Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সেনাপতি উকবার নির্দেশে আফ্রিকার অরণ্যের হিংস্র জীব-জন্তু সরে যায়

কে. এস. সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

‘ইয়ারাব্বি, লাওলা হাজাল বাহ্রু লামাশতু ফিল- বালাদি মোজাহেদান ফিসাবিলিকা’। অর্থাৎ হে রব, আমার সামনে যদি সাগর না থাকতো তাহলে আমি তোমার পথে তাওহীদের দাওয়াত পৌঁছানোর জন্য যুদ্ধ করতে করতে বিজয়ী বেশে এই দেশের প্রান্ত সীমায় উপনীত হয়ে যেতাম।
ইসলামের বীর মোজাহেদ আফ্রিকা বিজেতা হজরত উকবা ইবনে নাফে (রা.)-এর এই অনুতাপ ইসলামী ইতিহাসের বিখ্যাত বিজয়বার্তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আটলান্টিক মহাসাগর প্রতিবন্ধক না হলে সেনাপতি উকবা সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশ মুসলিম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতেন। তিনি গোটা মরক্কো জয় করে সাগর তীরের বার্লিয়ান নামক স্থানে পৌঁছে অত্যন্ত অনুতাপের সাথে কথাগুলো বলেছিলেন।
হজরত উকবা ইবনে নাফে ফেহরী (রা.) ছিলেন একজন কোরেশ বংশীয় তাবেঈ। কেউ কেউ তাকে সাহাবী বলেছেন। তিনি হিজরী ৫২ সালে হজরত আমীর মোআ’বিয়া (রা.) কর্তৃক আফ্রিকার গভর্ণর নিযুক্ত হন। আফ্রিকা জয় করার জন্য তাকে দশ হাজার সৈন্যসহ প্রেরণ করা হয়। উকবা দ্রুত ত্রিপলির মধ্যভাগের দিকে অগ্রসর হন এবং বর্বর জাতিগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিরোধী শক্তিগুলো কিছুক্ষণ বীরত্বের সাথে লড়লেও অবশেষে পরাজয় বরণ করে। তাদের নিয়ম ছিল পরাজিত হবার সাথে সাথে বিজয়ী শক্তির কাছে আনুগত্য স্বীকার করে নিতো, এমনকি ইসলামও গ্রহণ করতো। মুসলিম বাহিনী প্রস্থান করা মাত্র তারা আবার বিদ্রোহ করতো এবং মোরতাদ হয়ে যেত। এ কারণে হজরত উকবা সে এলাকায় স্থায়ীভাবে ইসলামী লস্করের অবস্থানের ব্যবস্থা করেন এবং একটি নতুন শহর গড়ে তোলেন এবং কায়রো শহরেরও ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।
স্থানটি ছিল গহীন জঙ্গলে পরিপূর্ণ সর্বপ্রকারের ক্ষতিকর, বিষাক্ত, হিংস্র জীবজন্তু এবং কীট-পতঙ্গে ভরা। জীবিত হিংস্র সিংহ-বাঘ ইত্যাদি চতুষ্পদ এবং সাপ-অজগর বিচ্চুর বিচরণ ক্ষেত্র এ ভয়ানক ভীতিকর স্থানে মানুষের চলাচল ছিল না, প্রাণের ভয়ে তারা সেখান থেকে দূরে অবস্থান করতো। হজরত উকবা (রা.) ছিলেন অত্যন্ত খোদাপ্রেমিক সাধক ব্যক্তিত্ব এবং বিখ্যাত মোস্তাজাবুত দাওয়াত, তিনি দো’আ করলে তা কবুল হতো। এ ভীতিকর স্থানে তিনি অতি বিনয়ের সাথে এসব হিংস্র জীবজন্তু, কীট-পতঙ্গ দূর করে দেয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে দো’আ করলেন, ‘আইয়্যুহাল হিয়াদা ওয়াস-সিবা! ইন্না আস্হাবু রাসূলুলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। ইরহালুআল্লা, ফা ইন্না নাজেলুন। ওয়া মান-ওয়াজ নাহু বা’দা জালিকা কাতাল্লাহু। অর্থাৎ এই অরণ্যে বিচ্ছিন্নভাবে বিচরণকারী হিংস্র হে জন্তুকূল, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (স.) এর সাহাবা, তোমরা আমাদের কাছ থেকে দূরে চলে যাও। আমরা এখানে অবতরণ করবো। এ ঘোষণার পর যাকে এখানে আমরা পাবো তাকে হত্যা করবো।
