও চাষীরা পঞ্জি অনুসরণ করতে পারে না। ভিয়েতনাম, ফিলিপিন ও চায়নার চাষীরা এক কেজি ধান উৎপাদনে ব্যবহার করে ১৮ থেকে ২৫শ লিটার পানি। কিন্তু বাঙালী চাষীরা ব্যবহার করে ৩ থেকে ৪ হাজার লিটার পানি। সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীও ধান উৎপাদনে পানির ব্যবহার কমাবার পরামর্শ দিয়েছেন। পানির অপ-ব্যবহারের জন্য ফলন বাধাগ্রস্ত হয়। এভাবে পঞ্জি অনুযায়ী উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষাবাদ করতে না পারায় উৎপাদন কমবেশী ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কমে যায়। কিন্তু এই অবস্থাগুলোর সূ² কোন পর্যবেক্ষণ যেমন চাষীরা করতে পারেনা। তেমনি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগও এসব পর্যবেক্ষণের ধার ধারে না। কিন্তু মজুদদার মুনাফাখোররা এ বিষয়টিকে খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে চালের মজুদ গড়ে তোলে। ক্ষেতে ধানের শীষ বের হবার পর জমিতে জমিতে গিয়ে একটি ধানের চারায় কতটি শীষ বেরিয়েছে এবং একেকটি শীষে কত সংখ্যক ধান হয়েছে এবং কত সংখ্যক চিটা হয়েছে তা হিসেব করে সম্ভাব্য মোট ফলন হিসেব করে ফেলে। তারা দেশের প্রধান প্রধান জেলাগুলো থেকে রিপোর্ট নিয়ে তা পর্যালোচনা করে। হিসেব করে সরকারের আগেই তারা বুঝতে পারে যে, এ বছর ফলন কেমন হবে। এরপর তারা ইচ্ছেমতো চালের মজুদ গড়ে তোলে এবং মূল্য বৃদ্ধি করে একচেটিয়া মুনাফা লুটে নেয়। এ অবস্থাটা সরকার কিংবা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বুঝতে পারে না। বুঝতে পারলেও তাৎক্ষণিক কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে না। ফলে একদিকে ধান কাটা শুরু হয়, অপরদিকে চালের দাম বাড়তে থাকে। এর প্রমাণ এ বছরের ৩টি উৎপাদন মৌসুমে চালের মূল্য বৃদ্ধি। পত্র-পত্রিকায় ধানের ডিগপাতার ছবি দিয়ে খবর প্রচার করা হয় বাম্পার ফলন হয়েছে। একদিকে বাম্পার ফলনের প্রচার চলতে থাকে, অপরদিকে চালের দাম বাড়তে থাকে। এই বাম্পার ফলনের প্রচার-প্রচারণা স্বাধীনতার পূর্বাপর সময়ে লক্ষ্য করা যায়নি। গত কয়েক দশক ধরে বাম্পার ফলনের এই প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়েছে। কৃষি সচেতন লোকজন জানিয়েছে, সরকারকে খুশী করার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা কিছু সুবিধাবাদী সংবাদপত্রের মাধ্যমে এসব বাম্পার ফলনের প্রচার চালায়। বাম্পার ফলন কাকে বলা হয় এ ব্যাপারে কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একজন কৃষি বিজ্ঞানী জানিয়েছেন, বাম্পার ফলনের প্রচারণা একটি আত্ম প্রবঞ্চনার নামান্তর মাত্র। যার প্রমাণ বর্তমান চালের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি।
তিনি জানিয়েছেন, যদি কোন উফশী জাতের ধানের ভ্যারাইটির ফলন নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশী হয় তবে তাকে বাম্পার ফলন বলা হয়। কেউ কেউ বলছেন, ভ্যারাইটির মূল লিটারেচারে যে পরিমাণ ফলনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে জমিতে যদি সে পরিমাণ ফলন হয় তবে তাকে বাম্পার ফলন বলে। যা বর্তমান সময়ে একেবারেই অসম্ভব। একটি ভ্যারাইটির বাম্পার ফলন হতে পারে কেবলমাত্র ফাউন্ডেশন সীড থেকে উৎপাদিত চারা যদি সঠিক সময় রোপন করা যায়। এরপর যে পরিমাণ উৎপাদন হবে তাকে স্বাভাবিক ফলন বলা যেতে পারে। বর্তমান প্রত্যায়িত, মানঘোষিত এবং চাষীদের সংরক্ষিত ধান চারা দিয়ে বাম্পার ফলনের আশা করা বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়। গত বছর তিনটি মৌসুমে ধানের উৎপাদন ঘাটতির কারণে চলতি বছর যে চালের সংকট দেখা দিয়েছে তা মোকাবেলার জন্য এবছর বোরো ধান উৎপাদনে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বিশেষ নজর দিয়েছে বলে জানা গেছে। তবে যেসব সূ² কারণে ধানের ফলন কম হয় ত্রæটিগুলো যদি দূরীভূত করা না যায় তবে এবারের বোরো ধানের ফলন দিয়ে কোনক্রমেই খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলা সম্ভব হবে না। বর্তমান বাজারে চালের মূল্য বেড়ে যে স্থিতাবস্থায় রয়েছে, বোরো ধানের ফলন যদি কম হয় তবে সামনে ভয়াবহ খাদ্য সংকটের আশংকার করছেন সচেতন দেশবাসী।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।