Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রকট সংকটে সাত কলেজ আশ্বাসে মিলছে না বিশ্বাস

| প্রকাশের সময় : ২২ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

আন্দোলনে সমন্বয়হীনতা : অনিশ্চয়তায় ভুগছেন প্রায় দেড় লাখ শিক্ষার্থী
এহসান আব্দুল্লাহ : কোন প্রকার পূর্ব প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা ছাড়াই সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত করায় বিপাকে পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ এইসব কলেজের প্রায় দেড় লক্ষাধিক শিক্ষার্থী। তীব্র সেশন জটে অনিশ্চয়তায় কাটছে তাদের শিক্ষাজীবন।
শিক্ষার মান উন্নয়ন ও সেশন জট কমাতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গত বছরের ১৬ই ফেব্রুয়ারী রাজধানীর সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত করা হয়। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে এইসব কলেজের কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রস্তুতি ও লোকবল কোনটিই বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে নেই। অপরদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভূক্তির পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও এইসব কলেজের কোন প্রকার দায়িত্ব নিতে নারাজ। ফলে উভয় সংকটে দিন কাটছে অধিভূক্ত হওয়া এইসব কলেজের শিক্ষার্থীদের। একই ব্যাচের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্র্থীরা তাদের পরীক্ষা ও ফলাফল হাতে পেয়ে থাকলেও এইসব কলেজের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে পরীক্ষা বা ফলাফলের কোন প্রকার পূর্বাভাসই পাওয়া যাচ্ছেনা। ফলে বারবার আন্দোলনে নামছে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। আর প্রতিবারই মিলছে কোন না কোন আশ^াস। তবে এই আশ^াসে কোন বিশ^াস রেখে স্বস্তির নিশ^াস নিতে পারছেনা কেউই।
অধিভূক্ত এইসব কলেজের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা জানান, ১ম বর্ষের প্রায় ১৪ মাস হয়ে গেলেও তারা এখনো পাননি ১ম বর্ষের চুড়ান্ত পরীক্ষার কোন ইঙ্গিত। একই সমস্যায় আছেন ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থীরা, তারাও তাদের ২য় বর্ষের চুড়ান্ত পরীক্ষার কোন তারিখ পাননি। অপরদিকে ২০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থীরা জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে তাদের ২য় বর্ষের চুড়ান্ত পরীক্ষা দিলেও পরীক্ষার মাঝেই এইসব কলেজ ঢাবি অধিভূক্ত হওয়ায় তাদের মৌখিক পরীক্ষা নেয় ঢাবি কর্তৃপক্ষ। ফলে লিখিত পরীক্ষা ও ইনকোর্স পরীক্ষার ফলাফল রয়েছে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের হাতে আর মৌখিক পরীক্ষার ফলাফল প্রস্তুত করেছে ঢাবি। ঢাবি কর্তৃপক্ষ এই ফলাফল জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ে পাঠালেও তাদের গড়িমসির কারণে পূর্ণাঙ্গ ফলাফল এখনো হাতে পায়নি ঢাবি। ফলে এইসব শিক্ষার্থীদের চুড়ান্ত পরীক্ষার এক বছর হয়ে গেলেও তারা ফলাফল হাতে পাননি এবং তাদের ৩য় বর্ষের চুড়ান্ত পরীক্ষার ও কোন সম্ভাবনা দেখছেননা তারা।
এর আগে গত বছরের ২০ জুলাই সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের ফল প্রকাশ ও পরীক্ষার তারিখ ঘোষনার জন্য সর্বপ্রথম আন্দোলনে নামেন রাজধানীর শাহবাগে। সেই আন্দোলনে পুলিশের রাবার বুলেটে চোখ হারান তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমান। এই ঘটনায় ১২০০ ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলাও করে পুলিশ।
পরবর্তীতে একই বছরের ৯ই অক্টোবর নীলক্ষেতে আবার আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। সেখানে তারা চতুর্থ বর্ষের ফল প্রকাশ ও ৩য় বর্ষের চুড়ান্ত পরীক্ষার তারিখ ঘোষনার জন্য দাবি তোলে। সেই আন্দোলনের ফলে নভেম্বরে চতুর্থ বর্ষের ফল প্রকাশ করে ঢাবি কর্তৃপক্ষ এবং ২৩ অক্টোবর ২০১৭ তারিখ থেকে ৩য় বর্ষ চুড়ান্ত পরীক্ষার তারিখ ঘোষনা করলেও ২য় বর্ষের ফল প্রকাশ না হওয়ায় সেই পরীক্ষা এখনো অনুষ্ঠিত করতে পারেনি ঢাবি কর্তৃপক্ষ।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার (১৮ই জানুয়ারী) ২০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থীরা নীলক্ষেতে আন্দোলন করে তাদের ২য় বর্ষের ফল প্রকাশ ও ৩য় বর্ষের পরীক্ষার তারিখ মার্চের মধ্যে ঘোষনা করতে। তাদের সেই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান ২৫ ফেব্রুয়ারী ফল প্রকাশের আশ্বাস দেন, সম্ভব হলে জানুয়ারীতেই প্রকাশ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। সেখানে তিনি বলেন, ফলাফল জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কাছে পাঠানো হলে খুব দ্রুতই তা প্রকাশ করবে ঢাবি। তবে এ আন্দোলন থেকে তাদের চুড়ান্ত পরীক্ষার তারিখের ব্যাপারে কোন ঘোষনা আসেনি ঢাবি কর্তৃপক্ষ থেকে।
