দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মাওলানা আবদুল হামিদ: ফেব্রয়ারি মাস। যা আমাদের কাছে ভাষার মাস হিসেবে পরিচিত। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার প্রমুখ এ মাসেই ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনে বাঙ্গালী এমন দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে যেমনটা বিশ্বের কোথাও খুজে পাওয়া বিরল। এক সহিংস রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা পেয়েছি মাতৃভাষার মর্যাদা। তাই, মহান ভাষা সৈনিকদের শ্রদ্ধা জানাই ও ভাষা শহিদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
আল্লাহ আমাদের দান করেছেন মাতৃভাষা। পরম দয়ালু আল্লাহ তা’লা কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষ। দান করেছেন ভাষা। ভাষা আমাদের খোদা প্রদত্ত সেরা দান। ভাষা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশ্ববাসীর জন্য এক মহা নেয়ামত। আল্লাহ তা’লা আল-কুরআনের সুরা- আর রাহমানের প্রথম দিকে ইরশাদ করেছেন : “পরম করুণাময় আল্লাহ, তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন, সৃষ্টি করেছেন মানুষ, শিক্ষা দিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে।” (সুরা রাহমান, আয়াত-১,২,৩,৪) এখানে ভাব প্রকাশ বলতে প্রত্যেক ব্যক্তির মাতৃভাষাকে বুঝানো হয়েছে, যা বিশেষ শিক্ষা গ্রহণ ছাড়াই প্রত্যেক ব্যক্তি নিজে নিজেই বলতে পারে এবং নিজের মনের ভাবকে প্রকাশ করতে পারে। ভাষা মনের ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম। ভাষা মানবজাতির মৌলিক অধিকার। পৃথিবীর সকল প্রাণীরই নিজস্ব ভাষা আছে। সকল প্রাণীই তার মনের ভাব প্রকাশের জন্য ধ্বনি বা আওয়াজ দিয়ে থাকে। মানুষ ব্যতিত অন্যান্য প্রাণীর মুখ-নিঃসৃত শব্দ আমরা বুঝতে পারি না। তারা নিজেরা পর¯পরের ভাষা বুঝতে পারে। মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশের জন্য যে ধ্বনি ব্যবহার করে তার নামই ভাষা। পৃথিবীর একেক স্থানের মানুষের মনের ভাব প্রকাশের ভাষা একেক রকম। আরবি, ফার্সি, উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি, তার্কি, বাংলা ইত্যাদি ভাষায় মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করে। আল্লাহ তা’লা তার কুদরত প্রদর্শনের জন্যই তিনি বৈচিত্রময় সুন্দর এই পৃথিবী, বিভিন্ন বর্ণে-গোত্রে বিভক্ত মানুষ ও ভাষার সৃষ্টি করেছেন। এ স¤পর্কে আল্লাহ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে ঘোষণা করেছেন : “এবং তাঁর (আল্লাহর কুদরতের) নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশমন্ডলী ও যমীনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।” (সূরা রুম- ২২)
বিশ্বজগতে আল্লাহ তা’লা যত পয়গাম্বর প্রেরণ করেছেন সবাইকে স্বজাতির ভাষাবাসী করে পাটিয়েছেন, যাতে তাঁরা মানুষকে আল্লাহর বিধান সহজভাবে বুঝাতে পারেন। এবং মানুষ আল্লাহর বিধানকে সঠিকভাবে বুঝতে পারে। আল্লাহ তা’লা মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে ইরশাদ করেছেন : “আমি কোন নবীই পাঠাইনি, যে তাঁর (মাতৃ) ভাষায় (আমার বাণী মানুষের কাছে পৌছায় নি), যাতে করে সে (আমার আয়াত) স্পষ্ট করে দিতে পারে।” (সূরা ইব্রাহীম, আয়াত- ৪)। মাতৃভাষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ এর দ্বারাই স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়, যে স্বয়ং আল্লাহ পৃথিবীতে তার দূত প্রেরণ করেছেন স্বজাতির ভাষাবাসী করে। অতএব, প্রত্যেক মানুষের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা কর্তব্য। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। মাতৃভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। বাঙালি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশ হলো বাংলা ভাষা। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা আজ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা। পৃথিবীর প্রায় সহস্রাধিক ভাষার মধ্যে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার স্থান ষষ্ট। ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দানের জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি, সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ স্বীকার করেছি, যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ও অনন্য ঘটনা।
