পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার : দেশে শুরু হয়েছে নতুন সংস্কৃতি। কর্পোরেট হাউজ ব্যবসা ও স্পন্সর সংস্কৃতি। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে হৃদয়ে ধারণ করা জাতীয় দিবসগুলোও পালন করতে আমরা অভ্যস্ত। কয়েক বছর থেকে সংস্কৃতিসেবী নামের কিছু ধুরন্ধর দেশের কর্পোরেট হাউজ, দেশী-বিদেশী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও স্পন্সরের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে ‘জাতীয় দিবস’ পালনের মাধ্যমে তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থকে গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোতে সে অনুষ্ঠান প্রচার করায় দেশপ্রেমের চেতনা ধারণের চেয়ে পণ্যের প্রচার হচ্ছে বেশি। এতে ম্লান হচ্ছে আমজনতার হৃদয়ে ধারণ করা দেশপ্রেমের ভাবনা। নতুন প্রজন্ম নিখাদ দেশপ্রেমের বদলে পাচ্ছে ভুল বার্তা। ফলে জাতীয় দিবসকে পুঁজি করে দেশপ্রেমকে বাণিজ্যিকীকরণ করায় ওইসব ব্যক্তির দেশপ্রেম ও নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। মা-বাবা ও বড়দের যা করতে দেখে, তারা সেটাই শেখে। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। নতুন এই প্রজন্ম একদিন দেশ চালাবে। অথচ এই শিশুরা দেশপ্রেমের নামে কী দেখছে? স্পন্সর আর কর্পোরেট হাউজের সহায়তায় ২১ ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস উদযাপনের মাধ্যমে তাদের কী শেখানো হচ্ছে? ইদানীং দেখা যায়, বিভিন্ন কর্পোরেট হাউজ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিশেষ বিশেষ জাতীয় দিবসগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা করে। ব্যবসায়িক ধান্ধা থেকে কর্পোরেট হাউজের অর্থের ঝনঝনানিতে স্কুলপড়–য়া শিশুরা নিজের জমানো টাকায় ফুল-কাগজ-মোম কিনে একুশে ফেব্রুয়ারি-স্বাধীনতা দিবস-বিজয় দিবস উদযাপন করার রেওয়াজ ভুলতে বসেছে। দেশপ্রেমে উদ্বুব্ধ হয়ে ত্যাগের মহিমায় বিশেষ দিবস পালনের জায়গা দখল করে নিচ্ছে ব্যবসায়িক চিন্তাচেতনা। মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন বিশেষ জাতীয় দিবসগুলো পালন নিয়েও যেন বাণিজ্য হচ্ছে।
ভোগবাদী বুর্জোয়া রাজনীতি আর মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে দেশপ্রেমকেও বাণিজ্যিকীকরণের ফাঁদে টেনে নেয়া হচ্ছে। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উদযাপনে একটি মোমবাতি জ্বালালেও এখন স্পন্সর খোঁজা হয়। পোস্টার-ব্যানারে জাতীয় দিবস ও দেশের কৃতী সন্তানদের নামের পাশে স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের নামও শোভা পায়। জাতীয় দিবসে অর্থলগ্নি করে এটাই তাদের পণ্যের প্রচারণা। মানুষের হৃদয় থেকে উঠে আসা ভালোবাসা আর দেশমাতৃকায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের দামাল ছেলেরা ’৭১-এ যুদ্ধে গেছেন; দিনের পর দিন গ্রামের মা-বোনেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজে কম খেয়ে ৯ মাস মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের পথখরচের জন্য হাতের বালা, গলার হার নিঃশব্দে তুলে দিয়েছেন। সেই দেশপ্রেম আজ কোথায়? কর্পোরেট হাউজের অর্থের বিনিময়ে জাতীয় দিবসগুলোতে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমের নামে কী শেখাচ্ছি? গ্রিনেস বুকে নাম লেখানোর জন্য কর্পোরেট হাউজ ও ব্যবসায়িক কিছু প্রতিষ্ঠানের অর্থে মানবপতাকা থেকে শুরু করে স্বাধীনতা দিবসের রাতে মোমবাতি জ্বালানো পর্যন্ত সবকিছুই করা হচ্ছে স্পন্সর দিয়ে। স্পন্সরের মাধ্যমে দেশপ্রেমের এই বাণিজ্যিকীকরণ কেন? প্রসঙ্গক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক জানালেন, শাহবাগ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক এবং অন্যান্য প্রায় সব অনুষ্ঠান হয় স্পন্সরের মাধ্যমে।
রাজনীতিক, কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী, সাংস্কৃতিসেবীসহ সরকারি চাকুরেদের মুখে প্রায়ই শোনা যায় দেশপ্রেমের কথা। জনগণকে শোনান তারা দেশকে ভালোবাসেন। এই দেশপ্রেমের সংজ্ঞা কী? জাতীয় দিবসে কর্পোরেট হাউজের অর্থে বড় অনুষ্ঠান করা এবং স্পন্সরের মাধ্যমে দেশকে ভালোবাসাই কি দেশপ্রেম? নাকি এর সংজ্ঞা ভালোবাসার থেকে আরও বেশি কিছু? মুক্তিযুদ্ধের ৭ বীরশ্রেষ্ঠ, ৬৮ বীর-উত্তম, ১৭৫ বীরবিক্রম, ৪২৬ বীরপ্রতীক তাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে দেশকে ভালোবাসার নিদর্শন দিয়ে গেছেন। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর সেই দেশপ্রেম নিয়ে আমরা বাণিজ্য করছি? সমতা, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার Ñ এই তিনটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এখন যেন ‘চেতনা’ হয়ে গেছে ‘আমাকে দাও, আমি খাব এবং ওদের ভাগও খাব!’
