পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
সাদিক মামুন, কুমিল্লা থেকে : অফিসের কাজ সেরে ঘরে ফিরেই ভরাট গলায় মেয়েকে ডাক দিতেন সোহাগী বলে। ডাকনাম তনু হলেও বাবা ইয়ার হোসেন আদরের মেয়েকে সোহাগী বলেই ডাকাডাকি করতেন। ইয়ার হোসেন ও আনোয়ারা বেগমের দুই ছেলে এক মেয়ের মধ্যে সোহাগী জাহান তনু বড়। অভাব অনটন যা-ই থাকুক সন্তানদের নিয়ে একটি সুখের সংসার ছিল তনুদের। ব্যাপক নিরাপত্তাবেষ্টিত কুমিল্লা সেনানিবাসের আবাসিক এলাকায় নৃশংস হত্যার মধ্যদিয়ে আদরের একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান তনুর গোটা পরিবারসহ সারাদেশের মানুষ। প্রতিবাদের সবটুকু শক্তি নিয়ে তনুর পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে দেশের সচেতন বিবেকবান মানুষরা। তনুর হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও উপযুক্ত বিচারের দাবিতে উত্তাল সারাদেশ। কিন্তু হত্যার পাঁচ দিন অতিবাহিত হলেও গ্রেপ্তার হচ্ছে না পাষ- ঘাতকরা। তবে কি ঘাতকদের বাঁচাতে কোনো মহল উৎসাহী? নাকি একটি অসহায় পরিবারকে তাদের সন্তান খুনের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য কাজ করছে? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তনু হত্যার বিচারের দাবিতে রাজপথে নেমে আসা বিবেকবান মানুষদের মনে। গতকাল তনু হত্যাকা- নিয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে জেলা কোর কমিটির বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
দুই ছেলে, এক মেয়ে আর স্ত্রী আনোয়ারা বেগমকে নিয়ে ছোট্ট সংসার কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী ইয়ার হোসেনের। থাকেন কুমিল্লা সেনানিবাস অভ্যন্তরে পাহাড় হাউজ এলাকার কোয়ার্টারে। অল্প বেতনের চাকরি। ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করে। সংসারে অসচ্ছলতা কিছুটা রয়েছে। একমাত্র মেয়ে সোহাগী জাহান তনু কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে অনার্সে ভর্তির পর থেকেই টিউশনি করে নিজের পড়ালেখার খরচের কাজটা সেরে থাকে। সে ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী। ছোটবেলা থেকে নাচ-গানসহ সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের প্রতি দারুণ ঝোঁক থাকায় অনার্সে ভর্তি হয়ে যুক্ত হয় ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটারের সঙ্গে। তনু কুমিল্লা সেনানিবাসের আবাসিক এলাকায় দুটি টিউশনি করত। সপ্তাহে চার দিন যেত টিউশনিতে। টিউশনি শেষ করে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসে। ঘটনার দিন ২০ মার্চ বিকেলে তনু তাদের কোয়ার্টারের বাসা থেকে টিউশনি করতে বের হয়। ওইদিন রাত দশটা বেজে গেলেও তনু ঘরে ফিরছিল না। ইয়ার হোসেন অফিসের ডিউটি সেরে রাত অনুমান দশটায় বাসায় ফেরেন। বারান্দায় বাইসাইকেলটি রেখে ঘরে ঢুকে সোহাগী বলেই মেয়েকে ডাকতে থাকেন। সাড়া নেই সোহাগীর। স্ত্রী আনোয়ারা বেগম বললেন, মেয়ে এখনও টিউশনি থেকে ফেরেনি। আঁতকে উঠলেন ইয়ার হোসেন। মেয়ে ফিরতে দেরি করছে এমনটি জানালেন প্রতিবেশী শিক্ষক কামালকে। টর্চলাইট হাতে শিক্ষক কামালকে সাথে নিয়ে বেরুলেন মেয়ের খোঁজে। পেছনে পেছনে ছোট ছেলে রুবেল বের হয়। কোয়ার্টারের বাসা থেকে সামান্য দূরে একটি কার্লভাটের কাছে টর্চের আলো ফেলতেই দেখলেন মেয়ের একটি জুতা পড়ে রয়েছে। জুতা হাতে নিয়ে সোহাগী বলে চিৎকার দিলেন। ছোট ছেলে রুবেল দৌড়ে এলো। আরেকটু সামনে যেতেই মিলল তনুর মোবাইল ফোন। কাছাকাছি একটু উঁচু গাছগাছালি ঘেরা জায়গায় উঠে দেখতে পেলেন আদরের কন্যা সোহাগীর নিথর দেহ পড়ে রয়েছে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ডাকাডাকি আর কান্না-চিৎকারে স্ত্রী আনোয়ারাসহ আরেক ছেলে ছুটে আসেন। সবাই মিলে মেয়েকে ধরাধরি করে নিয়ে যান সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। কর্তব্যরত চিকিৎসক জানালেন বেঁচে নেই। কান্নার রোল পড়ে হাসপাতালে। খবর ছড়িয়ে পড়ে কলেজ থিয়েটারের সদস্যদের কাছে। তারপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে।