প্রত্যেক সংস্কৃতির ভিত্তি হচ্ছে ভাষা। জাতি-বর্ণ, শ্রেণীভেদে ভাষা সকলকে একত্রীভূত করে। ভাষার মাধ্যমেই সংস্কৃতি প্রস্ফুটিত হয়। ভাষা হচ্ছে সমাজ কাঠামোর অত্যন্ত প্রয়োজনীয় দিক। ভাষা হচ্ছে সকলের অস্তিত্বের ভিত্তিস্বরূপ এবং চেতনার বাহনস্বরূপ। ভাষার মাধ্যমেই মানুষ সাংস্কৃতিক শিক্ষা অর্জন করে এবং সমাজজীবনে এর প্রতিফলন ঘটায়। বাঙালি জাতিস্বত্তা বিকাশের প্রথম অভিব্যক্তি ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় সেই দিনের বাঙালিদের আত্মত্যাগ যথার্থই অতুলনীয়। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এটি মহান ভাষা আন্দোলন নামে খ্যাত। বাংলার ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বড়ই ঘটনাবহুল। কারণ একটি দেশের জনগণের মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে ভিন্নদেশের ভাষাকে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাঙালিরা রুখে দাড়িয়েছিল। এর নজির পৃথিবীর ইতিহাসে খুবই বিরল। ১৯৪৭ সালে ধর্মের উপর ভিত্তি করে ভারতবর্ষ দুই ভাগে ভাগ হয়ে পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান হলো। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অন্যতম নায়ক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই বাঙালি জাতিকে বিলুপ্ত করার মানসে তাদের উপর চাপিয়ে দিলেন উর্দু ভাষা। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে নাগরিক সংবর্ধণা সমাবেশে তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে উপেক্ষা করে ঘোষণা করনেল- ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ কিন্তু বাঙালি জাতি বজ্রকন্ঠে তার প্রতিবাদ জানাল। বাঙালি জাতির মাতৃভাষা হলো বাংলা ভাষা। আর এ ভাষার স্বধীনতা ও মর্যাদা যদি না থাকে, তাহলে তাদের স্বাধীনতা ও মর্যাদার মূল্য কতটুকু সমাজে থাকবে, তা বাঙালির অনুমেয় ছিল। তাই বাঙালি জাতি মাতৃভাষার মর্যাদা দিতে গিয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আন্দোলনের ধারাবহিকতায় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি সমগ্র পূর্ব বাংলায় ধর্মঘট, সভা ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠানের আহবান জানায়। তৎকালীন সরকার ২১ ফেব্রæয়ারির কর্মসূচী বানচালের উদ্দেশ্যে ২০ ফেব্রæয়ারি থেকে ঢাকায় দীর্ঘ এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করেন। এর ফলে ছাত্র জনতা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্ররা এক বৈঠকে সমবেত হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ২১ ফেব্রæয়ারিকে রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালনের ডাক দেয়। ছাত্র সমাজ ১৪৪ ধারা লংঘন করে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই এই শ্লোগান দিতে দিতে রাজপথে নেমে পড়ে। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের নিকট পৌছালে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর লেলিয়ে দেয়া পুলিশ বাহিনী উক্ত মিছিলে গুলি বর্ষণ করে। ঢাকার রাজপথ সঙ্গে সঙ্গে রক্তে লাল হয়ে উঠে এবং শহীদ হন বরকত, সালাম, রফিক, জবাবর, শফিউরসহ নাম না জানা অনেকে।
এই বর্বরোচিত ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে পূর্ব বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবীসহ সকল স্তরের মানুষ প্রচÐ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ২২ ফেব্রæয়ারি ঢাকা শহরে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ধর্মঘট পালিত হয়। বহু ছাত্র শিক্ষক, জননেতা গ্রেফতার হন। সর্বত্র ব্যাপক ধর পাকড় শুরু হয়। মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় সেই দিনের বাঙালিদের আত্মত্যাগ যথার্থই অতুলনীয়। অবশেষে বাংলার সর্বস্থরের জনতার আন্দোলনের তোপের মুখে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন নিজেই প্রাদেশিক পরিষদে রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে প্রস্তাব উপস্থাপন করেন এবং তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। বাঙালি জাতির স্বাধিকার ও সংস্কৃতি রক্ষায় ইতিহাসে এ আন্দোলন ‘মহান ভাষা আন্দোলন’ নামে খ্যাত।
মাতৃভাষা মায়ের মত। আর এই মাতৃভাষাকে যারা কেড়ে নিতে চায়, রক্তের বিনিময়ে হলেও তাদের প্রতিহত করতে হয়। তারই ইতিহাস গড়েছিলেন বাংলার ভাষা সৈনিকরা। আমাদের গৌরভ গাঁথা এই ইতিহাসটিকে শুধু আমরা নই, বিশ্ববাসীও যথাযত মর্যাদার সহিত পালন করে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে। ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ ইউনেস্কোর ৩০তম অধিবেশনে একুশে ফেব্রæয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২১ ফেব্রæয়ারি ২০০০ থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর অনেকেই যথাযথ মর্যাদায় পালন করছে। প্রতি বছর ২১ ফেব্রæয়ারি আমরা হৃদয়ের সমস্ত শুভ্রতা উৎসারিত করে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি আমাদের ভাষা শহীদদের । শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আমরা গর্বিত জাতি। আমরা গর্বিত আমাদের মাতৃভাষার জন্য। শহীদরা আমাদের পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের সম্মান জনক স্থানে। সার্থক হয়েছে তাঁদের রক্তদান। মহান প্রভুর দরবারে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি এই জন্য যে, তিনি তাঁর অপার মহিমায় আমাদেরকে মাতৃভাষা দান করেছেন, যার দ্বারা আমরা পরস্পরের কাছে সহজেই মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।