ছোট্ট দুটি ঘটনা। ১. কয়েকদিন আগে দেশের জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে খবর বের হয়েছিল ‘খ্যাপা কবি নির্মলেন্দু গুণ’। খবরটি এমন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসংখ্য কবিতা লেখায় নির্মলেন্দু গুণ ২০১৬ সালের স্বাধীনতা পুরস্কার প্রত্যাশী। ধারণা ছিল তিনি অবশ্যই পুরস্কার পাবেন। অথচ স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্তদের নামের তালিকায় তার নাম নেই! এজন্য ক্ষেপে গিয়ে কবি গুণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর ওপর অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তার দাবি, তিনি অনেক কিছু করছেন; তিনিই স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য, অথচ তাকে দেয়া হচ্ছে না। সরকারের নীতিনির্ধারকদের ওপর ক্ষেপে গিয়ে তিনি অপ্রিয় সত্য কথা বলেছেন যে স্বাধীনতা পুরস্কারের প্রবর্তক জিয়াউর রহমান ইত্যাদি ইত্যাদি...। কবির এই ক্ষেপে যাওয়ার পর অবশ্য তার নাম স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় ওঠে। পুরস্কার পেয়ে মহাখুশি কবি! ২. বাংলাদেশের রাজনীতির জীবন্তকিংবদন্তি ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ব্যক্তিগত জীবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের যে ৬ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয় তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক করে গঠিত ওই উপদেষ্টা কমিটিতে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ছাড়াও অন্যান্য সদস্য হলেন Ñ মজলুন জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, কমরেড মণি সিংহ, মনোরঞ্জন ধর ও খোন্দকার মোশতাক আহমদ। ৯৪ বছর বয়স্ক প্রবীণ এই রাজনীতিককে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার-২০১৫’ দেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ সবিনয়ে তা নিতে অস্বীকার করেন। তার মত হলো, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। রাজনীতির অর্থ দেশসেবা, মানুষের সেবা। পুরস্কার, মন্ত্রিত্ব, পদ-পদবির জন্য রাজনীতি করি না। পদক দিলে বা নিলেই মানুষ সম্মানিত হয়। আমি তো পদকের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি। অধ্যাপক মোজাফ্ফর ও কবি নির্মলেন্দু গুণের মধ্যে কার দেশপ্রেম কেমন সে বিচারের ভার পাঠকের। কিন্তু দেশপ্রেমের নামে এসব কী দেখছি?
দেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষ মানেন এবং জানেন মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ সুবিধা ও সরকারি চাকরিতে বয়স বৃদ্ধির কারণে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। জাল সার্টিফিকেট দিয়ে সচিব হয়েছেন, পদোন্নতি নিয়েছেন, অতঃপর সে সার্টিফিকেট জাল প্রমাণিত হওয়ায় চাকরি হারিয়েছেন ৬ জন সচিব, এ খবর পুরনো। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করলেও আর্থিক লাভালাভের প্রচলন করায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়ছে, যার কারণে ৪৪ বছরেও মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল তালিকা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। কয়েক বছর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের বিশেষ সুবিধা দেয়ায় ‘মুক্তিযুদ্ধের ভুয়া সার্টিফিকেটের ভয়াবহতা’ আরো বাড়ছে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সরকারি চাকুরে, বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের শিক্ষকরা মুক্তিযুদ্ধের ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরির বয়স বাড়িয়েছেন। অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন, আবার অনেকের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। স্বাধীনতা অর্জনের ৪৪ বছর পরও এখনো সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা ১০ শতাংশ, উপজাতি ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ০১ শতাংশ সর্বমোট ৫৬ শতাংশ। বাকি থাকে ৪৪ শতাংশ। ফলে সাধারণ ঘরের মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন ছেলেমেয়েরা কোটার কারণে চাকরি পাচ্ছেন না। অথচ মুক্তিযোদ্ধার কোটা পূরণ না হওয়ায় আসন খালি থাকছে। এই সুযোগে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়ে (মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট জাল করে) চাকরি নেয়ার চেষ্টা হচ্ছে এবং ধরাও পড়ছে। রাষ্ট্রের কিছু ব্যক্তির জন্য ৫৬ শতাংশ রিজার্ভ আর সাধারণ মানুষের সন্তানদের জন্য মাত্র ৪৪ কোটা সরকারি চাকরির প্রচলনের কারণে প্রশাসনের মেধাবী কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমছে। মুক্তিযোদ্ধারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ করলে তাদের সন্তানরা সরকারি চাকরির কোটা পাবেন, এমন চিন্তা তাদের মাথায় ছিল না। তাহলে দেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ ও দেশপ্রেমকে কি অবজ্ঞা করা হচ্ছে না? ইদানীং প্রজন্ম লীগ, প্রজন্ম ’৭১ মুক্তিযুদ্ধের সন্তান ইত্যাদি নামে ভুঁইফোঁড় সংগঠন গড়ে উঠেছে। এসব সংগঠনের নেতারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পিতা-মাতার নাম ভাঙিয়ে তদবির বাণিজ্য করছে। পিতার দেশপ্রেমকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে তারা কি তাদের জন্মদাতাকে অপমান করছেন না? কিছুদিন আগে সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এক টকশোতে বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধকে বাণিজ্যিকীকরণ করায় এমন হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ দেশপ্রেম ইত্যাদি বিষয়কে বাণিজ্যিকীকরণ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। দেশপ্রেমের এই বাণিজ্যিকীকরণের কারণে বন্যা-জলোচ্ছ্বাস-নদীভাঙা মানুষের আহাজারি শুনলেও ত্রাণ নিয়ে ছুটে যায় না তরুণ প্রজন্ম, কারণ তারা দেখছে দেশপ্রেম মানেই বাণিজ্য।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।