হজরত উকবা (রা.)-এর মর্মস্পর্শী ঘোষণা বিদ্যুৎ গতিতে সমগ্র জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়ে এবং সকল চতুষ্পদ জীব-জন্তু, কীট-পতঙ্গ, সাপ-অজগর প্রভৃতি তাদের বাচ্চা-ছা পোনা সকলকে নিজ নিজ কাঁধে উঠিয়ে প্রস্থান করতে থাকে এবং অবস্থান কেন্দ্রগুলো খালি করতে থাকে। এবং সাপ-বিচ্চুসহ সকল বিষাক্ত জীব-কীট-পতঙ্গ মুহুর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। এ এক অদ্ভুত অভাবনীয় দৃশ্য। সেনাপতি হজরত উকবা (রা.)-এর দো’আ এইভাবে কবুল হতে দেখে সকলেই বিস্মিত। এ অপূর্ব দৃশ্য অবলোকন করে অধিকাংশ বর্বর জাতি স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে সাগ্রহে ইসলাম গ্রহণ করে। তারাও বলতে থাকে- আল-ইসলামু হাক্কুন, ওয়াল কোফরু বাতিলুন- ইসলমাই সত্য ধর্ম এবং কোফর বাতিল (অসত্য)। আর এ বর্বরগণও এ অরণ্য কাটতে, পরিষ্কার করতে এবং শহর নির্মাণে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। পরিণতিতে জামে মসজিদ ও হাজার হাজার বসতবাড়ী নির্মিত হয়ে যায়। শহর নির্মাণকালেও হজরত উকবা (রা.) এখানে সেখানে তাঁর বাহিনী প্রেরণ করতে থাকেন এবং শত্রুদের শক্তি চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে থাকেন। কায়রোওয়ান শহর নির্মিত হয়ে যাওয়ার ফলে আফ্রিকায় মুসলমানদের স্থায়ী সেনানিবাস স্থাপিত হয়ে যায়। আফ্রিকার ভয়ঙ্কর অরণ্যের হিংস্র জীব-জন্তু ও অধিবাসীরা হজরত উকবা (রা.) ঈমানী শক্তির ডাকে সাড়া দিয়ে জঙ্গল খালি করে সেখান থেকে চলে যাওয়ার ঘটনা আফ্রিকার ইতিহাসে অবিস্মরণীয় ও বিস্ময়কর বটে।
হজরত উকবা (রা.) এর পরবর্তী বিজয় অভিযানের পূর্বে হিজরী ৬২ সালে তিনি তাঁর আওলাদ-সন্তানদের সমবেত করে উপদেশ প্রদান করেন এবং বলেন, আমি নিজের প্রাণ আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করে দিয়েছি। আমি তাওহীদ অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো এবং এ পথে আমার প্রাণ দেব। অতঃপর কায়রোওয়ান শহরের নিরাপত্তা বিধানকল্পে জোহাইর ইবনে কাইস আল বালভীকে একটি বাহিনীসহ রেখে যাত্রা করেন, সঙ্গে ছিল আরব মোজাহেদীনের একটি ফেদায়ীন দল। এবার তাঁরা সাগরের পশ্চিম দিকে তিনি বাগানা শহরে রোমানদের এক বিশাল বাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তারা পালাতে শুরু করে। উকবা (রা.) তাদেরকে ধাওয়া করেন এবং পলায়নকালে হাজার হাজার রোমান সৈন্যকে হত্যা করা হয়। এ পরাজয়ের পর রোমানরা ‘আরবা’ নামক শহরে অবস্থান গ্রহণ করে। তারা যখন দেখলো যে, খ্রিস্টানরা আবাদী মুসলমানদের