পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
আল্লাহর অসীম রহমতে পেশা ও দায়িত্বগত কারণে গত ৩৫ বছর ধরেই গোটা বাংলাদেশ আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি। ৬৪ জেলাই সড়ক পথে আমাকে বারবার পাড়ি দিতে হয়েছে। বাংলাদেশকে এতো কাছ থেকে নিবিষ্টচিত্তে দেখার এই সুযোগ পেয়ে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। যেহেতু এসব পথ আমাকে বহুবার পাড়ি দিতে হয়েছে তাই বাংলাদেশের বদলে যাওয়াটিও আমি খুব মনোযোগ দিয়ে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছি। শুরুতে যেসব পথে যেতাম, চারপাশে দেখতে পেতাম বেশ এলোমেলো গ্রামীণ পরিবেশ।
এরপর থেকে ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট। ঘরবাড়ি যেমন উন্নত হয়, রাস্তাঘাট বাড়তে থাকে। বিদ্যুৎ আসে। গড়ে ওঠে নতুন বাজার, দোকান-পাট। ধর্মীয় ও সামাজিক বিবর্তন আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে চোখে পড়ে। যেখানে দেখা যেতো ভাঙাচোরা মসজিদ, মক্তব ও মাদরাসা, সেখানে এখন খুব সুন্দর পরিপাটি পাকা ভবন। বিশেষ করে রাস্তার দু’ধারে সুন্দর সুন্দর মসজিদ। গ্রামের মানুষ মসজিদটিকে নিজেদের ঘরবাড়ির চেয়ে কমতো নয়ই পারলে আরও বেশি উন্নত ও সুন্দর করে বানায়। যদি আপনার কোনোসময় শুক্রবার বেলা বারটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত নিভৃত পল্লী বা গ্রামীণ জনপদে ভ্রমণের সুযোগ হয়ে থাকে, তাহলে আপনি দেখতে পাবেন জুমার নামাজের সংস্কৃতিতে কেমন নিমগ্ন থাকে গোটা বাংলাদেশ।
আজানের আগে থেকেই মসজিদগুলো যেন আবাদ হয়ে ওঠে। মাইকে যখন আজান হয়, তখন নানা কণ্ঠে, নানা উচ্চারণে জুমার আজান দীর্ঘ সময় ধরে আকাশ বাতাস মুখরিত করে রাখে। এই ঐশি ধ্বনি যেন জীবন জাগায় বাংলার ঘরে ঘরে। জাগিয়ে তোলে প্রাণ মানুষের অন্তরে। এরপর শিশু থেকে বৃদ্ধ, যুবক, তরুণ ছুটতে থাকে মসজিদের দিকে। বাংলা ওয়াজ ও বয়ান হয়। হয় আরবী খুতবা। নামাজ, যিকির ও মোনাজাত। জুমার ইমামগণ দেশের সব মানুষের মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী তাদের সকল জীবন-জিজ্ঞাসার জবাব তুলে ধরেন তাদের বয়ান ও খুতবায়। এ এক বিশাল যোগ্যতার ব্যাপার। জাতির মানস গঠনে ইমাম ও খতীবদের ভ‚মিকার কথা বলাই বাহুল্য। এক কথায় এর কোনো তুলনা নেই। ঠিক খুতবা শুরুর সময় হাইওয়ে ধরে ছুটে চলা প্রায় সকল গাড়ি নিকটের মসজিদে থেমে যায়। মুসল্লীরা কেবল জুমার জন্য থামলেও মোনাজাতে শরিক হন। এইযে, কিছু সময়ের জন্য গোটা জাতির আধ্যাত্মিক মনোনিবেশ, এটি বাংলাদেশের সমাজচিত্রের খুব ক্লোজ একটি দৃশ্য। ঘটনাটি যদিও কয়েক ঘণ্টার। ধরুন, সাড়ে এগার থেকে আড়াইটা। কিন্তু এই জুমার প্রভাব সারা সপ্তাহ কেবল নয় সারা বছর, এমনকি সারাটি জীবন বাংলাদেশের মুসলমানকে অনুপ্রাণিত করে।