এদিকে, ২০১৩-১৪ সেশনের মাস্টার্সের চুড়ান্ত পরীক্ষার রেজাল্টও প্রকাশিত হয়নি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে অধিভূক্ত হওয়ার পর। গত বছরের নভেম্বরে ২০১১-১২ সেশনের অনার্স চতুর্থ বর্ষের চুড়ান্ত ফলাফল ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে দেয়া হলেও এই সেশনে শিক্ষার্থীদের মাস্টার্সে ভর্তির কোন কার্যক্রম শুরু করেনি ঢাবি কর্তৃপক্ষ।
জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় থেকে চুড়ান্ত রেজাল্ট পাওয়ার পরও আটকে আছে ২০১২-১৩ সেশনের অনার্সের চুড়ান্ত পরীক্ষা। তবে ঢাবি থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী এ বছরের ফেব্রæয়ারীতে ২০১২-১৩ সেশনের চুড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও সেরকম কোন সম্ভাবনা দেখছেননা বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। একই রকম ভাবে আটকে আছে ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থীদের ২য় বর্ষের চুড়ান্ত পরীক্ষাও।
ঢাকা কলেজ ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে জানা যায় এখন পর্যন্ত ২০১২-১৩ সেশনের ৪র্থ বর্ষের চুড়ান্ত পরীক্ষার জন্য ফরম ফিলাপই হয়নি তাদের সেই ক্ষেত্রে পরীক্ষার তারিখ কবে নাগাদ হতে পারে সেটি নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছেন তারা। তারা জানান, আমাদের সাথে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ৪র্থ বর্ষ পরীক্ষা দিয়ে এখন বিভিন্ন চাকুরীর পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে আর আমরা এখনো আমাদের অনার্স পরীক্ষা হবে কি হবেনা সেই শঙ্কায় ভুগছি। এর ফলে চাকুরীর ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে পরছি।
একই সাথে ঢাবি অধিভূক্ত হওয়ার পর থমকে আছে এইসব কলেজের ডিগ্রি পাস কোর্সের কার্যক্রম। জানা যায়, ডিগ্রির ২০১৩-১৪, ২০১৪-১৫ এবং ২০১৬-১৭ সেশনের চুড়ান্ত পরীক্ষার জন্য কোন ফরম ফিলাপ এবং পরীক্ষার তারিখ ঘোষনা হয়নি। ফলে এইসব শিক্ষার্থীরাও তাদের শিক্ষাজীবন নিয়ে পড়েছেন চরম সঙ্কটে।
এবিষয়ে সাত কলেজের সমন্বয়ক ও ঢাবির ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, আমরা যথাসময়ে ফল প্রকাশ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। যেহেতু কিছু ফলাফল এখনো জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের কাছে আছে তারা আমাদেরকে সেগুলো হস্তান্তর করলেই আমরা দ্রুত ফল প্রকাশ করবো।
একদিকে যেমন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের এই অধিভূক্তি নিয়ে বিপাকে আছেন অপরদিকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্ররাও এ নিয়ে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। সাত কলেজের ভর্তি সংক্রান্ত কার্যক্রম ঢাবি ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত হওয়ায় তারা তাদের নিয়মিত যেসকল সুবিধা প্রয়োজন তা পেতে বিলম্বিত হচ্ছে।
এরফলে এইসব কলেজের অধিভূক্তি বাতিলের দাবিতে গত সোমবার ঢাবি শিক্ষার্থীরা একটি আন্দোলন করে ঢাবি ক্যাম্পাসে। এই আন্দোলনের সমন্বয়ক মশিউর রহমান সাদিককে পুলিশে সোপর্দ করে ঢাবি কর্তৃপক্ষ। টানা ৪৮ ঘন্টা আটক থাকার পর তাকে মুক্তি দেয়া হয় ও সেই আন্দোলনে ছাত্রীদের যৌন হেনস্থা ও ছাত্রদের মারধর করে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাবি কর্তৃপক্ষ শনিবার একটি বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করে অধিভূক্ত এই সাত কলেজকে কেন্দ্র করে। সেখানে তারা বলে এখন থেকে এইসব কলেজের সকল এ্যাকাডেমিক ও আর্থিক কার্যক্রম কলেজের নিজস্ব ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত হবে এবং তারা স্ব স্ব কলেজের পরিচয়পত্র বহন করবে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় শুধু তাদের ভর্তি ও পরীক্ষা সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
অপরদিকে এই সাত কলেজের আন্দোলনও চলছে সমন্বয়হীনতার মাধ্যমে। এমনটাই জানা যায় সাত কলেজ সম্পর্কিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রæপে। সেখানে তারা দাবি করেন প্রত্যেকটি সেশনই নিজ নিজ সেশনের সমস্যার দাবিতে আন্দোলন করছে। একসাথে সকল সেশন নিয়ে কোন সমন্বয় করে আন্দোলন করা হচ্ছেনা বলে এক সেশনের সমস্যার সমাধান পাওয়া গেলেও আরেকটির যাচ্ছেনা।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনিক ভবন সূত্রে জানা যায়, এইসব কলেজের কার্যক্রম পরিচালনা করতে ব্যাপক হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। এর কারণ হিসেবে প্রয়োজনীয় লোকবল ও দক্ষতার অভাবকে দায়ী করা হয়। এবং বিশ^বিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতর থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে সেটি স্বীকারও করে নেয় ঢাবি প্রশাসন।
উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় অধিভূক্ত সাতটি কলেজ হলো; ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সাত কলেজ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