Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রকল্প সংশোধনের হিড়িক

দুটি একনেক সভায়ই ৭ প্রকল্প অনুমোদন

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ২৫ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশের দ্রুত অগ্রসরমান শিল্পের মধ্যে ওষুধ শিল্প অন্যতম। কিন্তু ওষুধ শিল্পের কাঁচামালে আমদানীতেই অনেক অর্থ ব্যয় হয়। আর তাই আমদানী নির্ভরতা কমাতে এপিআই শিল্প পার্ক নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০০৮ সালে। ২০০৮ সালের ৫ মে একনেক প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়। ২১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১০ সালেই মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা ছিল। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে একাধিকবার। এরই ধারবাহিকতায় গত ১৬ জানুয়ারি প্রকল্পটির তৃতীয় সংশোধী প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। নতুন করে এপিআই শিল্প পার্ক প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। ফলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বাড়তি এক দশক সময় লাগছে। সংশোধীত প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৮১ কোটি টাকা। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় বাড়তি ব্যয় হচ্ছে ১৬৮ কোটি টাকা।
এভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা বাড়ছেই। পাশাপাশি বাড়ছে ব্যয়। প্রশ্ন উঠেছে রাজধানীর পাশে এপিআই শিল্প পার্ক স্থাপন প্রকল্পের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের এমন করুণ হাল হয়, তাহলে দেশের বাইরের অন্য প্রকল্পগুলোর কি অবস্থা? অথচ বিভিন্ন সময়ে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দীর্ঘসূত্রিতা রোধে কঠোর পদক্ষেপের কথা জানালেও তা মানা হচ্ছে না। আর তাই নির্বাচনী বছরে এসে প্রকল্প সংশোধনের হিড়িক পড়েছে। গত দুটি একনকে সভায়ই ৭টি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প সংশোধন আকারে পাস করা হয়। তারমধ্যে ৪টি প্রকল্পই আবার তৃতীয়বারের মতো সংশোধন করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক চাপে নতুন প্রকল্প যুক্ত করার কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং দ্রুত সমাপ্তযোগ্য প্রকল্পগুলো টাকার সংকটে পড়ে। ফলে তা সংশোধন করে ব্যয় বাড়াতে হয়। এতে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ গচ্চা যাচ্ছে। পাশাপাশি প্রকল্পের গুণগত বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
সূত্র মতে, প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রণয়নে ক্রটি, নানা ধরনের অনিয়ম, রেট সিডিউল পরিবর্তন, মাঝপথে নতুন অঙ্গ সংযোজনের নামে কালক্ষেপণ, দূরদর্শিতার অভাব, মনিটরিং না থাকা বা দুর্বল তদারকি, ঘনঘন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) পরিবর্তন, সংশ্লিষ্টদের দক্ষতার অভাব, অর্থছাড়ে বিলম্ব, জটিল ও ব্যতিক্রমী কাজের ক্ষেত্রে অনেক সময় টার্ন কি ঠিকাদারের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা এবং প্রকল্প ঝুলিয়ে রেখে বেতন ও অন্যান্য সুবিধা ভোগের প্রবণতা ইত্যাদি কারণেই প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় ও ব্যয় বাড়ছে। প্রতি বছর সরকারকে এ জন্য গচ্চা দিতে হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা।
পরিকল্পনামন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল একাধিকবরা প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা রোধে কঠোর পদক্ষেপের কথা জানান। তিনি এ পরিস্থিতি রোধে বাধ্যবাধকতা দেয়ার কথা উল্লেখ করেন। এক্ষেত্রে প্রতি প্রান্তিকে বরাদ্দের ২৫ শতাংশ অর্থ ব্যয়ের কথা জানিয়েছিলেন। একই সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নে যতদিন সময় লাগবে, ঠিক ততদিনই দেয়া হবে। কোনভাবেই অতিরিক্ত সময় না দেয়ার কথাও জানান। কিন্তু প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা মন্ত্রীর এ কথায় কোনভাবেই কান দিচ্ছেনা না।
পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৬ জানুয়ারির ওই সভায় ১৪টি প্রকল্প পাস হয়। এর মধ্যে এপিআই শিল্প পার্ক নির্মাণসহ ৫টি প্রকল্পই সংশোধন করে অনুমোদন দেয়া হয়। অন্যান্য প্রকল্প হল- ‘নারায়নগঞ্জের বন্দর উপজেলায় ৩য় শীতলক্ষ্যা সেতু নির্মাণ (১ম সংশোধিত)’ প্রকল্প, জননিরাপত্তা বিভাগের ‘৭টি র‌্যাব কমপ্লেক্স নির্মাণ (২য় সংশোধিত)’ প্রকল্প, ‘জরুরী ২০০৭ ঘূর্ণিঝড় পুনরুদ্ধার ও পুনর্বাসন প্রকল্প (ইসআরআরপি) : এলজিইডি অংশ (৩য় সংশোধিত)’ প্রকল্প, ‘জরুরী ২০০৭ ঘূর্ণিঝড় পুনরুদ্ধার ও পুনর্বাসন প্রকল্প (ইসআরআরপি) : প্রকল্প সমন্বয় এবং পর্যবেক্ষণ ইউনিট (পিসিএমইউ) অংশ (৩য় সংশোধিত)’ প্রকল্প। এদিকে গত মঙ্গলবার (২৩ জানুয়ারি) একনেকে ১৪টি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। যার মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পই সংশোধিত। এদিন ‘পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার গাজনার বিলের সংযোগ নদী খনন, সেচ সুবিধার উন্নয়ন এবং মৎস্য চাষ (৩য় সংশোধিত) (প্রস্তাবিত)’ প্রকল্প পাস করা হয়। প্রকল্পটির বর্তমান প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৮ কোটি ৬৮লাখ টাকা। অথচ প্রকল্পটি প্রথম ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি ৪১৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে একনেক অনুমোদন করে। একনেকের ওই সভায় জাহাজ ও সাগর তীরের মধ্যে ২৪ ঘন্টা যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় ‘জিএমডিএসএস এবং ইন্টিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম স্থাপন (১ম সংশোধিত)’ প্রকল্প পাস করা হয়।
সূত্র মতে, নানা অজুহাতে বাস্তবায়ন সময় ও ব্যয় বাড়ানোয় ২০১৬ সালে ১৫টি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পেই সরকারের গচ্চা গেছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এভাবে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোয় সরকারের ক্ষতি নিয়ে এ পর্যন্ত কোনো তদন্ত হয়নি। এমনকি দায়িত্বে অবহেলার জন্যও কাউকে দায়ী করা হয়নি।
আইএমইডি বলছে, ভবিষ্যতে প্রকল্প প্রণয়নের সময় বাস্তবসম্মতভাবে ব্যয় ও সময় নির্ধারণে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। ঘনঘন প্রকল্প পরিচালক বদলি বা পরিবর্তন না করার বিষয়ে সচেষ্ট থাকতে হবে এবং প্রকিউরমেন্ট (কেনাকাটা) সংক্রান্ত সব কাজ যাতে চুক্তি মূল্যের মধ্যে সমাপ্ত হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্প সংশোধনের নামে ইচ্ছামতো ব্যয় বাড়িয়ে সরকারি অর্থের হরিলুট চলছে। প্রকল্প তৈরি ও অনুমোদনের সময়ই প্রকল্পটি কবে কোথায় কিভাবে বাস্তবায়ন হবে, অর্থ কোথা থেকে আসবে তা যাচাই-বাছাই করেই চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সর্বোচ্চ ফোরামের বৈঠকে তা অনুমোদন করা হয়। কিন্তু এরপরই শুরু হয় নানা ধরনের অসাধু কর্মকান্ড। বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদারের যোগসাজশে নানা অজুহাত তৈরি করে প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করা হয়। প্রকল্পের এক পর্যায়ে এসে নানা অজুহাত দেখিয়ে বাস্তবায়ন বিলম্বিত করা হয়। আর এই বিলম্বের অজুহাতে প্রকল্প ব্যয়ও বাড়ানো হয়। এভাবে প্রকল্পের অর্থ নিয়ে অনিয়ম চলছে বলে সূত্র দাবি করেছে।
পরিকল্পনা কমিশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্র বলছেন, প্রকল্প সংশোধন একটি পুরনো কৌশল। এতে আর্থিক অনিয়ম অনেক বেড়ে যায়। সরকারের অর্থের অপচয় ঘটে। আর তাই বারবার প্রকল্প সংশোধনের নামে ব্যয় বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা গচ্চা দেয়ার রীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় যে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হচ্ছে এটা অবশ্যই এক ধরনের সরকারি অর্থের অপচয় এবং অপব্যবহার।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, প্রকল্প সংশোধনের নামে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তাই প্রকল্পের স্বচ্ছতার স্বার্থেই প্রকল্প গ্রহনের প্রাথমিক পর্যায়েই সময় ও অর্থ বাচাঁতে সময় ও ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা। যাতে করে বার বার প্রকল্প সংশোধন করে অর্থ ও সময় অপচয় না হয়। এক্ষেত্রে প্রকল্পে দরপত্র, জমি গ্রহণসহ নানা জটিলতাগুলো মূল প্রকল্প শুরুর আগেই শেষ করার উপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। তবে প্রকল্পের সময় ও প্রাক্কলিক অর্থকে যৌক্তিক করতে গিয়ে যেন আবার প্রকল্পে অধিক বাজেট না চলে আসে সেদিকেও নজড় দিতে হবে বলে উল্লেখ করেন এই গবেষক। ড. গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন প্রকল্পের সংশোধন কমাতে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে অধিক গুরুত্বারোপ করেন।



 

Show all comments
  • দিদার ২৫ জানুয়ারি, ২০১৮, ৫:১৫ এএম says : 0
    নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ার প্রবণতা দূর করতে হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রকল্প সংশোধনের

২৫ জানুয়ারি, ২০১৮
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