শীত মৌসুমজুড়ে দেশব্যাপী চলে বিভিন্ন মাহফিল। নাম যদিও ভিন্ন হয়, যেমন তাফসির মাহফিল, ওয়াজ মাহফিল, মিলাদুন্নবী সা., সীরাত মাহফিল, ইসলামী সম্মেলন ইত্যাদি। অনেক পুরনো দরবার ও খানকায় হয় ইসালে সওয়াব মাহফিল। বিভিন্ন মসজিদ, মাদরাসা, সংগঠন ছাড়াও গ্রাম, পাড়া, মহল্লার উদ্যোগে হতে থাকে এসব মাহফিল। সারা দেশে যেসবের সংখ্যা লাখো লাখো। এতে কম করে হলেও ১০ কোটি মানুষ জড়িত থাকে। আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও ওয়ায়েজগণ, নারী-পুরুষসহ ৮/১০ কোটি শ্রোতার সাথে বছর ভরে যোগাযোগে থাকেন। এরচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী গণমাধ্যম আর কি হতে পারে। এসব মাহফিল মূলত মানুষের ঈমান-আকিদা, আমল-আখলাক নির্মাণ করলেও ধর্মীয় সংস্কৃতি ও চেতনা বিস্তারে এসবের গুরুত্বের কোনো সীমা নেই। দিনে দিনে এই ইসলামী মাহফিল বাংলার মানুষের চিরায়ত সংস্কৃতিতে রূপায়িত হয়েছে। একটি মাহফিলকে ঘিরে অর্থনীতিও কম বিকশিত হয় না। যেমন হয় পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের পুনর্গঠন। আত্মীয়তার সম্পর্ক দৃঢ় হয়। মা-বাবা ভাইবোনের পাশাপাশি চাচা-চাচি, মামা-মামি, খালা-খালু ও তাদের দ্বারা গঠিত ভাই-বেরাদরের মধ্যকার সম্পর্কগুলো নতুন প্রাণ লাভ করে। পশ্চিমা জগত যেসব থেকে প্রায় বঞ্চিত। ইসলাম যেসব খুব পছন্দ করে, বাংলার মুসলমান এই মাহফিল-সংস্কৃতির দ্বারা এসবের চর্চার সুযোগ পায়। মাহফিলগুলো সাজাতে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায়, এখানে কিছু লোকের রুটি রুজির ব্যাপারও থাকে। হয় মাইক ব্যবসায়ীদের আয়। যেমন পরিবহন, ডেকোরেশন, ছোট্ট দোকান ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবসা হয়। টাকা-পয়সা আয় হয় অনেক পেশাজীবিরও। আরও মজার ব্যাপার হলো, আগে যেমন বিভিন্ন পূজা-পার্বনে বা যাত্রা-হাউজি উপলক্ষে লোক সমাগম হলে মেলা বসতো। যেসবের অনুসঙ্গ হয়ে আসতো অসামাজিক কাজ, মাদক সেবন, অশ্লীল নৃত্যগীত ইত্যাদি। যেসব মেলাকে মানুষ নিষ্কলুষ মনে করতো না। এখন পবিত্র ধর্মীয় মাহফিলকে ঘিরে জমে উঠছে নির্দোষ মেলা। পিঠে-পুলি, সিঙ্গাড়া-সমোচা, আলু, পেয়াজু, বুট, মুড়ি যেমন আছে, তেমনই মেলার বিশেষ আয়োজন দেশজ মিষ্টি, জিলিপি, কদমা, গজা ইত্যাদির পসরা নিয়েও দোকানিরা মেলায় আসে। পাশাপাশি বাঁশ, কাঠ ও বেতের তৈরি ব্যবহারিক নানা বস্তু অন্যান্য গ্রামীণ মেলার মতো ওয়াজ মাহফিলের মেলায়ও দেখা যায়। সিরিয়াস শ্রোতারা প্যান্ডেলের ভেতরে নিয়মিত