পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টাফ রিপোর্টার : বাংলাদেশের সংবিধানে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বহাল থাকছে। সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২৮ বছর আগের রিট গতকাল সোমবার খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি নাঈমা হায়দার, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ রিট খারিজের আদেশ দেন। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংক্রান্ত রিটকারীদের আবেদনের ‘অধিকার’ (লোকাস স্টান্ডি) নেই বলে আদেশে উল্লেখ করেছেন আদালত। ফলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম বহাল রইল বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। ২৮ বছর আগে ১৫ বিশিষ্টজনের করা একটি রিট আবেদনের ২৩ বছর পর রুল জারি করা হয়। আর রুল জারির প্রায় ৫ বছর পরে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রুল শুনানির দিন ধার্য হয় ২৭ মার্চ। পরে একদিন পিছিয়ে রুল শুনানির জন্য ২৮ মার্চের কার্যতালিকায় আসে রিট আবেদনটি। গতকাল আবেদনটির নিষ্পত্তি করে দেয় আদালত।
রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা বলেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংক্রান্ত রিট আবেদন করার ‘অধিকার’ (লোকাস স্টান্ডি) নেই মর্মে খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। এ রায়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম ধর্ম বহাল থাকার পাশাপাশি অন্য ধর্মের অধিকারও বহাল থাকলো। এটা সংবিধানেও রয়েছে। অপরদিকে রিটাকারীর আইনজীবী জানিয়েছেন, আমরা পূর্ণাঙ্গ রায় দেখবো, কেন খারিজ হয়েছে। এরপর আপিল করবো। এদিকে আদালতে রায়ের পর হেফাজত ইসলামের নেতৃবৃন্দরা এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এতে ইসলামের বিজয় হয়েছে।
আদালতে রিট আবেদনকারীদের পক্ষে আইনজীবী জগলুল হায়দার আফ্রিক ও সুব্রত চৌধুরী এবং রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা উপস্থিত ছিলেন। এসময় অর্ধশতাধিক আইনজীবী, সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।
শুনানি ও আদেশে : বেলা ২টায় ১২ মিনিটি এজলাসে আসেন তিন সদস্যের বিশেষ বেঞ্চ। এরপর চলে আসে কোর্টে ভিতর পিনপন নিরবতা। শুরুতে রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা আদালতকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এটা অনেক আগের মামলা। দু’টি রুল হয়েছে। অনেক পুরনো ম্যাটার। ১৯৮৮ সালের রিট। পরে দু’টি সম্পূরক আবেদনের রুল। এজন্য আমাদের কিছু সময়ের প্রয়োজন। এ সময় আদালত বলেন, ঠিক আছে, আপনি বসেন। আগে আমরা আবেদনকারীর আইনজীবীকে শুনবো। এরপর সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি টিএইচ খান, এবিএম নুরুল ইসলামসহ কয়েকজন আইনজীবী রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম ধর্ম বহালের পক্ষে পক্ষভুক্ত হওয়ার আবেদন নিয়ে দাঁড়ান। কিন্তু আদালত বলেন, আপনারা এখন বসেন। এখনো শুনানিই শুরু হয়নি। আগে রিট আবেদনের আইনজীবীকে শুনবো। পরে পক্ষভুক্ত হওয়ার বিষয়। এ সময় আদালত আবেদনকারীদের আইনজীবী সুব্রত চৌধুরীকে বলেন, আপনাকে আমরা দেখে আসতে বলেছিলাম ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির’ পক্ষে এ রিটটি দায়েরের লোকাস স্ট্যান্ডি (রিট করার এখতিয়ার) ছিলো কি? জবাবে সুব্রত চৌধুরী বলেন, সংগঠন ছাড়াও আলাদা আলাদাভাবে প্রত্যেকে রিটে বাদী হয়েছেন। আদালত বলেন, আমারা দেখছি, ওই সংগঠনটির পক্ষে রিট আবেদন করা হয়েছে। তখন সুব্রত চৌধুরী বলেন, শুনানির সময় আমরা বিস্তারিত বলবো। সন্তোষজনক জবাব দেবো। আদালত বলেন, ওই সংগঠনের লোকাস স্ট্যান্ডি নাই। রিট খারিজ, রুল ডিসচার্জ।
এদিকে রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা অ্যার্টনী জেনারেলের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এ রায়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম ধর্ম বহাল থাকার পাশাপাশি অন্য ধর্মের অধিকারও বহাল থাকলো। এটা সংবিধানেও রয়েছে। তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংক্রান্ত রিট আবেদন করার ‘অধিকার’ (লোকাস স্টান্ডি) নেই মর্মে খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। তিনি বলেন, রিটটি দায়ের করা হয়েছিল স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির পক্ষ থেকে। ওই কমিটির কোনো আইনি ভিত্তি নেই। ফলে এটি গ্রহণযোগ্য নয় মনে করেই আদালত খারিজ করে দিয়েছেন। আমি মনে করি, আদালত সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির’ পক্ষে তারা প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তারা ব্যক্তিগতভাবে রিট করেনি। শুনানির আগে আদালত মামলার মেইনটেইনয়ে বিলি দেখেন তারপর শুনানি করেন।
রিট খারিজের পর জগলুল হায়দার আফ্রিক এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আদালত রিটের বিষয়ে আমাদের কোনো জবাব গ্রহণ করেননি। আমরা আদালতকে বলেছি রিটের স্বপক্ষে আমাদের জোরালো যুক্তি রয়েছে। কিন্তু আদালত আমাদের কোনো জবাব গ্রহণ না করেই আবেদনটি খারিজ করে দেন। যা দুর্ভাগ্যজনক।
