Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মানবিক বোধের সর্বোচ্চ চর্চা করাই প্রতিটি পেশার মূল দায়িত্ব

প্রকাশের সময় : ২৭ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

তৌহিদুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে অধ্যাপনায় নিয়োজিত। তার লেখা-লেখির অভ্যাস দীর্ঘদিনের। জড়িত রয়েছেন সমাজ সেবামূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে। সমাজ ও সমাজস্থ বিষয় তার গবেষণার মূল আরাধ্য। অল্প সময়ে খ্যাতি পেয়েছেন অপরাধ, ভিকটিমোলজি ও রেস্টোরেটিভ জাস্টিস বিষয়ে বিশ্লেষণ গবেষণা ও সম্পাদনায়। তার অঙ্গনে তিনি সফল একজন মানুষ। সফল ক্যারিয়ার নিয়ে তার সাথে খোলামেলা আলাপ করেছেন- আমির সোহেল

প্রশ্ন : ক্যারিয়ারে সফলতার জন্য প্রথমে কী পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ বলে মনে করেন?
উত্তর : প্রকৃতপক্ষে, ক্যারিয়ারের সংজ্ঞায়ন কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কারণ বর্তমান সময়ে যেসব বিষয়কে অথবা উন্নতির ধরণকে ক্যারিয়ার বলা হয়, তা ক্যারিয়ারের সংক্ষিপ্ত বা সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। ক্যারিয়ার মূলত জীবনসফরেরই একটি অংশ যা ব্যক্তিভেদে বিভিন্ন দৃষ্টিতে বিবেচ্য, যেখানে ক্ষেত্রবিশেষে অর্থের আধিপত্য নাও থাকতে পারে। এটি আপেক্ষিক। তবে ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সমাজ কর্তৃক প্রত্যাশা ক্যারিয়ারের ক্ষেত্র প্রস্তুতে সহায়তা করে। বাংলাদেশে ক্যারিয়ারের সাথে অর্থের সংগতি প্রধানত মূল বিবেচ্য হিসেবে পরিগণিত যা ক্যারিয়ারকে সংকীর্ণ অর্থে বিচার করে। ক্যারিয়ারের সফলতায় আমার মতে প্রথমে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তার একাডেমিক পড়াশুনা সঠিক নিয়মে শেষ করতে হবে। তবে আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে বর্তমানে একটি প্রবণতা লক্ষ্য করি যা খুবই বেদনার- তা হলো যেনতেন প্রক্রিয়ায় সার্টিফিকেট অর্জন। শিক্ষার্থীদের একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, তাদের ভবিষ্যৎ কর্মের পরিধি ও সাফল্য অনেকাংশে জ্ঞানগত গভীরতা ও চর্চার ওপর নির্ভর করবে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা কেন যেন এই বিষয়টি এড়িয়ে যায় যা জাতীয় উন্নয়নে শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধিগত সংকট। একাডেমিক বিষয়ের পাশাপাশি শিক্ষার্থীকে খুঁজে বের করতে হবে কোন্ বিষয়ে কাজ করতে তার অধিক ভালো লাগে বা নতুন চিন্তার ক্ষেত্র তার মধ্যে তৈরি হয়।

প্রশ্ন : ক্যারিয়ারের বিষয় বাছাই করতে হবে কীভাবে?
উত্তর : আমাদের দেশে পড়াশুনার কাঠামো শিক্ষার্থীদের অন্তর্নিহিত মেধা সঠিকভাবে ব্যবহারের উপযোগী নয়। এটি অনেকাংশে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভয়ভীতি বা পরীক্ষায় পাস জাতীয় সস্তা চিন্তায় বন্ধি করে ফেলে। লক্ষ করলে দেখা যায়, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা চাকরির বাজারের সাথে সঙ্গতি রেখে বিষয়/ডিসিপ্লিন পছন্দ করে। এটি প্রাথমিক দৃষ্টিতে দোষের নয়। তবে সত্যিকার ‘মানুষ’ হওয়ার প্রক্রিয়ায় বাজারজাত শিক্ষার চেতনা অনেক দূরত্বে অবস্থান করে। আমার মতে, এটি ক্যারিয়ার সিদ্ধান্তে অন্যতম প্রতিকূলতা। তবে আমাদের দেশে বাস্তবতার নিরীক্ষে, যে বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেছে সেই বিষয়ে ক্যারিয়ার তৈরির ক্ষেত্র জাতীয়/অসরকারি চিন্তায় সেই মাত্রায় তৈরি হয়নি। এক্ষেত্রে পাশকৃত শিক্ষার্থীদের অনেক সময় নিজ অস্তিত্ব ও পরিবার, সমাজ প্রত্যাশা পূরণে কাজের আগ্রহ পরিহার করে চাকরি খোঁজার কাজে ব্যস্ত রাখে কিংবা সেই প্রক্রিয়ায় চাকরি করে। একটি দেশের সমাজ পরিকাঠামোর চেহারা বদলে যাবে তখনই যখন সেই দেশের শিক্ষার্থীদের মজ্জাগত গুরুত্ব বিবেচনা করে রাষ্ট্র তার লালন করবে। সেই জায়গা থেকে আমাদের দেশে ক্যারিয়ারের চিন্তা যোজন যোজন তফাতে। তবে নিজের আগ্রহ বিষয়ে ক্যারিয়ার/কাজের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারলে ভালো, অন্যথায় সনাতনী চিন্তায় অর্জিত জ্ঞান ও ইচ্ছার অপচয় হবে।