পরদিন সোমবার সকালে তনুর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে। সোমবারই কোতোয়ালি মডেল থানায় অজ্ঞাতনামা আসামি উল্লেখ করে মামলা করেন সোহাগী জাহান তনুর বাবা ইয়ার হোসেন। তারপর লাশ নিয়ে যাওয়া হয় তনুদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে। সেখানেই সন্ধ্যায় তাকে দাফন করা হয়। মামলা করেও নানা রকম চাপের মুখে ছিলেন নিহত তনুর বাবা। কিন্তু থেমে থাকেনি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, সাংবাদিক, স্কুল কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ কর্মসূচি। তনু হত্যাকারিদের শনাক্ত করে বিচারের দাবিতে ঝড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠে সারা দেশ। পাঁচদিন ধরে চলছে প্রতিবাদ। কোন চাপই দমাতে পারছে না প্রতিবাদের ভাষা। কুমিল্লা সেনানিবাসের মতো একটি সংরক্ষিত এলাকায় সন্ধ্যারাতে কীভাবে কারা ঘটালো এমন একটি নৃশংস হত্যাকা-, এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে দেশবাসীর মনে।
কুমিল্লা সেনানিবাসের আবাসিক এলাকায় কলেজ ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর নৃশংস হত্যার ঘটনায় নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছেন কুমিল্লার বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া ছাত্রীদের মধ্যে যারা প্রাইভেট টিউশনি করে থাকে। এসব শিক্ষার্থীরা জানান, যেখানে অধিক নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও তনু ধর্ষণ ও খুনের শিকার হয়েছে, সেখানে আমরা যারা সাধারণ এলাকার বাসা-বাড়িতে টিউশনি করে থাকি তাদের অবস্থা তো আরও ঝুঁকিপূর্ণ ধরে নিতে হবে। এভাবে তো চলতে পারে না। তনু হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে এরকম অপরাধ আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এদিকে তনু হত্যার প্রতিবাদে কুমিল্লার সর্বত্র চলছে প্রতিবাদ।
এদিকে সোহাগী জাহান তনু হত্যাকা- নিয়ে গতকাল শুক্রবার বিকেলে জেলা কোর কমিটির বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জেলা প্রশাসক মো. হাসানুজ্জামান কল্লোলের সভাপতিত্বে ওই সভা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন ডিজিএফআইয়ের পরিচালক কর্নেল সাজ্জাদ হোসেন, জেলা পুলিশ সুপার মো. শাহ আবিদ হোসেন, ১০ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মোখলেছুর রহমান, র্যাব-১১ কুমিল্লার অধিনায়ক ও উপপরিচালক মো. খুরশীদ আলম, এনএসআইয়ের উপপরিচালক মো. মুজিবুর রহমান, আনসার ও ভিডিপির জেলা কমান্ডার শফিকুল আলম, কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মুহাম্মদ গোলামুর রহমান ও জেলা তথ্য কর্মকর্তা মীর হোসেন আহসানুল কবীর। সভা শেষে সাংবাদিকদের জেলা প্রশাসক বলেন, ‘এখন পর্যন্ত প্রকৃত আসামিকে ধরা সম্ভব হয়নি। খুনের এ ঘটনা নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সঙ্গে সরকারি বিভিন্ন সংস্থাগুলো কাজ করছে।’ প্রেস ব্রিফিংয়ে এক গণমাধ্যম কর্মীর প্রশ্ন ছিল, সেনানিবাসের ভেতরে এ ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে সেনাবাহিনীর বক্তব্য কী? এমন প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি ডিজিএফআইয়ের কর্নেল। তার পক্ষে জেলা প্রশাসক মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল বলেন, যদি কোনো বক্তব্য থাকে তাহলে সেটা আইএসপিআর থেকে দেওয়া হবে। এখানে তিনি কোনো কথা বলবেন না।
এদিকে গতকাল সকালে ও বিকেল থেকে কুমিল্লা নগরীর প্রেসক্লাব, কান্দিরপাড়ের পূবালী চত্বর মোড়ে বিভিন্ন সংগঠন মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে। কুমিল্লার সাংস্কৃতিক কর্মীরা রবিবারের মধ্যে তনু হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি দিয়েছেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।