মামলা বিবরণ থেকে জানা যায়, রিট মামলটি করা হয়েছিলো ১৯৮৮ সালে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে অন্তর্ভুক্তির বিধান করার পর। স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’র পক্ষে রিটকারী ১৫ বিশিষ্টজনের মধ্যে অনেকে ইতোমধ্যে মারা গেছেন। ১৯৮৮ সালের ৫ জুন সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে জাতীয় সংসদে অষ্টম সংশোধনী অনুমোদন হয়। একই বছরের ০৯ জুন এতে অনুমোদন দেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদ। এর মাধ্যমে সংবিধানে অনুচ্ছেদ ২-এর পর ২(ক) যুক্ত করা হয়। যাতে বলা হয়, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে। এ বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৮৮ সালে ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’র পক্ষে রিটটি (নম্বর ১৪৩৪/১৯৮৮) দায়ের করেন বরেণ্য ১৫ জন ব্যক্তি। তাদের মধ্যে ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, কবি সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, সাবেক বিচারপতি কেএম সোবহান, অধ্যাপক খান সরওয়ার মুর্শিদ, আইনজীবী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফী, অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন, মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্ত, বদরুদ্দীন উমর, সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আবেদনকারীদের মধ্যে প্রথম ১০ জনই মারা গেছেন। বেঁচে থাকা শেষ পাঁচজনের অন্যতম বদরুদ্দীন উমর সোমবার হাইকোর্টে রিটের বিষয়ে আগে রোববার সন্ধ্যায় গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে রিট থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেন বদরুদ্দীন উমর।
এ রিট দায়েরের দীর্ঘ ২৩ বছর পর ২০১১ সালের ৮ জুন একটি সম্পূরক আবেদন করা হয়। ওইদিনই বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি করেন। পাশাপাশি শুনানির জন্য অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ১৪ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে নিয়োগ দেয়া হয়। তারা হলেনÑ টিএইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ড. এম জহির, মাহমুদুল ইসলাম, এএফ হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিস্টার আখতার ইমাম, ফিদা এম কামাল, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি, আবদুল মতিন খসরু, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, এএফএম মেসবাহ উদ্দিন। তাদের মধ্যে ড. এম জহির ও মাহমুদুল ইসলাম ইন্তেকাল করেছেন।
এ রুল জারির কিছুদিন পর একই বছরের ২৫ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী করা হয়। এতে ২ অনুচ্ছেদ আবারও সংশোধন করা হয়। সংশোধনীতে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করবে। এ সংশোধনীর পর আবারো সম্পূরক আবেদন করা হয়। এ আবেদনের পর ২০১১ সালের ০১ ডিসেম্বর হাইকোর্টের একই বেঞ্চ সম্পূরক রুল জারি করেন। এরপর এ রুলের ওপর হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চে শুনানির জন্য গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর আবেদন করেন রিট আবেদনকারীপক্ষ। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে বিষয়টি সোমবার হাইকোর্টে শুনানির জন্য ওঠে।
হেফাজতের স্মারকলিপি
এর আগে সকালে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার কাছে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখার দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান করে হেফাজতে ইসলাম। বেলা পৌনে ১১টার দিকে হেফাজতে ইসলাম ঢাকা মহানগরের যুগ্ম সদস্য সচিব মাওলানা ফজলুল করিম কাশেমীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের জেনারেলের একান্ত সচিব আতিকুস সামাদের নিকট এ স্মারকলিপি দিয়ে এসেছেন। এসময় হেফাজত নেতা মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী, মুফতি ফখরুল ইসলাম, ইঞ্জিনিয়ার হাদী ও মাওলানা ফয়সাল আহমদ উপস্থিত ছিলেন।
ইসলামের বিজয় হয়েছে -হেফাজত
আদালতে রায়ের প্রতিক্রিয়ায় হেফাজত ইসলাম নেতৃবৃন্দরা বলেন, ইসলামের বিজয় হয়েছে। বাংলাদেশের ৯৮ ভাগ লোক ইসলাম ধর্মের অনুসারী। এমন দেশে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম না রাখা অবাঞ্ছনীয়। তাই আদালত মুসলমানদের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে রিট খারিজের যে রায় দিয়েছেন তাতে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম ধর্মের বিজয় হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে হেফাজত ইসলাম। রায়ের পর সুপ্রিমকোর্ট অ্যানেক্স ভবনের সামনে এক প্রতিক্রিয়ার সাংবাদিকদের হেফাজত ইসলামের ঢাকা মহানগর যুগ্ম-মহাসচিব ফজলুল করিম কাশেমি বলেন, আদালতের মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে সম্মান দেখানো হয়েছে। একইসঙ্গে মিডিয়া এবং সকল মুসলিমকে ধন্যবাদ যারা এই আন্দোলনে আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আজকের রায়ের পর পূর্বের মত সকল অহিংস পথ পরিহার করে আমরা সামাজিক, পারিবারিকভাবে সকল ধর্মের সকলে মিলেমিশে বসবাস করবো বলে প্রত্যাশা করছি। কাশেমি বলেন, কোনো অপশক্তি পারবে না ইসলামকে প্রতিহত করতে। আদালত ন্যায় বিচার করেছে। এর ফলে বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামের বিজয় হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।