প্রশ্ন : পেশাগত দক্ষতা বাড়াতে কোন কোন বিষয় শেখা উচিত?
উত্তর : আসলে, ক্যারিয়ার গড়তে সেই বিষয়গুলোর ওপর জোর দিতে হবে যে বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট ক্যারিয়ারের সাথে জড়িত। প্রতিটি পেশা কতিপয় নিজস্ব গুণাবলী বা প্রয়োজনীয় বিষয়ের দাবি রাখে। সেই বিষয়গুলো অবশ্যই শিখতে হবে। দ্বিতীয়ত, বর্তমান সময় প্রযুক্তির সর্বোচ্চ দাপুটে সময়। প্রায় প্রতিটি পেশাই প্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পেশাগত কর্মকা- পরিচালনা করছে। আর নিজ পেশার মাধ্যমে বিশ্ব পরিসরে সংযুক্ত হওয়ার এটি একটি সহজ প্রক্রিয়া। তৃতীয় পর্যায়ে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নিত্যনতুন অর্জন সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে এবং সেই ধারণার সাথে নিজ পেশার সম্পর্ক স্থাপন জরুরি। আবার ক্যারিয়ারে নিজ পেশার সাম্প্রতিক অর্জন সম্পর্কে সম্যক ধারণা/জ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যকীয়।

প্রশ্ন : বিভিন্ন পেশার ক্ষেত্রে কী কী বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে?
উত্তর : প্রতিটি পেশার/কাজের নিজস্ব স্বকীয়তা আছে, এই স্বকীয়তাই ওই পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিকে আলাদা করে। ক্যারিয়ারে সফলতার ক্ষেত্রে যে পেশায় ব্যক্তি নিজেকে সম্পৃক্ত করতে চায়, সেই পেশার নৈতিক মানদ- সর্বদা অনুসরণ করা পেশাগত দায়িত্বের অপরিহার্য দিক। অন্যদিকে, মানবিক বোধের সর্বোচ্চ চর্চা করাই প্রতিটি পেশার মূল দায়িত্ব। যত বেশি সম্ভব নিজ ক্যারিয়ারের মধ্য দিয়ে মানবিকতার সেবা পরিচালনা করা।

প্রশ্ন : নীতি-নৈতিকতা সাফল্যের জন্য কতটা সহায়ক?
উত্তর : সময়ের পরিবর্তনে পরিবর্তিত হয় সমাজের সকল বৈশিষ্ট্যের। আর মানুষের জীবনের একটি কার্যকার দিক হলো সমাজস্থ নীতি-নৈতিকতা-মূল্যবোধের চর্চা ও ব্যক্তিজীবনে বিশ্বাস। ক্যারিয়ারে সফলতার জন্য প্রথমত, পেশাদার ব্যক্তিকে নিজ পেশার নীতির মূল্যবোধের প্রতি সম্মান, আস্থা জ্ঞাপন করার মানসিকতা থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, সমাজের প্রচলিত নিয়ম-নীতির প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করতে হবে, অন্যথায় মানবিক বোধের জাগ্রত বৈশিষ্ট অর্জন প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। কারণ নিয়ম-নীতি-মূল্যবোধ মানুষকে যেমন কর্মের প্রতি নিষ্ঠাবান করে তেমনি মানুষের প্রতি করে আরো মানবিক ও মানবসত্তার সত্যিকার বহিঃপ্রকাশে মূল অনুঘটকের ভূমিকা রাখে।

প্রশ্ন : সফলতার জন্য কী কী উপায় অবলম্বন করা উচিত?
উত্তর : সফলতা মূলত একটি আপেক্ষিক বিষয়, যা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে। তবে প্রায় সকলে মানতে পারে এভাবে সফলতাকে বিশ্লেষণ করতে চাইলে বলতে হয়, এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ব্যক্তি অর্জিত জ্ঞানের পেশাগত অনুশীলনের মাধ্যমে দক্ষতার এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছে যেখানে চূড়ান্ত লক্ষ হলো মানবিকতার সর্বোচ্চ ব্যবহার ও সমাজ কাঠামোর অসুস্থ পরিবেশের পরিবর্তে সুস্থ সামাজিক ধারার সংযোজন। সফলতার জন্য প্রতিটি ব্যক্তিকে প্রথমত, সততা-নীতি-নিষ্ঠার সাথে নিজ কাজের প্রতি মনোযোগী হতে হবে; দ্বিতীয়ত, একাডেমিক পড়াশুনার সময় শুধুমাত্র ভালো ফলাফলের প্রতি নজর না দিয়ে কীভাবে বইয়ের বিষয়গুলো বুঝা যায় তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। শেষে, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, নিজ দেশ, সমাজের প্রতি আবেদন-নিবেদন হবে মানুষ্যত্বের কার্যকর ব্যবহার ও সম্প্রীতির কাতারে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করা।

প্রশ্ন : বর্তমানে পড়াশুনা শেষ করে সবাই বিসিএস বা ব্যাংক জবের পিছনে ছুটে। এটাকে আপনি জোন দৃষ্টিতে দেখেন?
উত্তর : এটি আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে ক্যারিয়ারের একটি প্রায় স্থায়ী প্রক্রিয়া হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। আমি বিসিএস কিংবা ব্যাংক জবের বিপক্ষে নই তবে নিজস্ব মেধারভিত্তিতে ব্যক্তি উদ্যোক্তা ও উদ্দীপনা অতিদ্রুত একটি দেশকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোগত উন্নয়নে সহযোগিতা করে। মূলকথা হলো, ব্যক্তির সৃষ্টিশীল কর্মের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ভূমিকা থাকা অত্যাবশ্য বলে মনে করি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মানবিক বোধের সর্বোচ্চ চর্চা করাই প্রতিটি পেশার মূল দায়িত্ব
আরও পড়ুন