ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
রাজধানী ঢাকা আর নাগরিক সমস্যা সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে বহু আগেই। ঢাকাকে ভাবা হয় দুনিয়ার সবচেয়ে অপরিচ্ছন্ন মেগাসিটি হিসেবে। যানজটের নগরী যেন ঢাকার পরিচিতির অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। দুনিয়ার আর কোনো মেগাসিটিতে এত ভাঙাচোরা রাস্তা খুঁজে পাওয়া দায়। জলাবদ্ধতা রাজধানীর একাংশের ঘাড়ে এমনই চেপে বসেছে যে কোনটি রাস্তা আর কোনটি নর্দমা তা উপলব্ধি করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মশার উৎপাতে রাজধানীর কোনো কোনো এলাকায় দিনের বেলায়ও স্বস্তিতে থাকা দায়।
বাস্তবে ঢাকা শহর বসবাসের জন্য কতটা অনুপযোগী তা এই শহরের বাসিন্দাদের চেয়ে বেশি ভালো কেউ জানে না। আমরা প্রতিনিয়ত এই স্থবির শহরটিতে মরার মত বেঁচে আছি। দুর্বিষহ যানজট, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সংকট, পয়ঃনিষ্কাশনের জটিলতা, দুর্গন্ধময় ও বিষাক্ত বাতাস, দূষিত পরিবেশ, অসম্ভব ঘনবসতি, ভেজাল খাবার, আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্য, লাগামহীন বাসা ভাড়া, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ইত্যাদি নানা সমস্যায় আমরা একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছি। শহরটিতে এই অবস্থা বিরাজ করছে অনেক বছর ধরে। আর দিনে দিনে এ অবস্থা কঠিনতর আকার ধারণ করছে।
রাজধানীর সীমা ছাড়িয়ে টঙ্গী, গাজীপুর ও আশেপাশের অন্যান্য শহরগুলোতেও একই অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ঢাকার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকেই। খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ না করেও সহজেই বলা যায় শহরটির সার্বিক ক্রমাবনতির লাগাম টেনে ধরতে না পারলে অল্প কয়েক বছরের ব্যবধানেই এই শহর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হবে মানুষ। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার পক্ষ থেকে প্রায়ই এমন উদ্বেগের কথা জানানো হচ্ছে এবং সরকারের প্রতি পরামর্শমূলক প্রস্তাব বা পরিকল্পনা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতি পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।
নানা জরিপেই ঢাকার নাজুক অবস্থার কথা উঠে এসেছে বার বার। সর্বশেষ জাতিসংঘের হ্যাবিটেট প্রতিবেদনে ঢাকাকে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৪ হাজার ৫০০ জন মানুষ বাস করে। গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় পরিসংখ্যান অফিস থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করেছে ইউএন হ্যাবিটেট। ঘনবসতির দিক দিয়ে এক নম্বর অবস্থানে আছে ঢাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারতের মুম্বাই। তৃতীয় অবস্থানে কলম্বিয়ার শহর মেডেলিন এবং চতুর্থ অবস্থানে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা। বাংলাদেশের জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (নিপোর্ট) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় বর্তমানে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ বাস করছে। এই চিত্র নিঃসন্দেহে হতাশার।
এমনিতেই নানা সমস্যায় জর্জরিত রাজধানী শহর ঢাকা। জনসংখ্যার ভারে কার্যত ঢাকা এখন নুইয়ে পড়ছে। উপরন্ত জনসংখ্যার চাপ ক্রমাগত বাড়ছেই। কিন্তু সে অনুযায়ী সুযোগ সুবিধা বাড়ছে না। সত্যি বলতে সে ধরনের অবস্থায়ও নেই। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহর গড়ে উঠেছে একেবারেই অপরিকল্পিতভাবে। নাগরিক সুযোগ সুবিধার অনেক কিছুই এখানে অনুপস্থিত। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জরিপ সংস্থার মতে, বিশ্বের বসবাসের উপযোগিতার বিবেচনায় সবচেয়ে অযোগ্য শহর ঢাকা। স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্য সুবিধা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামোসহ ৩০টি মানদন্ডের বিবেচনায় ঢাকার স্থান তলানিতে। প্রশ্ন হচ্ছে, ঢাকার অবস্থা আর কত খারাপ হলে কর্তৃপক্ষের পনক নড়বে?
আমাদের রাজধানী শহর বসবাসের অনুপযোগী- জনসংখ্যার ভারে নুইয়ে পড়েছে- এরচেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে! এই অবস্থা যে আমাদের জন্য গৌরবজনক নয় সেটি কি বলার অপেক্ষা রাখে? একটি শহরের মান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে যে নিয়ামকগুলো কাজ করে এরমধ্যে রয়েছে- নগরীতে বসবাসের সুযোগ সুবিধা, জনসংখ্যার ঘনত্ব, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, শিক্ষা ব্যবস্থা, চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ-সুবিধা, অপরাধের হার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন, পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, অবকাঠামোর গুণগতমান, পানি সরবরাহের মান, খাদ্য, পানীয়, ভোক্তাপণ্য এবং সেবা, সরকারি বাসগৃহের প্রাপ্যতা ইত্যাদি। এসব দিক থেকে ঢাকাসহ আমাদের নগরগুলোর কী অবস্থা তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
একটি নগরে সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সে জন্য নগরজীবনকে স্বচ্ছন্দ, পরিবেশবান্ধব, টেকসই, উন্নয়নমুখী এবং পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। কেননা দেশের এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ প্রায় ৫ কোটি মানুষ এখন শহরে বাস করছে। আসলে পরিকল্পিত নগর বলতে বুঝায় একটি পরিকল্পিত জনবসতি। যার সবকিছু হবে পরিকল্পনা অনুযায়ী। কোথায় স্কুল কলেজ হাসপাতাল হবে, অফিস আদালত কোথায়, কোথায় বসবাসের জায়গা সবকিছুই হবে পরিকল্পনামাফিক। পরিকল্পনামাফিক সবকিছু হলে প্রত্যেক নগরেই মানুষ শৃঙ্খলাপূর্ণ নাগরিক সুযোগ সুবিধা ভোগ করে। এতে তার নাগরিক জীবন হয় মর্যাদাপূর্ণ, গ্রাম কিংবা মফঃস্বলের তুলনায় উন্নততর, স্বস্তিদায়ক। কিন্তু এই নগরই আবার পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠলে তাতে নাগরিকদের জীবন অস্বস্তিকর হয়ে হঠে। জনজীবনকে তা বিপর্যস্ত করে ফেলে। মানুষের ভোগান্তির কোনো শেষ থাকে না।
রাজধানীর এই বেহাল অবস্থা একদিনে সৃষ্টি হয় নি। আর এর পেছনে একক কাউকেও দায়ী করা যায় না। তেমনিভাবে এক দিনে এবং একক কারো প্রচেষ্টাতেও এই সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে যে সব কারণ বিদ্যমান, গবেষকরা সেগুলোকে অনেক আগেই বিজ্ঞানসম্মতভাবে চিহ্নিত করেছেন এবং সেগুলোর সম্ভাব্য সমাধানও দিয়েছেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কোন সমস্যারই সমাধান সম্ভব নয় যতক্ষণ না রাষ্ট্র নিজে তা সমাধানে সত্যিকার অর্থে আন্তরিক হয়।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।