অবস্থান করলেও কিছু শ্রোতা ওয়াজ শোনার পাশাপাশি কেনাকাটাও করেন। বিনোদনের এই আয়োজনে অনেকেই আধ্যাত্মিক সম্পদ আহরণের পাশাপাশি পার্থিব প্রয়োজনটুকুও সেরে নেন। মাহফিল উপলক্ষে লাগানো অস্থায়ী দোকান ও মেলায় কেনাকাটা কেমন হয়, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে তা সন্তোষজনক। বিশেষ করে মাহফিলের আশপাশে বাড়িঘর ও গোটা এলাকায় মেহমান ও নাইওরীরা অধিক হারে যোগ দেওয়ায় অর্থনৈতিক লেনদেন হয় যথেষ্ট।
গত সপ্তাহে আমাদের দাদার বাড়ি ফরিদগঞ্জের ইসলামপুর দরবার শরীফে ৭৪তম মাহফিলে যাওয়ার সুযোগ হয়। প্রতিবছর না পারলেও সুযোগ পেলেই যাই। এ দরবারে বর্তমানে কোনো আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব বা ইসলাহি কার্যক্রম নেই। আমাদের বাড়িটি আছে, আর আছে মসজিদ মাদরাসা। পারিবারিক কবরস্থানে শুয়ে আছেন আমাদের অনেক মুরব্বী। দাদাজি হযরত শাহ মো. ইয়াসিন, তার ভাই সুফি খলিলুর রহমান রহ.। তারা দু’জনই ফুরফুরা শরীফের প্রথম পীর সাহেবের খলিফা। শত বছরের অধিক সময় ধরে এই বাড়ি ধর্মপ্রাণ মানুষের আকর্ষণের স্থান। দাদাজির ইসালে সওয়াব মাহফিলের বয়সই যখন ৭৪ তখন তার জীবন ও কর্মের সময়কাল আরও ৭০ বছরের কম হবে না। এ মাহফিলে যে কেরাত, হামদ-নাত, বয়ান, জিকির ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয় এর প্রভাব যেভাবে গোটা অঞ্চলে পড়ে তা থেকে আমরা সারা দেশের এধরনের হাজারো কর্মসূচির ও লাখো কর্মতৎপরতার প্রভাব সম্পর্কে ধারণা করতে পারি। আমার দেখা বদলে যাওয়া বেশ উন্নত পরিপাটি ও ধর্মপ্রাণ বাংলাদেশ যথেষ্ঠ আশাব্যঞ্জক। আমি কয়েক বছর আগে বলেছিলাম, ইনশাআল্লাহ ২৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ হবে আধুনিক ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার রোল মডেল। কয়েক বছরের ব্যবধানেই সমাজে এর নিদর্শন প্রকাশিত হচ্ছে। ধর্মহীনতা, মাদক, দুর্নীতি ও অপসংস্কৃতির সয়লাব মোকাবেলা করেও বাংলাদেশ তার নিজস্ব পথের উপর টিকে রয়েছে। এগিয়েও যাচ্ছে। যে পথটি হাজার বছর ধরে নির্মাণ করে চলেছেন এদেশের আওলিয়া-দরবেশ ও পীর-মাশায়েখরা। আল্লাহ ও রাসুলের সা. দেওয়া দীন প্রচারের পদ্ধতি, আজান, নামায, জুমা, খুতবা, জিকির, তালিম, বয়ান, ওয়াজ, মাহফিল ও মোনাজাত বাংলাদেশকে প্রতিদিন যে পথটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বদলে যাওয়ার এ দৃশ্য বাংলাদেশের মানুষকে যে বার্তা দেয় তা হলো, বাংলাদেশকে কেউ বিপথে নিতে পারবে না। বাংলাদেশ তার নিজের পথেই হাঁটবে। যার গন্তব্য হবে ইসলামী রাষ্ট্র, সমাজ ও সংস্কৃতি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।