মোকাবিলায় টিকে থাকতে পারবে না তখন তারা বর্বরদেরকে তাদের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়। ওরা খ্রিস্টান ছিল না। এভাবে এক বিশাল বাহিনী গড়ে উঠে। এবার তারা মাত্র কয়েক হাজার মুসলমানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুসলমানদের নিশ্চিত পরাজয় অনুভব করেও বীর উকবা (রা.) বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না, কয়েক দিনের যুদ্ধের পর উকবার বাহিনী বীর বিক্রমে যুদ্ধ শুরু করে এবং শত্রæপক্ষকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে, তাদের হাজার হাজার সৈন্য হতাহত হয়। মুসলমানগণ বিপুল পরিমাণে ‘গণিমত’ লাভ করেন এবং তারা ‘তাঞ্জা’ শহর অধিকার করে সেখানেই অবস্থান করেন, সেখানে রোমান গভর্নর আত্মসমর্পণ করেন।
এ বিজয় অভিযানের পর উকবা (রা.) সেখানে অত্যন্ত সদাচরণ প্রদর্শন করেন এবং ‘তাঞ্জা’র কোনো প্রকারের ক্ষতি সাধন হতে বিরত থাকেন। উকবার ইচ্ছা ছিল, ইউরোপে কোরআন ও তাওহীদের বাণী প্রচার করা। তাই তিনি আত্মসমর্পণকারী রোমান গভর্নরকে স্পেনের অবস্থা জিজ্ঞাসা করেন। উক্ত গভর্নর বুঝতে পেরেছিলেন যে, স্পেন ইসলামী সয়লাব রোধ করতে সক্ষম হবে না, দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের পক্ষেও তা সম্ভব নয়।
হজরত উকবার দৃষ্টি স্পেনের দিক থেকে হটানোর জন্য উক্ত গভর্নর এই কৌশল অবলম্বন করেন যে, আল-জাজায়ের ও মরক্কোর বর্বর রাষ্ট্র অধিকার করার জন্য উকবাকে উৎসাহিত করেন এবং বলেন যে, সেখানকার অধিবাসীরা কাফের এখনো তারা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেনি। এ প্রস্তাবের সাথে সাথে তিনি এই ভয়ও প্রদর্শন করেন যে, তাদের সৈন্য সংখ্যা বিপুল, তার উদ্দেশ্য উকবা যেন সামনে অগ্রসর না হন। উকবা তো দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়ে বের হয়েছেন তাওহীদ অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তিনি যখন বর্বরদের কথা জানতে পারলেন, তখন আল জাজায়েরর দিকে অগ্রসর হলেন- এবং বিপুল সংখ্যক কাফেরকে হত্যা করার পর সূসুল আকসা-মরক্কোতে প্রবেশ করেন। সেখানে বিপুল সংখ্যক বর্বরদের মোকাবিলায় উকবার সৈন্য সংখ্যা অতি নগণ্য কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে মুসলমান গাজীদের তরবারি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত করেছে এবং বর্বর জাতি শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। তাদের বেশুমার নিহত হয়, অসংখ্য বন্দি হয় এবং বিপুল পরিমাণ গণিমতের মাল মোজাহেদীনের হস্তগত হয়। হজরত উকবা (রা.) কর্তৃক মরক্কো তথা আফ্রিকা বিজয়ের এটি সংক্ষিপ্ত কাহিনী।
মরক্কোর সকল এলাকা হজরত উকবা ইবনে নাফে ফেহরী (রা.) এর কব্জাগত হয়ে যাওয়ার পর তার দৃষ্টি ইউরোপের দিকে নিবদ্ধ হয়। তিনি আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে বালিয়ান নামক স্থানে উপনীত হন এবং সেখানে গিয়ে সাগরকে তাঁর চলার পথে কঠিন প্রতিবন্ধক পেয়ে দারুণভাবে ব্যথিত ও হতাশ হয়ে পড়েন। কথিত আছে, হজরত উকবা (রা.) তার পরবর্তী ইউরোপ বিজয়ের জন্য তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীকে সাগরে নামিয়ে দিয়েছিলেন। এ ঘটনার কথা স্মরণ করে আল্লামা ইকবাল বলেছিলেন:
‘সমন্দর মে দৌড়ে দিয়ে ঘোড়ে হামনে’
উকবা (রা.) চলার পথে এমন এক স্থানে পদার্পণ করেন যাকে বলা হয় মাউল ফারাস বা ঘোড়ার পানির কূপ। সেখানে পানির অভাব ছিল, লোকেরা পিপাসার তাড়নায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিল। হজরত উকবা (রা.) মুসলমানদের এ করুণ অবস্থায় দু’রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন এবং অত্যন্ত বিনয়ের সাথে আল্লাহর নিকট পানির জন্য প্রার্থনা করেন। তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর হয়। আল্লাহর পক্ষ হতে পানির ব্যবস্থা এমনভাবে হয় যে, ঘোড়াগুলো পদাঘাতে জমিনের পাদদেশে আর্দ্রতা দেখা দেয় এবং প্রবলবেগে পানি নির্গত হতে থাকে। হজরত উকবা (রা.) সেখানে গর্ত খনন করেন। মানুষ ও জীব-জন্তু পানি পান করে তৃপ্ত হতে থাকে। এ ক‚পের নাম হয়ে যায় ‘মাউল ফারাস।’
উকবা ইবনে নাফে ছিলেন শীর্ষস্থানীয় মুসলিম সেনাপতি এবং হজরত আমর ইবনুল আস (রা.) এর ভাগ্নে। তিনি মিসর বিজয়ী ও তার শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি উত্তর আফ্রিকা জয় করেন। মরক্কোর কায়রোওয়ান শহরের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে খ্যাত। তিনি বর্বর জাতিগুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করলেও তাদের আনুগত্য স্বীকারে সক্ষম হননি। তিনি সাহারা সীমান্তে হিজরী ৬৩/৬৮৩ সালে নিহত হন।
মুসলিম সেনাপতি হজরত উকবা ইবনে নাফে ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান হয়ে আল্লাহর পথে তাওহীদের প্রচারে তার জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। তার সামরিক জীবনের উদ্দেশ্যও ছিল তাই। তিনি আফ্রিকার যেখানে গমন করেছেন, সেখানে বিজয় সাফল্য তার কদম চুম্বন করেছে। তাঁর প্রার্থনা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছে। আফ্রিকার গহীন অরণ্যের সকল হিংস্র বিষাক্ত জীব-জন্তু তার আহ্বানে স্ব-স্ব স্থান ত্যাগ করে সরে গিয়েছে। তাঁর প্রার্থনায় পানির অভাব দূর হয়েছে। ‘মাউল ফারাস’ সৃষ্টি হয়েছে। এসব তাঁর জীবনের বিস্ময়কর ঘটনা, অপূর্ব কারামত। তার বিজয়মালাও আফ্রিকায় ইসলামের প্রচার-প্রসার তার অবিস্মরণীয় অবদান। আটলান্টিক প্রতিবন্ধক না হলে ইউরোপও তার বিজয় প্রচারের আওতায় এসে যেতো।



 

Show all comments
  • Purbasha ২৭ আগস্ট, ২০২০, ১০:৫৮ এএম says : 0
    জীবজন্তু ছোট করে নেই
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন